Cvoice24.com

পোশাককর্মীদের প্রশ্ন— নারী দিবস দিয়ে কি হবে

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:১৯, ৮ মার্চ ২০২১
পোশাককর্মীদের প্রশ্ন— নারী দিবস দিয়ে কি হবে

পোশাক কর্মীদের সকালটা শুরু হয় কারখানায় যাওয়ার প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে। ছবি : সিভয়েস।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছেন পোশাক কর্মীরা। সমাজের উল্লেখযোগ্য নারীদের একটা অংশ এখাতে কাজ করলেও দেশে ঘটা করে উদযাপিত হওয়া ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই। তাদের প্রশ্ন—‘নারী দিবস সম্পর্কে জেনে কি হবে? এসব দিয়ে তো আমাদের ভাগ্যর পরিবর্তন হয়না; যা নিছকই অভিনয়।’

অথচ এ পোশাক কর্মীরা—‘যে রাধেঁ সে চুলও বাঁধে’। ভোরের শুরু থেকে তাদের হাড়ভাঙ্গা যে পরিশ্রম দিয়ে দিন শুরু হয় তা মধ্যরাতে শেষ হয়। এভাবেই চলছে, তাদের জীবন চক্র। অথচ সমাজের বৃহৎ নারী অংশটির অংশ গ্রহণ নেই নারীদের নিয়ে যে দিবস তাতে। তাদের চিন্তা এসব দিবস নিয়ে নয়; নিশ্চিত কর্ম পরিবেশ ও দুবেলা খাবারের নিশ্চিয়তা পাওয়াই তাদের একমাত্র চাওয়া। এরপরও সেসব নিশ্চিয়তা পাচ্ছেন না বলে তাদের অভিযোগ।    

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বনাম ছিল ‘আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন হচ্ছে দিবসটি। পরিবার, সমাজ এবং দেশের দায়ভার থেকে শুরু করে সব বিষয়ে গুরুদায়িত্ব পালনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে নারীরা। পুরুষের অবিচার, অত্যাচারের সমস্ত যন্ত্রতন্ত্র ভেঙেচুরে তছনছ করে বিশ্বের অনেক দেশের নারী জাতি সিংহাসনে উপনীত হয়েছে। তবে সে জায়গায় এখনো পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের নারীরা। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা এখনো তাদের অধিকার সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নয়। তাই রীতিমত তারা সয়ে যাচ্ছেন নানা অন্যায়, অত্যাচার।

পোশাকর্মীদের সকালটা শুরু হয় পরিবহনে ওঠার যুুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

বন্দর নগর চট্টগ্রামে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে নারীরা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিশেষ করে নারী পোশাক শ্রমিকদের অবদানে বাড়ছে জিডিপি’র হার। সোমবার (৮ মার্চ) সকালে নগরের ঈদগাঁ, দেওয়ানহাট ও শান্তিবাগ মোড়ে কথা হয় কিছু নারী পোশাক শ্রমিকদের সাথে। তারা জানালেন—তাদের অগ্রাধিকারের প্রয়োজন নেই। তারা চান যাবতীয় নিরাপত্তা ও কর্মস্থলে সুষ্ঠু পরিবেশ। 

ইপিজেডের জেমিনাস গার্মেন্টসে কাজ করেন নাজমা বেগম (৩৫)। আজ নারী দিবস, আপনি জানেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নারী দিবস সম্পর্কে আমাদের জেনে লাভ কি। এসব দিবস দিয়ে তো আর আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। এগুলো নিছক অভিনয়। পেটের দায়ে গার্মেন্টসে কাজ করি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটাখাটনি করি। কিন্তু আমরা আমাদের ন্যায্যটুকু ঠিকমত আদায় করতে পারি না। সবাই আমাদের ঠকানোর চেষ্টা করে। সারাবছর তো আমাদের নিয়ে কথা বলতে কাউকে দেখি না।’

পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে একমত প্রকাশ করলেন কুলসুমা আক্তার (১৯)। তিনিও নাজমার সাথে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাসা থেকে বের হবার সময় টিভিতে টকশো দেখছিলাম। নারী দিবস নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এসব এখানেই শেষ। আমি গার্মেন্টসে ১০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করি। তার মধ্যে ৪ হাজার টাকা ঘরভাড়ায় চলে যায়। গাড়িভাড়া, খাওয়া, মায়ের ওষুধ খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে মাস শেষে টাকার সংকট দেখা দেয়। বেতন বাড়ানোর কথা বললেও আমাদের কথা শুনে না কেউ।’

দেওয়ানহাট মোড়ে রাস্তার পাশে তড়িঘড়ি করে হেঁটে যাচ্ছিলেন পোশাককর্মী আনজুমান আরা (২৮)। তিনি কাজ করেন নাসিরাবাদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট গার্মেন্টসে। নারী দিবসের কথা তুলতেই তিনি জানালেন নিরাপত্তার কথা। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে আমি একাই রোজগার করি। আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে। আমার একটা ছেলে আছে ৫ বছর বয়সী। কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে অনেক সময় রাত হয়ে যায়। আমি অনেকবার ইভটিজিংয়ের শিকারও হয়েছি। কিন্তু নিজের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। শুধু আমি নই, সকল নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আল মদিনা গার্মেন্টসের এক নারী পোশাক শ্রমিক জানালেন কর্মস্থলে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের অভাবের কথা। তিনি বলেন, ‘করোনার সময় আমরা বেকার ছিলাম। আমাদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়েছে। এখন ভালোই অর্ডার পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কাজের চাপও বেড়েছে। কিন্তু কাজ আদায় করার জন্য সুপারভাইজার বা ম্যানেজাররা অনেক সময় খারাপ ব্যবহার করেন। ভালো ব্যবহার করেও কাজ আদায় করা যায়। আমরা নারী তাই আমাদের কোণঠাসা করে রাখার মানসিকতা দূর করতে হবে।’
 
হেলা ক্লথিংয়ের মোছাম্মৎ সানজিদা (২৩) বলেন, ‘সারামাস খেটে মাস শেষে ১১ হাজার টাকা বেতন পাই। এ বেতনে আমাদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাছাড়া আমরা নারী শ্রমিকরা খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারিনি। তাই আমাদের অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ নাই। এ কাজ করেই জীবন চালাতে হয়। তাই আমাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সরকারের আরো সুনজর দেয়া প্রয়োজন।’

পোশাককর্মীরা কারখানায় যেতে পরিবহনের জন্য ভোর থেকে রাস্তায় অপেক্ষা করছেন।

ক্লিফটন গ্রুপে কাজ করেন ২৩ বছর বয়সী নাসিমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে যখন নতুন আসি তখন মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করতাম। কাজে ভুল হলে বা কিছু ভেঙে গেলে বাসার মালিকরা মারধর করতো। আর কাজ করে যা টাকা পেতাম, সেটা খুবই কম। তাই বাধ্য হয়ে বাসা-বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে আমার স্বামীর পরামর্শে ৮ হাজার টাকায় গার্মেন্টসে কাজ করি। ভাল করে কাজ শেখার পর এখন ১২ হাজার টাকা পাই। কিন্তু আমাদেরকে নিয়ে নারী দিবসে একদিন ভাবলে চলবে না। আমরা গরিব। আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে প্রতিদিন।’

ডেনিম জিন্সের নারী পোশাককর্মী রুবাইয়াত জাহান (২৩) জানান, নারী দিবস এলেই নারীদের নিয়ে কত কথা, আলোচনার শেষ নেই। ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেলে আলোচনাগুলো বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না। শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, যথাসময়ে বেতন দেয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মত অনেক প্রতিশ্রুতি দেন পোশাক কারখানার মালিকরা। কিন্তু শেষ অবধি আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। 

উইম্যান চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ইনচার্জ আবিদা মোস্তফা সিভয়েসকে বলেন, ‘অনেক ভালোর পেছনে মন্দও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ নারী শাসিত দেশ সত্ত্বেও ধর্ষণ হচ্ছে, হচ্ছে এখনো নারীর প্রতি অত্যাচার-অবিচার। এসব বন্ধ করতে হবে। দেশে নারী শিক্ষার হার ও কাজে অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। বরং নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহতা বেড়েছে।’কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের সুষ্ঠু পরিবেশ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি —যোগ করেন তিনি। 

উল্লেখ্য, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সালে প্রথম আমেরিকার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নারী দিবস পালন করার কথা বলে। পরে জার্মান কমিউনিস্ট এবং নারী অধিকারকর্মী ক্লারা জোসেফিন জেটকিন ১৯১০ সালে নারী দিবস পালনে ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। শেষে নারী দিবসটি জাঁকালোভাবে পালিত হয় ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রোববার।

নারী দিবসের ওপর প্রথম জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বৈঠক হয় ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোয়। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে দিনটি পালনের জন্য মার্চের ৮ তারিখ ধার্য করা হয়, ১৯৭৮ সালে। সেই থেকে ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে ‌‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’।

-সিভয়েস/টিএম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়