Cvoice24.com

১৯ শতাংশের রায় নিয়েই মেয়র রেজাউল 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৩:১১, ২৯ জানুয়ারি ২০২১
১৯ শতাংশের রায় নিয়েই মেয়র রেজাউল 

নব নির্বাচিত মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ২০১৫ সালের নির্বাচনে মোট ভোটারের ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশের রায় নিয়ে মেয়র হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীন। ঠিক ছয় বছরের মাথায় তার উত্তরসুরী হয়ে মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন এম রেজাউল করিম চৌধুরী। আওয়ামী লীগের এই প্রার্থীর পক্ষে রায় দিয়েছেন মাত্র ১৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোটার। বহুপ্রতীক্ষিত এই নির্বাচনে অবশ্য ভোট-ই পড়েছে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ ৭৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ ভোটার তাদের মেয়র নির্বাচন করতেই আসেননি। 

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভোটের প্রতি ক্রমেই মানুষের আগ্রহ কমছে। সর্বশেষ এই ভোটের হার নিয়েও রয়েছে অনেকের সন্দেহ। সে যাই হোক, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কমসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে এবার মেয়রের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে। সংঘাত-সংঘর্ষ প্রাণহানির মধ্য দিয়ে বুধবার অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৩ জন। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ১ হাজার ৫৩ ভোট। সেই হিসাবে বৈধ ভোট পড়েছে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯০টি। 

যেখানে মোট ভোটার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। কাস্টিং ভোটের হারে চোখ বুলিয়ে রেজাউল করিম চৌধুরী সুখনিদ্রায় যেতেই পারেন। কারণ ৮৩ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট-ই পড়েছে তার প্রতীকে। অন্যদিকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন পেয়েছেন ১২ দশমিক ০২ শতাংশ ভোট। মোট ভোটারের হারে সেটা কেবল ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। 

২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আরো বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল। সেবারের নির্বাচনে ভোট দেন ৫৫ শতাংশ ভোটার। তখন 'আনারস' প্রতীক নিয়ে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ১৪৫ ভোট পেয়ে মেয়র হয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম। 'জাহাজ' প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৭ ভোট। 

এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন এবং নারী ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন। মোট ভোটারের মধ্যে এবারে ভোট প্রয়োগ করেছেন মাত্র ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪১০ জন। এরমধ্যে বাতিল হয়েছে ১ হাজার ৫৩টি। প্রদানকৃত ভোটের হিসেব অনুযায়ী, এবারে ভোট পড়েছে মাত্র ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। 

২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে (চসিক) প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট দেন ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডের ভোটাররা। ২০১৫ সালেও ওই ওয়ার্ডে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে এবার সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়।

যদিও বিএনপির অভিযোগ, ‘অনিয়মের এ নির্বাচনে’ ভোটার সংখ্যা নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যের চেয়েও ছিল অনেক কম। ইসি, সরকার ও আওয়ামী লীগ— তিনপক্ষের কারচুপিতে ভোটারহীন নির্বাচনে সম্মানজনক ভোটগ্রহণ দেখানোর চেষ্টা করেছে তারা।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো বলছে, সিটি নির্বাচনে এতো কম ভোটারের উপস্থিতি আর কখনো দেখা যায়নি। এর আগে ২০১৫ সালের চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনেও ভোটগ্রহণের হার ছিল ৩৯ দশকি ৩২ শতাংশ। যদিও সেই সময়ে ব্যালেটে ভোট হয়েছিল। এবার হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। 

এবার এতো কম ভোট পড়ার কারণ জানতে চাইলে ভোটের পর বুধবার নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ আলমগীর বলেছিন, ‌‌‘ভোটারদের ভোটের প্রতি অনীহা এর একটি কারণ হতে পারে। এখনকার নাগরিকদের কেন যেন রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়িত্ব আছে, ভোট যে তার অধিকার— এটা তারা মনে করছেন না। কষ্ট করে ভোট দেব, কেন যাব অন্যকে ভোট দিতে, এতে আমার কী লাভ... এ ধরনের একটা মনমানসিকতা হয়ে গেছে তাদের মধ্যে।’ 

ইসি সচিব বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে বেশিরভাগ দেশে ভোটের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন হয়। আমেরিকায় দেখবেন, সবদিক দিয়ে এতো উন্নত তারা; কিন্তু ভোটের বেলায় ভোট দিতে যায় না বেশির ভাগ মানুষ। আমাদের দেশেও অনেকটা ওই রকমই; দেশ উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মানকিতা বদলে গেছে।’ 

সকারের এই আমলার কথা অবশ্য মানতে নারাজ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করেন, ভোট দেওয়ার ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন হচ্ছে উৎসবের মতো। আনন্দের সঙ্গেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে ভোট দিতে যান বেশিরভাগ ভোটার। এক দশক আগেও, বিশেষ করে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি ছিল সাড়া জাগানো মতো। আর সেই নির্বাচন দিয়েই রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। 

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি আগ্রহ কমছে। মানুষ ভাবছে, ভোট দেওয়া না-দেওয়া সমান। বিরোধী দলগুলোও গত কয়েক বছরের স্থানীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফল নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। আর এসব কারণে অনেক ভোটার এবার ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। 

তারা বলছেন, তরুণ ভোটারদের বড় একটি অংশ এবার ভোট দিতে কেন্দ্রে যায়নি। সংঘাতের ভয়ে নারী ভোটাররাও তেমন কেন্দ্রমুখী হননি। এছাড়া সরকারি ছুটি না থাকায় চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার লোকজনও ভোট দিতে যেতে পারেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভোটার বলেন, ‘ভোট দিতে যেতে অত আগ্রহ পাইনি এবার। কারণ আমরা জানি, আমি ভোট দিলেও যে নির্বাচিত হবে, না দিলেও সে-ই নির্বাচিত হবে। কেননা গত কয়েকটি নির্বাচন ধরে আমরা সেটিই দেখে আসছি।’ 

এদিকে ইভিএমে ভোট নিলেও নতুন এই পদ্ধতির বিষয়ে সেভাবে প্রচারণাও করেনি নির্বাচন কমিশন। এ কারণেও ভোটারদের মধ্যে এক প্রকার অনীহা কাজ করেছে। তাছাড়া বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার উপর মানুষের তেমন আস্থা নেই বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র থেকে বিরোধী এজেন্টদের বের করে দেওয়া, সংঘর্ষ, অনিয়ম, সহিংসতার শঙ্কা— নানা কারণেই ভোটার উপস্থিতি তলানীতে ছিল চসিক নির্বাচনে।

সেলিম উদ্দীন নামে নগরের এক ভোটার সিভয়েসকে বলেন, ‘ভোট দিতে আমি কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এসব দেখে ভোট না দিয়েই বাড়ি চলে আসি।’ 

পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব আরেক ভোটার বলেন, ‘গত কয়েকটা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোকজন অন্য দলের সমর্থক ও অপরিচিত ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি। যারাই গেছে তাদের প্রার্থীর স্লিপ নিয়ে। তাই এবার আর ঘর থেকেও বের হইনি।’ 

নিজ দলের বিশ্বস্ত ভোটার ছাড়া সাধারণ ভোটারদের পরিবহন সুবিধা দেয়নি প্রার্থীরা। ফলে পরিবহন সংকটের কারণেও কেন্দ্রে যেতে পারেননি অনেকে। কেননা কারও কারও বাড়ি থেকে ভোট কেন্দ্রের দূরত্ব এক থেকে তিন কিলোমিটারও বেশি। তাই পায়ে হেঁটে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আগ্রহ দেখাননি তারা। 

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মাঝে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হচ্ছেন না। এ বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর শারমিন মুরশিদ বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। তাই ভোটারদের কাছে এখন কোনো নির্বাচন নিয়েই আগ্রহ নেই। নির্বাচনী বা সুশাসনের যে ব্যবস্থা- এটা কিন্তু ধসে গেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে নির্বাচন হচ্ছে, তার প্রতি মানুষের আর এক বিন্দু আস্থা নেই। কারণ বিগত নির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে গিয়ে ভোট দিতে পারেননি। তো মানুষের ভেতরে এই বোধটা কাজ করছে যে, আমি ভোট দিতে যাব কিসের জন্য- আমাকে তো ভোট দিতে দেওয়া হবে না। এই আস্থাহীনতা ভোটার কমার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ 

চট্টগ্রাম জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ভোটকেন্দ্রকে শতভাগ নিরাপদ করতে না পারলে কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করা লোকজনও ভোট দিবেন না। এছাড়াও জনগণকে নিশ্চিত সঠিকভাবে কাউন্ট (গণনা) করার ব্যাপারে ভরসা অর্জন করতে হবে। এটা নিয়ে প্রায় ভোটারের মনে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছে। নির্বাচন নিয়ে চলমান এ দ্বন্দ্ব থেকে সর্বসাধারণকে একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। নয়তো এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা প্রকাশ পাবে।’

ভোটদানে ভোটারের অনীহা যে কারণে

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়