Cvoice24.com

চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধার মুখে ৭ মার্চের গল্প

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:২১, ৭ মার্চ ২০২১
চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধার মুখে ৭ মার্চের গল্প

কেক কেটে কর্মসূচির সূচনা করছেন সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন।

৭ মার্চ ১৯৭১। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাঙালী জাতিকে মুক্তির পথ দেখাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চারদিকে টান টান উত্তেজনা, চাপা আতঙ্ক। গ্রেপ্তার-নিপীড়নের শহরে পরিণত হয়েছিল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সমগ্র বাংলাদেশ। তবুও ৭ মার্চ ঢাকামুখী ছিল চট্টগ্রামের মুক্তিকামী সন্তানেরা। বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মত ফুঁসে উঠছিল স্বাধীনতা পাওয়ার আঙ্খাকা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে সেদিন সবার মত ঢাকামুখী ছিল চট্টগ্রামের সন্তান সেদিনের টগবগে যুবক; আজকের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুস।

রবিবার (৭ মার্চ) বিকেলে নগরের ডবলমুরিং থানা পুলিশের উদ্যোগে ৭ মার্চের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন অনুষ্ঠানে তার কণ্ঠে ওঠে এলো তখনকার ভয়াল চিত্র। নিজ মুখে তিনি শুনিয়েছেন—‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসি আব্দুল খালেক  কীভাবে করুণ মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার দায়ে সেদিন ওসি আব্দুল খালেককে পাকিস্তানি মিলিটারিদের গাড়ির পেছনে বেঁধে নিয়ে ঘুরানো হয়েছিল শহরে। রাস্তায় খসে পড়েছিল ওসি আব্দুল খালেকের মাংস। তার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সেদিনের লালদিঘী, আন্দরকিল্লা-নিউমার্কেট।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগে-পরে পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করে মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস বলেন, ‘৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এর পূর্বে পুলিশের কার্যক্রম ছিল এক ধরনের। কিন্তু ৭ মার্চের পরে পুলিশের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসি আব্দুল খালেক সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পুলিশের ব্যারাক খুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—তোমরা ব্যারাক থেকে সকল অস্ত্র নিয়ে যাও, যুদ্ধে প্রয়োজন হবে। পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন জানতে পারে কোতোয়ালীর ওসি মুক্তিবাহিনীর স্বপক্ষের লোক। তাকে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর গাড়ির পেছনে হাতে রশি বেঁধে টেনে হিছড়ে নিয়ে যায়। তাকে লালদীঘি-আন্দরকিল্লা হয়ে নিউ মার্কেট নিয়ে যাওয়া হয়। এতে তার শরীরের মাংস রাস্তায় খসে খসে পড়ে। তিনি এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, যদি আমার হাতে ক্ষমতা থাকতো আমি কোতোয়ালী থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত রাস্তাটাকে ওসি আব্দুল খালেকের নামে করে দিতাম।’

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুস।  ১৯৭১ সালে ওই সময়টুকুতে মুক্তিকামী বাঙালীদের চোখে মুখে ভাসছিল সেদিনে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুস তখনকার পরিস্তিতি বর্ণনা করে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আমি নয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করে মুক্তি পেয়েছি। তখন বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গোপসাগরের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মতো ফুঁসে উঠেছিল। সেদিন আমি আমার কারাবাসের দুর্দশার দিনগুলো ভুলে গেলাম। রাজপথে বেরিয়ে পড়লাম ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় পাকিস্তানের পতাকা দাউদাউ করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলাম। ৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মিছিল করেছিলাম। এর মধ্যে জানতে পারি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন।’

‘সেদিন মুক্তিকামী বাঙালি বিভিন্ন জেলা শহর থেকে ঢাকামুখী হয়েছিল। আমিও ৫ মার্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কোন জায়গায় বাসে কোন জায়গায় ট্রাকে কোন জায়গায় লঞ্চে করে ঢাকা পৌঁছালাম। এত মানুষ ঢাকা গিয়েছিল আমারা থাকার জায়গা পেলাম না। সার্জেন্ট জহুরুল হকের বাড়ির বারান্দায় মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলল। আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য ঠাঁই নিয়েছিলাম কোর্ট বিল্ডিং এর পেছনে লাল মন্দিরে। সেদিন স্বশরীরে উপস্থিত ছিলাম। নিজ কানে শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ।’—যোগ করেন মোহাম্মদ ইউনুস। 

এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। তিনি বলেন, ‌‘১৯৪৮ সাল থেকেই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি স্বাধীনতার মন্ত্র পাই। সেই মন্ত্রেই সশস্ত্র হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনে বাংলাদেশ।’ 

চট্টগ্রামের লালদিঘীর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রতি পাড়া মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে বলেন। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। ১৭ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিনই লালদিঘী মাঠে কমিটির কর্মসূচি পালন করা হতো।’

স্বাগত বক্তব্যে ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতার জন্য যেভাবে বাংলাদেশ পুলিশ রাজারবাগ থেকে প্রথম প্রতিরোধ গড়েছিল। একইভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, মানুষের জানমাল নিরাপত্তা রক্ষায়ও বাংলাদেশ পুলিশ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।’

ডবলমুরিং থানার উপ-পরিদর্শক কিশোর মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) পশ্চিম জোনের উপ-কমিশনার মো. আব্দুল  ওয়ারিশ। 

-সিভয়েস/এএ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়