৮৫ বছরে কিংবদন্তি শিল্পী সবিহ্ উল আলম
রশীদ এনাম
জন্মকথা- প্রফেসর শিল্পী সবিহ্ উল আলমের জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯৪০ সালে পটিয়া চট্টগ্রামে। বাবা ছিলেন তৎকালীন পটিয়ার সাবরেজিস্টার ও পটিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক- কথা শিল্পী মাহাবুবুল আলম, মাতা রাহেলা খাতুন। বাবার চাকরির সুবাধে আলম পরিবার পটিয়ায় তালতলা চৌকি গ্রামে ভাড়া বাসায় থাকতেন। আলম পরিবার ৬ বৎসর বয়স পর্যন্ত পটিয়ায় অতিবাহিত করেন। তাঁদের আদি নিবাস হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে। ১১ জন ভাইবোনদের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তাঁর স্ত্রী টইটম্বুরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত সেলিমা সবিহ্ । শিল্পী সবিহ্ উল আলম দুই পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের জনক। এক সময় চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়ির আল আমিন বাড়িতে স্ব পরিবারে বসবাস করতেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা শান্তিনগরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন।
শিক্ষাজীবন - শিল্পী সবিহ্ উল আলম ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৫৯ সালে নাইট কলেজ (সিটি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে এশিয়া ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি নিয়ে তিনি লাহোর আর্ট কলেজ থেকে শিল্প ও নকশায় ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নিজেকে শিল্প ও নকশা পেশায় নিয়োজিত করেন। এসএমই ফাউন্ডেশনের স্পিকার হিসেবেও তিনি নিয়মিত ক্লাশ নেন।
শিল্পী কীর্তি - ১৯৭১ সালে যে কজন শিল্পী পাকবাহিনীদের বিরুদ্ধে ছবি আঁকার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী সবিহ্ উল আলম। ছয়জন শিল্পীর ১০৪ ফিট লম্বা আঁকা ছবির নাম ছিল ‘আবহমান বাংলা ও বাঙ্গালী’ । সে সময় পাকিস্তানবিরোধী ছবিটি বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন ।
সবিহ্ উল আলম দেশবরেণ্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সমসাময়িক ছিলেন। বলা যায়, অনেকটা গুরু-শিষ্যর মতো। একদা শিল্পী জয়নুল আবেদিন চট্টগ্রামে বেড়াতে গেলে প্রফেসর শিল্পী সবিহ্ উল আলমকে পরামর্শ দেন, চট্টগ্রামে যাতে একটা আর্ট ইনস্টিটিউট করেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথা রেখেছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে শুভাকাঙ্খীদের নিয়ে শিল্পী সবিহ্ উল আলম চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি ছিলেন ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।
আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর সবিহ্ উল আলম শিক্ষকতায় থেমে থাকেননি। তিনি একাধারে ছিলেন শিল্পী, গায়ক, মডেল, শিশু ও প্রকৃতি প্রেমী। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের মূল ফটকের AK (Acquired Knowledge) নকশাও এই গুনী শিল্পীর করা (বর্তমানে ভেঙে ফেলা হয়েছে)।
১৯৯২ সালে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে করলেন শিশু কিশোর পত্রিকা টইটম্বুর যা গত ৩০টি বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। পত্রিকাটি শুধু লেখালেখিতে থেমে নেই। একটি সংগঠনেও রূপ নিয়েছে।
টইটম্বুর নিষ্পেষিত পরিবারের পাশে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে গরিব-মেধাবী শিশুদের বৃত্তি প্রদান থেকে শুরু করে চিকিৎসাও সহায়তা করে আসছে টইটম্বুর পরিবার। শিল্পী সবিহ্ উল আলম টইটম্বুর পত্রিকাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন।
বাংলাদেশে প্রথম, চট্টগ্রামে শিশুদের এপিটিউট বা প্রবণতা নির্ধারণী ইশকুল ফুলকি প্রতিষ্ঠার পেছনেও বেশ অবদান রয়েছে শিশুপ্রেমী সবিহ্ উল আলমের। তিনি ফুলকির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইশকুলের পরিকল্পনাকারীও বটে।
শিল্পী সবিহ্ উল আলমকে বিজ্ঞাপন চিত্রের একজন মডেল হিসেবেও আমরা দেখেছি। তিনি স্টারশিপ কনডেন্সড মিল্ক, পন্ডস ক্রিম, হোয়াইট প্লাস টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেলিং করেছেন। তিনি বাংলাদেশের রপ্তানি মেলার পরিকল্পনা ও প্রচারের প্রতিকৃৎ।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— মাননীয় কচু, রফিক আনোয়ারের সন্ধানে, পিঁপড়ে নেকলেস ও অন্যান্য গল্প, নিমিত্ত মাত্র , হিজ একসিলেন্সী মিস্টার ডিসেনটিরি, নুজমার গপ্পো, লেখা থেকে রেখা ইসলামিক ক্যালিওগ্রাফি, পিকনিক, কারুকাজের যাদুকর ইত্যাদি বই বেশ পাঠক নন্দিত হয়।
ফেনীর বল্লবপুরে জোসনে আরা কাশেম মসজিদ এবং নোয়াখালী বাইতুশ শরিফ মসজিদের নকশাও শিল্পী সবিহ্ উল আলমের হাতে গড়া।
শিল্পীকে দু-একটা প্রিয় গান সবসময় গুন গুন করে গাইতে দেখি, তার মধ্যে “ও ব্রিটিশ কোম্পানি, ও ব্রিটিশ কোম্পানি, ও ব্রিটিশ কোম্পানি গাট্টি-পুস্তা বাঁধি ধাইবানী। ২০০ বছর গড়ি আইলা আঁরার উদ্দি হাদ্দানি, আঁরার উদ্দি হাদ্দানি, বিলাতত যায়রে বদ্দা গাছ কাটিও হদ্দা হদ্দা আইট্টা কলা চাবাইত যায় কাঁচ কলা চাবাইলানি ”- ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য ব্যাঙ্গ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গানও রচিত হয়েছিল এ গান। গানের রচয়িতার নাম জানা যায়নি।
শিল্পীর অর্জন- শিল্পী সবিহ্ উল আলম চট্টগ্রাম সমিতি পদক, চট্টগ্রাম মঞ্চ পদক, চারুশিল্পী পদক, চট্টগ্রাম আর্ট কলেজ ও ফতেয়াবাদ কৃতি সন্তান এবং ’৭১ এর শহীদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপ পদক লাভ করেন।
তিনি রপ্তানিবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে, ভারত, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, পাকিস্তান, কানাডা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, লন্ডন, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড,মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
আমার অনুভূতিতে শিল্পী সবিহ্ উল আলম
সবিহ্ উল আলমের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০০৮ সালে রাজধানীর চট্টগ্রাম সমিতি ভবনে। প্রথম পরিচয়ে আমি খুব মুগ্ধ হলাম। মানুষকে খুব সহজে ভালোবেসে পরম মমতায় খুব কাছের করে নিতে পারেন। পটিয়া আমার বাড়ি জানতেই তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করে বললেন, রশীদ এনাম তুমি আমাকে স্যার বলে কখনও সম্ভোধন করবে না। চাচা বলে ডাকবে। সেই থেকে পরম আত্মার আত্মীয় হয়ে গেলেন। সেই টানে টইটম্বুরে এবং আলম পরিবারে নিয়মিত যাতায়াত।
গত ২০১৬ সালে বলাকা প্রকাশন থেকে আমার লেখা প্রথম প্রকাশিত, একাত্তরের শহীদ ছবুর বইটি মোড়ক উন্মোচন হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সবিহ্ চাচাকে নিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ দেখি গাড়িতে বসে হাই মাউ করে কাঁদছেন তিনি। আমি একটু নার্ভাস হয়ে গেলাম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলা শুরু করলেন, “২০০৮ সালে ১২ জানুয়ারি তাঁর জীবন সঙ্গিনী সেলিমা সবিহ্ না ফেরার দেশে চলে যান। চাচীর কথা বলে কাঁদতে শুরু করলেন এবং বললেন— যাওয়ার কথা ছিল আগে আমার, আমাকে একা ফেলে রেখে সে কেন চলে গেল না ফেরার দেশে— আমি আজও এটা মেনে নিতে পারিনি।
দুজন দুজনার ছিলেন, দুজনে দুজনের মনের যত্ন নিতেন। প্রকৃত ও পবিত্র প্রেম ছিল দুজনের মধ্যে। দুজনে নাকি একে অপরকে খুনসুটি করে বলতেন, আমি আগে চলে যাব। সৃষ্টিকর্তা আগে ডাক দিলেন সেলিমা সবিহ্ চাচীকে, আল্লাহ চাচীকে জান্নাতের বাগানের ফুল ফুটিয়ে রাখুন।
বিনয়ী সবিহ্ উল আলম চাচা প্রিয়জনকে ছাড়া ১৩ বছর একাকী কাটিয়ে দিলেন ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সাথে। আমি জানি না পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর ও পবিত্র বন্ধন আর দ্বিতীয়টা আছে কিনা। একান্নবর্তী পরিবারের বন্ধন তিনি ধরে রেখেছেন।
আলম পরিবার সত্যি বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী পরিবারদের আইডল বলা যায়। সবিহ্ উল আলম চাচা আমাকে বলেন, আমি প্রতি মাসে তোমার চাচী মাকে দেখতে যাই, বুঝতে পারলাম প্রতিমাসে সেলিমা সবিহ্-র কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য দোয়া করে জেয়ারত করেন তিনি।
চাচা আরও বলেন, ‘জীবন সঙ্গিনীর আত্মা আমাকে দেখতে পায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, কেন তুমি এত তাড়াতাড়ি প্রস্থান করলে? দুই হাত তুলে প্রিয়জনের জন্য দোয়া করেন, আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। চোখ মুছতে মুছতে কবরে সালাম দিয়ে আবার ছুটে যান ইট-পাথরের নগরে টইটম্বুরের টানে। প্রকৃত ও পবিত্র ভালোবাসার উদাহরণ এর চেয়ে কি হতে পারে আমার জানা নেই।
গত ২০১৯ সালে হঠাৎ একদিন আমাকে বলেন, রশীদ এনাম আমি পটিয়া যেতে চাই আমার নিজভূমে— তুমি নিয়ে যাবে আমাকে? আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনে মনে পরিকল্পনা করলাম সবিহ্ চাচার জন্য কিছু একটা করতে হবে, যাতে পটিয়ায় তাঁর স্মৃতি যেন অনন্তকাল থাকে। নিজের পরিকল্পনায় টইটম্বুরের সহযোগিতায় একটা শিশুতোষ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করলাম। আমার মা জাহেদা আহমেদের নামে একটি মায়ের বাগান করার পরিকল্পনা করলাম। সবিহ্ উল আলম চাচাকে পরিকল্পনার কথা বলাতে তিনি খুশি হলেন। বাগানের নাম রাখতে বললেন, ‘মায়ের বাগান’ ।
টইটম্বুর সম্পাদক কবিতা আপার ছেলে ভাগিনা জাররাফসহ সবিহ্ চাচাকে সাথে নিয়ে ২৭ মার্চ বিকেলে সুবর্ণ এক্সেপ্রেসে রওনা দিলাম, পটিয়ার মাটিতে প্রায় ৭২ বছর পা রাখলেন শিল্পী সবিহ্ চাচা। ২৮ মার্চ উদ্বোধন করলেন, আমার বিদ্যাপীঠ পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘শহীদ ছবুর শিশুতোষ পাঠাগার’।
সবিহ্ উল আলম চাচা পটিয়ায় গিয়ে প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ। সকাল বেলা আমার পরিবারের সাথে “মায়ের বাগান বাড়ির” ছাদে প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে গল্প আর সকালের নাস্তা সারলেন। বাগান বাড়িতে ডাব খাওয়া, পুকুর থেকে জাল পেতে মাছ ধরা উপভোগ করলেন।
সবিহ্ চাচার মন্ত্রমুগ্ধতা দেখে খুব খুশি হলাম। মনে হচ্ছিল কতদিন পর যেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন মায়ের কাছে। তিন দিন ছিলেন পটিয়ায় তিনি। এই তিন দিন আমাদের বাড়িটিও ছিল যেন এক আনন্দ আর হাসি খুশিতে ভরা।
ঘুরে দেখালাম, সুচক্রদন্ডী গ্রামের সাহিত্যবিশারদ বাড়ি, ধলঘাটের প্রীতিলতার বাড়ি, মাস্টারদার স্মৃতি বিজড়িত গৈড়লা গ্রামসহ আরও অনেক জায়গায়।
পটিয়া থেকে ঢাকা চলে আসার সময় আমার পরিবার পরিজনদের বুকে জড়িয়ে চাচাজী খুব কাঁদলেন। আমার বাবা ও চাচার সাথে পাল্লা দিয়ে চোখের জল জড়ালেন। আমার বাবার কোন ভাই নেই। সে তিন দিনে খুব আপন করে পেয়েছিলেন তাঁর আত্মার আত্মীয় ভাই শিল্পী সবিহ্ উল আলম চাচাকে। ৮৪ বছর পেরিয়ে দেশ বরেণ্য কীর্তিমান নিভৃতচারী শিল্পী সবিহ্ উল আলম।
আমার সবিনয় নিবেদন— একাত্তরের শিল্পী সবিহ্ উল আলমকে যেন স্বাধীনতা ও একুশে পদকে ভূষিত করেন।
রশীদ এনাম,
লেখক ও প্রাবন্ধিক।