Cvoice24.com

সরকারি কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ রক্ষার ঢাল ‘হেবা’

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২২
সরকারি কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ রক্ষার ঢাল ‘হেবা’

সরকারি কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ রক্ষার ঢাল ‘হেবা’

সিনহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার বরখাস্ত হওয়া পুলিশের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। যার শ্বশুরের কাছ থেকে হেবা মূলে চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা এলাকায় জমিসহ একটি ছয়তলা বাড়ি পান তার স্ত্রী চুমকি করণ। দীর্ঘদিন ধরে এটি ভোগ করে আসলেও আসল রহস্য উন্মোচন হয় গত বছরে। আলোচিত এ ওসি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলার পরই বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। মূলত পাথরঘাটার জমিসহ ভবনটির সব অর্থই ঢেলেছেন ওসি প্রদীপ নিজেই। অবৈধ অর্থ হওয়ায় তা জায়েজ করতেই প্রথমে শ্বশুরের নামে, পরবর্তীতে তা হেবা বা দানপত্র দেখিয়ে স্ত্রীর নামে করে নেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। দুইজনই এখন অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ভোগের আসামি। স্বামী জেলে আর স্ত্রী পলাতক। 

শুধু ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ক্ষেত্রেই নয়, চলতি মাসের ৩ জানুয়ারি পুলিশের আরেক আলোচিত লোহাগাড়ার সাবেক ওসি শাহাজানের বিরুদ্ধেও মামলা করতে গিয়ে স্ত্রীর নামে হেবা সম্পত্তির উৎস পাওয়া গেছে। যেখানে তিনি চাকরিরত অবস্থাতেই নগরের লালখান বাজারের হাইলেভেল রোডে ২ গণ্ডা ২ কানি জমি হেবা সূত্রে প্রাপ্ত হয় বলে দুদককে জানায়। কিন্তু তার দালিলিক কোন কাগজ পত্রই দেখাতে পারেনি পুলিশের এ কর্মকর্তা। শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধেও মামলা করে দুদক। 

গেল কয়েক বছরে দুদকের অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, অনুসন্ধানকৃত বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রেই হেবা বা দানপত্রের মতো সম্পদ অর্জন হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কারণ হিসেবে, দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, অবৈধ সম্পদ রক্ষা করতেই ‘হেবা কিংবা দানপত্র’কে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। যদিও তার সঠিক ব্যখ্যা ও দালিলিক প্রমাণ দেখাতে না পারায় ইতোমধ্যে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তাসহ সরকারি বেশকিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একই ঘটনায় মামলাও হয়েছে বহু। ইতোমধ্যে আরও পুলিশ কর্মকর্তার পাশাপাশি তাদের স্ত্রীদের বিষয়েও তদন্ত চলছে। 

এমন বাস্তবতায় দুর্নীতি প্রতিরোধ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন দিয়ে এসব দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন। সেক্ষেত্রে যারা এসব সম্পদ ভোগ করছেন তাদেরও সর্তক হতে হবে। তারা যদি স্বামীর আয় সম্পর্কে সচেতন না হয়ে সব কিছু ভোগ বিলাশে ব্যস্ত থাকেন পরে সামাজিক সম্মানহানির পাশাপাশি আইনের মুখোমুখি হতে হবে।

দুদকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগই হেবা সম্পত্তি উল্লেখ করা হয়। তারমধ্যে আলোচিত আরেক পুলিশ কর্মকর্তা পটিয়ার সাবেক ওসি রেফায়েত উল্লাহ। ২০১৬ সালে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ডিউ উদয়ন নামীয় একটি এপার্টমেন্ট ভবনের সাড়ে ৪শ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করে সেটিও তার আপন ভাই হাফিজ উল্লাহ চৌধুরী থেকে দান পাওয়ার বিষয়টি দেখানো হয় কাগজে-কলমে। কিন্তু ফ্ল্যাট কেনার অর্থের যোগান এবং এ সর্ম্পকিত প্রয়োজনীয় কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি সাবেক ওসি রেফায়েত উল্লাহ।

চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস এম এ আজিম। তিনিও একই ফন্দি আঁটেন অবৈধ সম্পদকে জায়েজ করতে। কিন্তু দুদকের জালে পড়ে মামলা জড়াতে হয় প্রধান কার্যালয়ের প্রকৌশলী আজিম ও তার স্ত্রীকেও। নিজের ছাড়াও স্ত্রীর নামেও বিভিন্ন সম্পদ ক্রয়ে বিনিয়োগ করেন সরকারি এ কর্মকর্তা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি এ দম্পত্তিরও। গেল বছরের জুনে তাদের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৭ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় মামলা করে দুদক।

একই কায়দা করে রক্ষা পায়নি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সোহেল রানা বিশ্বাসও। তিনি ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম কারাগারে দায়িত্ব পালন করাকালে নিজের বাবা থেকে ৩২ লাখ টাকা মূল্যের একটি জায়গা হেবা বা দানপত্র মূলে পান। অথচ তার অন্য ভাই-বোন থাকা সত্ত্বেও কেউই সমপরিমাণের জমি কিংবা সম্পত্তি অথবা অর্থই পায়নি। দুদকের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে আসে, মূলত কেন্দ্রীয় কারাগারে দায়িত্বপালন কালেই ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়েই ৩২ লাখ টাকার এ জমি ক্রয় করেন তিনি। যা ফন্দি করে তার বাবার নামে ক্রয় দেখিয়ে পুনরায় হেবা দলিলে নিজের নামে হস্তান্তর করে নেন সোহেল রানা। 

সরকারি কর্মকর্তাদের হেবা সম্পদের বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সিভয়েসকে বলেন, যে সকল সরকারি কর্মকর্তার অবৈধ আয় রয়েছে, তা নিজের নামে কখনই তারা কাগজে কলমে উল্লেখ করেন না। বেশিরভাগই স্ত্রীর নামেই থাকে। এছাড়া শ্বশুর, পিতা, মাতা, ভাই-বোন কিংবা বন্ধু-বান্ধবের নামে ক্রয় করে তা হেবা বা দানপত্র দেখিয়ে তখন নিজের বা স্ত্রীর নামে নিয়ে আসেন। যাতে করে তার উপার্জন ক্ষমতার বর্হিভূত না হয়। কিন্তু তাতেও তারা রক্ষা পায়না। 

দুদকের তদন্তে সংশ্লিষ্টরা দালিলিক প্রমাণ দেখাতে না পারায় তারাও মামলার আসামি হয়ে যায়। দালিলিক প্রমাণ না দেখাতে পারলে, তাতে স্পষ্ট হয়ে যায়, এসব সম্পদ অবৈধভাবে ক্রয় করা। আর বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তারাই এমন কাজ করে থাকেন বলে উল্লেখ করেন এ দুদক কর্মকর্তা। 

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী সিভয়েসকে বলেন, ‘অনেক নামী দামি নারী শুধুমাত্র স্বামীর অবৈধ সম্পদের কাগজে কলমে মালিক হতে গিয়ে আইনের আওতায় এসেছেন। অনেক স্বজনও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের এই ফাঁদে পা দেন। সেক্ষেত্রে যারা এসব সম্পদ ভোগ করছেন তাদেরও সর্তক হতে হবে। তারা যদি স্বামীর ইনকাম সম্পর্কে সচেতন না হয়ে সব কিছু ভোগ বিলাশে ব্যস্ত থাকেন পরে সামাজিক সম্মানহানির পাশাপাশি আইনের মুখোমুখি হতে হবে।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়