Cvoice24.com

কেনা দামেও চামড়া কিনছে না আড়তদাররা, ফের বিপর্যয়ের শঙ্কা

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:১৬, ২১ জুলাই ২০২১
কেনা দামেও চামড়া কিনছে না আড়তদাররা, ফের বিপর্যয়ের শঙ্কা

২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি করা হয়েছে ২৪৫ টাকায়! অবিশ্বাস্য শুনালেও এই দরেই ১৫১টি ছোট-বড় গরুর চামড়া বিক্রি করেছে নগরের চান্দগাঁও থানার পূর্ব মোহরা আজিজিয়া মাদরাসা। গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার বাজারের দূরাবস্থা দেখে তাই যে দরে চামড়ার দাম দেওয়া হয়ছে সেই দামেই বিক্রি করে ঝুঁকিমুক্ত হয়েছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। তাদের বক্তব্য, এলাকার কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করে তা দুপুর ২টার মধ্যে বিক্রি করা হয়েছে গড়ে ২৪৫ টাকা দরে। এর আগের দু'বছর চামড়া বিক্রি হয়নি, তা ডাস্টবিনে ফেলতে হয়েছিল। তাই এবার সেই ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। 

শুধু কোরবানিদাতারাই কম মূল্যে চামড়া বিক্রি করছে তা নয়৷ মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও চামড়া কিনে টেনশনে। কেননা ২শ' থেকে ৩শ' টাকা দামে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া কিনলেও আড়ৎদাররা কেনা দামেও কিনতে রাজি হচ্ছে না। ফলে এবারও কি আগেরবারের মত রাস্তায় রাস্তায় পরে থাকবে কোরবানির পশুর চামড়া? 

বিগত কয়েক বছর ধরে লাভ না থাকায় অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে চামড়া ব্যবসায়। প্রতি বছর ঈদুল আজহা এলেই লাভের আশায় বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে চামড়া কিনে নেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। গত দু’বছর লাভের মুখ না দেখায় মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কেনা চামড়ার ঠাঁই মেলে নগরের রাস্তায়। এবারো সে একই লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।

নগরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গিয়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকায় কেনা চামড়া আড়তদাররা কিনতে চান ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা পর্যন্ত। কিছু কিছু বড় চামড়ার সর্বোচ্চ মূল্য উঠছে আড়াইশ’ টাকা পর্যন্ত। লোকসানে পড়লে এবারো রাস্তায় চামড়া ফেলে দেওয়ার কথা জানালেন অনেকই।

নগরের প্রধান চামড়ার আড়তগুলো নগরের আতুরার ডিপো এলাকায়। কোরবানি ঈদের দিন নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া এনে সেখানে বিক্রির জন্য আসেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। তবে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশি চামড়া বিক্রি হয় নগরের চৌমুহনী এলাকায়। 

প্রতিবারের মত আজ বুধবার দুপুরেও নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে আনা চামড়া এনে জড়ো করা হয় চৌমুহনীতে। তবে আড়তদারদের হাকানো দাম শুনে রীতিমত মৌসুমী ব্যবসায়ীদের মাথায় বাজ পড়ে। এদিকে বেড়েছে লবণের দামও। তবুও লাভের আশায় চামড়া নষ্ট না হতে লবণও দেন অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী। তবে আড়তদাররা চামড়ার যে দাম বলছেন তাতে লাভ তো দূরে থাক, কেনা দামটুকুও উঠছে না বলে অভিযোগ করেন তারা।

মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিগত তিন বছর ধরেই চামড়ার ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। লবণ না দিয়ে সময়ক্ষেপণ করায় চামড়া পচে যাওয়া, আড়তে ন্যায্য দাম না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বিগত বছরগুলোতে ময়লার ভাগাড়ে বা রাস্তার ফুটপাতে বাধ্য হয়ে চামড়া ফেলে দিতে হয়েছিল। এবার চামড়া নষ্ট না হতে অনেক ব্যবসায়ী নিজেরাই চামড়ায় লবণ দিয়েছেন। তবুও আড়তদাররা কেনা দামের অর্ধেক মূল্য দিতে চাইছেন। তাই গতবারের মত এবারো সড়কে চামড়া ফেলে নীরব প্রতিবাদের সুর বেজে উঠে অনেকের কথায়।

নগরের ঈদগাঁ এলাকার মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও গরুর চামড়া দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২০১৮ সালের পর থেকে চামড়ার দর নিচের দিকে নামতে থাকে। ২০১৮ সালে এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা, ২০১৯ সালে চারশ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে চামড়া। গত বছর ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা দিয়ে চামড়া কিনে মারাত্মক লোকসানে পড়তে হয়েছিল। এবার তো পরিস্থিতি আরো খারাপ। আমাদের কেনাই পড়েছে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা। অন্যদিকে আড়তদাররা চামড়ার সাইজ অনুসারে দাম বলছেন মাত্র ১শ’ থেকে সর্বোচ্চ আড়াইশ’ টাকা।

নগরের চৌমুহনী এলাকার আরেক মৌসুমী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আল আমিন সিভয়েসকে বলেন, ঘন্টার পর ঘন্টা চামড়া নিয়ে বসে আছি। দুইশ টাকার উপরে চামড়ার দাম দিতে চাইছেন না আড়তদাররা। তাদের মধ্যেই একটা সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। হয় লোকসান দিয়ে বিক্রি করব, না হয় ডাস্টবিনে ফেলে দিব। 

এদিকে আড়তদাররা বলছেন, তাদের এখানে কোন সিন্ডিকেট নেই। মূলত ঢাকার ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করছেন। ঢাকার পার্টিদের নির্দেশনা মোতাবেক চামড়া কিনছেন তারা।    

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়া খাতে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। আমরা সব সময় মৌসুমী ব্যবসায়ীদেরকে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে চামড়া কেনার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এরপরও তারা বাড়তি দামে চামড়া কিনেন। লবণের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা আমাদের ২৫ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে। সব মিলিয়ে আমরাও নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন। তবুও আমরা চেষ্টা করছি মৌসুমী ব্যবসায়ীদের উপযুক্ত দাম দেয়ার। 

প্রতিবছরের মতো এবারো আড়তদারদের কাছ থেকে ট্যানারি মালিকরা কত টাকায় কোরবানি পশুর চামড়া কিনবেন তা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বছর প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়ার দাম হবে ৩৩ টাকা থেকে ৩৭ টাকা, লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এদিকে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনের বিষয় তদারকির জন্য চট্টগ্রামে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী পাঁচদিন এই কমিটি তদারকির কাজ করবেন।

জানা গেছে, পাঁচ সদস্যের এ কমিটি কোরবানের পশুর চামড়ার ক্রয়-বিক্রয় এবং কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুতের বিষয়টি তদারক করবেন। তাছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তা সমাধান করবেন। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবহিত করাও দায়িত্বের মধ্যে পড়বে বিভাগীয় কমিটির সদস্যদের।

চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য গঠিত পাঁচ সদস্যের তদারকি কমিটিতে দলনেতা হিসেবে কাজ করবেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব লুৎফুন নাহার। এছাড়াও কমিটিতে রয়েছেন— চট্টগ্রামের আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নিয়ন্ত্রক মো. আবদুর রহিম, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ, আরজেএসসির উপনিবন্ধক হারুন অর রশীদ, টিসিবি আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী জামাল উদ্দিন।

১৯৪৮ সাল থেকে বন্দর নগর চট্টগ্রামে চামড়া ব্যবসায়ের বিকাশ ঘটে। লাভজনক ব্যবসার মুখ দেখায় চট্টগ্রামে ১৬টি ট্যানারি গড়ে ওঠে। কালের বিবর্তনে লোকসান গুণতে গুণতে প্রায় সব ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। বিগত পাঁচবছর আগেও চট্টগ্রামে সফলভাবে দুটি ট্যানারি চালু ছিল। এদের একটি মদিনা ট্যানারি ও অপরটি রিফ লেদার ট্যানারি। এ ট্যানারি দুটি ঢাকার ট্যানারিগুলোর সাথে তুমুল প্রতিযোগিতা দিয়ে আসছিল। কিন্তু বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় পাঁচ বছর আগে সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দেয় মদিনা ট্যানারি। তবে সংকটকালীন সময়েও লড়াই করে টিকে আছে রিফ লেদার নামের একটি ট্যানারি। চট্টগ্রামে সমিতিভুক্ত আড়তদারের সংখ্যা ছিল ১১২ জন। এর বাইরে আরও অন্তত ১৫০ আড়তদার ছিল। তবে লোকসানে পড়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেন ৭০ এরও বেশি আড়তদার। সবমিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে আছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়