‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’— অল্প কথায় গল্প বলে দেওয়ার এক বই
শারমিন রিমা
‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’।
বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া! মলাট উল্টে হিমু চলে গেল শেষের পাতায়। যেখানে লেখকের কথা আছে। তারপর আবার প্রথম পাতায়। মনে হচ্ছে, পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে কি যেন একটা খুঁজছে হিমু! হঠাৎ, চোখেমুখে লেপ্টে থাকা ত্রি-কোণ হাসি বলছে এইতো বুঝি পেয়ে গেল। আসলে এতোক্ষণ হিমু বইয়ে থাকা গল্পের নামগুলো খুঁজছিল। তারপর সেই গল্পক্রম ধরে সোজা ১০৬ নম্বর পৃষ্ঠায়। চোখ বুলিয়ে হিমু পড়ে চলেছে এক ‘চোর’র গল্প।
স্বাভাবিকভাবেই চোরের গল্পে থাকবে চোরেরই কথা। কিন্তু সেই চোরও যে মানুষ! তারও আর আট দশটা মানুষের মতন যে একটা নাম রয়েছে, জীবন রয়েছে, সেই জীবনের একটা নিছক সাদামাটা গল্পও রয়েছে। অথচ সব ছাপিয়ে তার প্রথম ও শেষ পরিচয় সে ‘চোর’। কখনও কখনও সেই চোরের মুখেও যে দামি কথা মানায় তা ক’জনইবা উপলব্ধি করে! —তবে হিমুর মতন পাঠকের মাঝে সেই উপলব্ধির বোধটুকু গল্পের ছলে বলেছেন লেখক জয়নুল টিটো।
পুরো নাম জয়নুল আবেদীন টিটো। তিনি পেশায় একজন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা হলেও মননে-মগজে কিন্তু ‘জাত লেখক’। ‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। যদিও নব্বই দশক থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। তখনকার সময়ে দৈনিক আজাদী পত্রিকার ‘আজমিশালী’ পাতায় নিজস্ব ঢংয়ে লিখেছেন এমন সব বোধের গল্প। কিন্তু কখনও মলাটবন্দী করার উদ্দেশে বই বের করেননি এই লেখক। লেখালেখির প্রায় ২৫ বছর পর পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত ও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেইসব গল্পই স্থান করে নিয়েছে ‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’ নামক এই বইয়ে।
অক্ষরবৃত্তের প্রকাশনায় ও নিয়াজ চৌধুরী তুলির প্রচ্ছদে এবারের অমর একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে। মঙ্গলবার ১ মার্চ বিকেলে পুলিশ মেমোরিয়াল ডে’তে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম মাঠের একুশে বইমেলায় এ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর।
এদিকে, ‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’ বইয়ে মোট ১৮টি গল্প রয়েছে। তারমধ্যে বেশিরভাগ গল্পই আবর্তিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে ঘিরে। বইয়ে থাকা গল্পে প্রেম-বিরহ, ভালোবাসা, রাজনীতি, জীবনবোধ ও রম্য রচনা পাঠককে অনায়াসে নিয়ে যাবে অন্য এক জীবনে। যেখানে পাঠক খুঁজে পাবে নিজেরই প্রতিচ্ছবি।
মোড়ক উন্মোচনের আগে বইমেলায় কথা হয় ‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’র লেখক জয়নুল টিটোর সঙ্গে। লেখালেখির এতো বছর পর প্রথম বই প্রকাশ করলেন। এর পিছনে কারণ কী? এর জবাবে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘যে বই পোকায় কাটবে কেউ পড়বে না এমন বই কখনও লিখতে চাইনি। এতো বছর পর মনে হয়েছে লেখাগুলো মলাটবন্দী করার সময় এসেছে সে ভাবনা থেকেই বই বের করা। আসলে লেখকের কাজ তার লেখাকে পাঠক উপযোগী করে উপস্থাপন করা। যদি কোনো লেখাকে জটিলভাবে উপস্থাপন করি তবে পাঠক নিতে পারবে না বা নিবে না। পাঠক যখন কোনো গল্প বা উপন্যাস পড়ে যদি নিজেকেই সেখানে কল্পনা করতে পারে তবেই লেখকের সার্থকতা।’
আপনার গল্পের মূলমন্ত্র কী এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অল্প কথায় গল্প বলে দেওয়া।’
লেখকের কথার সূত্র ধরেই দেখা গেল গল্পে কোনো মারপ্যাঁচ নেই। বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠায় চোখে পড়লো ‘ঝরা পাতার গল্প’। যে গল্পে ছিল ঝরা নামের ১০ বছরের এক মেয়ের গল্প। পুলিশ অ্যাকাডেমি রাজশাহী সারদার মাঠে ট্রেনিংরত মেয়ে পুলিশদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে ঝরা নামের সেই পাতা কুড়ানি মেয়েটি। সে পাতা কুড়ায়। কেবল বিদ্যা কুড়াতে পারে না। কারণ বিদ্যা কিনতে টাকা লাগে তার টাকা নেই। পুলিশ হবার ইচ্ছেগুলো তার কুড়ানো পাতার সঙ্গেই শেষতক উনুনে ঠেলে যায়। মনস্তাত্বিক বিবরণ আছে এ গল্পে।
ভালোবেসে না পাওয়ার গল্প আছে বইয়ের প্রথম গল্পে। ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় সে গল্পের নাম ‘মস্তিষ্ক-শেকল-কাশফুল-পুরাণ’। হারিয়ে ফেলা ভালোবাসার খোঁজে খ্যাপা আর হয়রান হয়ে কাশফুল নামের মেয়েটিকে জনমভর খুঁজতে খুঁজতে রহিম নামের সহজ সরল যুবকটি পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। কখনো পায়ে জোটে শেকল। সভ্য সমাজের লোকেরা ভাবে মস্তিষ্কে গণ্ডগোল। কিন্তু রহিমের বুকের ভাঁজে থাকা কাশফুলের হদিশ কেউ খোঁজে না।
তারপরের গল্পটি ১০ নম্বর পৃষ্ঠায়। যে গল্পের নামে বইটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’। পাহাড়ি মেয়ে মিথিলা চাকমা আর বাঙালি যুবক অনন্তের ভালোবাসার গল্প। মিথিলার বিউটিবোনে পত্রমিতা অনন্ত লাল পিঁপড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রেমের গল্প হলেও দিনশেষে যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজ ধর্ম কিংবা সংস্কৃতি। ভিন্ন সংস্কৃতির দুটো মানব মানবী সমাজ সংসারের যাতাকলে পিষ্ট হয়। গল্প থেকে গল্পের জন্ম হয়।
১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় কলেজে পডুয়া পাঁচ বন্ধুর মেস জীবনের নানা ঘটনা আর টাকি মাছ রান্নার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়েই রম্য গল্প ‘আর না আর না’। ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় আছে প্যারা সাইকোলজি গল্প ‘মেঘ রং ভালোবাসা’। ৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় সুইডিশ কন্যা ইলোরার বিয়োগান্তক প্রেম পরিণতির গল্প ‘ইলোরা’। এই গল্প যে পাঠককে জোরে শোরে একটা ধাক্কা দিবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ৪৯ পৃষ্ঠায় আছে ‘মহব্বত মিয়ার আখেরী ডিসিশন’ নামের রম্য গল্প। এই গল্পে পাঠক বুঝতে পারবে ঢেঁকি কেন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সেলিমের বেঈমানির গল্প নিয়েই ‘প্রতিদান’ রয়েছে বইয়ের ৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায়। ৬২ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘বৃষ্টি: নোনাজলের’ গল্প। বৃষ্টিতে দামি গাড়িতে করে স্কুলে যাওয়া ছেলেটি ঘোলাটে কাঁচের ফাঁক দিয়ে পথ শিশুদের দেখে বলে, মা এরা যে ভিজে! জ্বর হয় না?
মা বলে ওরা পঁচা মানুষ। ওদের জ্বর হয় না। কথাটা তীরের মতো বিঁধে ড্রাইভারের বুকে। ওই পঁচা মানুষই যে তার শৈশব। বইয়ের ৬৪ নম্বর পৃষ্ঠায় সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা শান্তের গল্প ‘নীল যন্ত্রণা’। তারপরই আছে ৭২ পৃষ্ঠায় রম্য ধাঁচের গল্প ‘মামা-মামি সমাচার’। ৭৭ পৃষ্ঠায় আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির অশুভ ছায়ায় বলি হওয়া শুভর গল্প ‘সচরাচর’। ৮৩ পৃষ্ঠায় আছে ‘এটা একটা প্রেমের গল্প হতে পারে’ নামের নিখাদ প্রেমের গল্প। হয়তো ভালোবাসা নয়তো বন্ধুত্ব। এ দোলাচালে ৯১ পৃষ্ঠায় থাকা গল্প ‘মোহ’। ৯৪ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনটি পরমানু গল্পের সমাহার ‘শক’ গল্পটি। এই গল্পে পাঠক নতুনত্বের স্বাদ পাবেন।
বইয়ের ৯৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ফেলে আসা স্মৃতির রোমন্থন করার নষ্টালজিক গল্প ‘বৃত্ত গড়ার গল্প’। বইয়ের এ গল্পে পাঠক হোঁচট খাবে। বইয়ের ১০০ নম্বর পৃষ্ঠায় আছে ‘তিন গর্দভের মেল’ নামের এক রম্য গল্প। যে গল্পটি দিয়ে বইয়ের ইতি টানা হয় তা হলো ১০৬ নম্বর পৃষ্ঠার ‘চোর’। সেই গল্পে চোরের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় গল্পের শেষে চোরের পাল্টা প্রশ্নে পাঠকের চিন্তার জগতে ঢেউ খেলে যাবে। আর সেই প্রশ্নের উত্তর গল্পকার পাঠকের কাছেই ছুঁড়ে দিয়েছেন?
বইয়ের মাধ্যমে পাঠকের জন্য কী বার্তা দিবেন এমন প্রশ্নে ‘বিউটিবোনে লাল পিঁপড়া’ বইয়ের লেখক জয়নুল টিটো বলেন, ‘ভালো বই কোনো ভুল বার্তা দেয় না। বই পড়ুন এবং যেটা ভালো লাগে সেই বই পড়ুন। তাছাড়া আমি খুব আশাবাদী, মেলায় আসার দুইদিনের মধ্যে প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে গেছে। তার মানে পাঠক গল্পগুলো গ্রহণ করেছে। সেইসঙ্গে পাঠকের যে প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি তা আমাকে আশান্বিত করছে।’
জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত একেকটি গল্প। সে গল্পগুলোই তুলে এনেছেন লেখক জয়নুল টিটো। তাঁর জন্ম ও বেড়ে উঠা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায়। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। দীর্ঘদিন করেছেন মুক্ত সাংবাদিকতাও। সংগঠক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ‘প্রথম আলো বন্ধুসভা’ প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। প্রকাশিত প্রথম এই বইটি তিনি তাঁর মা-বাবা ও সহধর্মিণীকে উৎসর্গ করেছেন।