Cvoice24.com

হবু বধূ জানে চাকুরিজীবী, লকডাউন বানিয়েছে রিকশাচালক 

হিমু বড়ুয়া

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ১ আগস্ট ২০২১
হবু বধূ জানে চাকুরিজীবী, লকডাউন বানিয়েছে রিকশাচালক 

তুমি কি দেখেছ কভু/জীবনের পরাজয়?/ দুঃখের দহনে, করুন রোদনে/ তিলে তিলে তার ক্ষয়— শিল্পী আব্দুল জব্বারের গানটা কে শুনেননি! ছায়াছবিতে গাওয়া গানটার নিগূঢ় ভাবার্থ ছাপিয়ে যায় আমাদের যাপিত জীবনে। কেননা চলমান কঠোর লকডাউনেও কারো জীবন হয়েছে করুন রোদনে ভরা। তেমনি ২৬ বছর বয়সী এক যুবক ‘ক’। 

জীবনকে রাঙ্গাতে পরিবার থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রাম এসেছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হবার স্বপ্ন নিয়ে। সেই টাকায় এক বন্ধুর সাথে পার্টনারে চান্দগাঁও থানার সিঅ্যান্ডবি বাদামতল এলাকায় চসিকের জায়গায় একটি কসমেটিকসের দোকান দেন। তবে সেই ব্যবসা বেশিদিন করতে পারেননি তিনি। চসিকের উচ্ছেদ অভিযানে পড়ে তার পুঁজির সাথে স্বপ্নও বুলডোজারের নিচে চাপা পড়ে। 

সেখান থেকে স্বপ্ন ভাঙার বেদনা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা ওই যুবকের। চাকরি নেন আগ্রাবাদে জিএমএস ইন্ট্যারন্যাশনাল নামে মেরিন সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানে। মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে তার চলছিল বেশ। এরমধ্যে গত বছর করোনার প্রথম ধাক্কায় অন্য অনেকের মত চাকরিহারা হন তিনি। আবারও জীবন চলার পথে হোঁচট। সেখান থেকে জীবন নৌকা বয়ে চলতে চলতে কাজ নেন বায়েজিদের একটা রেস্টুরেন্টে হোটেল বয় হিসেবে। নাহ এবারও ছন্দপতন! এ বছরের জুনে দেওয়া লকডাউনে বন্ধ হয়ে যায় ওই রেস্টুরেন্ট, ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েন রাঙ্গামাটি থেকে আসা এ যুবক। 

এরই মধ্যে পারিবারিকভাবে তার জন্য আয়োজন করা হয় বিয়ের। পাত্রী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও নিজ পরিবারের সদস্যরাও জানেন তিনি মেরিন সার্ভেয়ার অফিসেই চাকরি করেন। কিন্তু এই লকডাউন তাকে ধরিয়েছে রিকশার হাতল! জীবন চাকা ঘুরানোর জন্য তিনি এখন নিজেই ঘুরান রিকশার প্যাডেল। 

রোববার (১ আগষ্ট) দুপুরে নগরের বায়েজিদ থানার বেবীসুপার মার্কেটের সামনে রিকশায় বসে কথা হয় ওই যুবকের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে জানালেন তার লকডাউনের দিনলিপি। শুনিয়েছেন জীবন নামে রেল গাড়িটার চাকা লাইনচ্যুত হবার গল্প...

‘ক’ আদ্যক্ষরের এ যুবক সিভয়েসকে বলেন, ‘ভাগ্যের চাকা বদলাতে ২ বছর আগে রাঙ্গামাটি থেকে চট্টগ্রামে আসি। গত ৯ মাস ধরে পরিবার জানে আমি চাকরি করি। কিন্তু  গত এপ্রিলে চাকরি চলে যায় আমার। এরপর চেষ্টা করেও অন্যখানে চাকরি পাইনি। কিছুদিন খাবার হোটেলে মেসিয়ারের কাজ করেছি। এখনও নিজের চাকরি নেই সেটা পরিবারকে জানাতে পারিনি। কারণ একধরনের হীনমন্যতা ও সংকোচ আমার মধ্যে কাজ করে। এই যে এখন রিক্সা চালাই এরআগে কখনো চিন্তা করিনি এ কাজ করব। আমার সাথে যে মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে সেও জানে আমার চাকরি আছে। শ্বশুর বাড়ির লোকজনও জানে আমি শহরে চাকরি করি।’ 

তিনি জানান, তার আদি বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। তবে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে রাঙ্গমাটি সদরের বনরূপায় বাস করছেন। পরিবারে তার মা বাবাসহ চার ভাই দুই বোন। তিনি চার ভাইয়ের মধ্যে মেঝো। শিক্ষার গণ্ডিও বেশিদূর এগোতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করেছেন পড়াশোনা। সম্প্রতি বিয়ের জন্য তার পরিবারই মেয়ে ঠিক করেছে। মেয়ের বাড়িও চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকায়। বর্তমানে ওই যুবক নগরের বায়েজিদ থানার বেবী সুপার মার্কেট এলাকার পেছনের একটি কলোনিতে ভাড়া বাসায় একা থাকেন। 

তিনি বলেন, ‘পরিবার থেকে প্রায় ২ লাখ টাকা নিয়ে চট্টগ্রামে আসি। এক বন্ধুর সাথে নগরের চান্দগাঁও সিঅ্যান্ডবি এলাকায় ছোট একটা কসমেটিকসের দোকান দেই। কিন্তু বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যবসাতে প্রচুর ক্ষতির মুখে পড়ি। এর ছয় মাসের মাথায় চসিকের এক উচ্ছেদ অভিযানে সেই দোকানও ভেঙে ফেলা হয়। এরপর নগরের আগ্রাবাদে জিএমএস ইন্ট্যারন্যাশনাল নামে মেরিন সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাই। সেখানে সব মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার মতো বেতন পেতাম। ভালোই ছিলাম তখন। গত এপ্রিলে অনেকের সাথে আমারও চাকরি চলে যায়। এরপর বায়েজিদের আর্দশ পাড়ার রহমান হোটেলে কাজ নেই। সেটাতেও অল্প টাকায় চলতাম। পরে লকডাউনেও দোকান বন্ধ করে দিতে হয় মালিককে। সেখান থেকেও কাজ হারাই।’ 

কেন ‘ক’ রিক্সা চালক হলেন এ প্রশ্নের উত্তরে ওই যুবক সিভয়েসকে বলেন, ‘এ লকডাউনে আর কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হোটেল-রেস্টুরেন্টও প্রায় বন্ধ। তাই বাধ্য হয়ে রিকশা চালাচ্ছি আপাতত। এটাতো কোন খারাপ কাজ না। দিনে রিকশার মালিককে ১২০ টাকা করে দেই। কোনদিন ৬০০ কোন দিন ১ হাজার টাকা। অনেক সময় একবেলা চালায়। সেদিন ইনকাম হয় ৩৫০/৪০০ টাকার মতো। মালিককে দেই ৬০ টাকা। আসলে আমি চাইলে বাড়িতে চলে যেতে পারতাম। আমি আগে বাড়িতে টাকা পয়সা পাঠাতাম। পরিবার থেকে টাকাগুলো নিয়ে করা ব্যবসাতে ক্ষতি হয়। এরপর আমার মধ্যে হতাশা চলে আসে। এখন বাড়িতে কোন টাকা পাঠাতে পারি না। তাদের থেকে দূরত্ব তৈরি হয়। তাই নিজে কিছু করার চেষ্টায় শহরে পড়ে আছি।’ 

ছবি বা নাম প্রকাশ না করার কারণ জানতে চাইলে করিম বলেন, ‘আমি আসলে চাই না। কোন কিছু ভাইরাল হলে এখন সবখানে ছড়িয়ে যায়। পরিচিতরা না দেখে মতো মাথায় গামছা দিয়ে চালাই। আপাতত রিকশা চালাচ্ছি। এটা আমার সাময়িক পেশা। লকডাউন উঠে গেলে এ পেশায় থাকার ইচ্ছা নেই। কয়েকদিন আগে রাস্তায় এক টিভি সাংবাদিক ছবি নিতে চেয়েছিল। তাকেও এ অনুরোধ করেছিলাম।’ 

বিয়ের পরে তার ভাবনা নিয়ে সিভয়েসকে বলেন, ‘হবু বউয়ের সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয়। বিয়েটা পারিবারিক সীমার মধ্যে সীমিত ও ছোট করে হবে। মেয়ের বাবা সৌদি আরব  থাকেন। তার সাথেও কথা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়ের বাবাকে বলেছি আমি চাকরি করি। কিন্তু এ চাকরি দিয়ে তো সামনে সংসারে নানা অভাব-অনটন থাকবে। তখন তিনি আমাকে আশ্বস্থ করে একটা পদক্ষেপের কথা আমাকে জানান। তিনি আমার পরিবার সম্পর্কে জানেন সবকিছু। আশাকরি আল্লাহর রহমতে তখন সমস্যা হবে না। সংসারটা ঘুচিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।’

-সিভয়েস/এইচবি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়