Cvoice24.com

রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের অজুহাত দেখিয়ে সমুদ্র সৈকতে ইজারা দিচ্ছে সিডিএ

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:০৮, ১৮ আগস্ট ২০২২
রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের অজুহাত দেখিয়ে সমুদ্র সৈকতে ইজারা দিচ্ছে সিডিএ

দুপাশে যত দূর চোখ পড়বে কেবল মানুষ আর মানুষ। কেউ ব্যস্ত সুসজ্জিত বাগানের ফুলে আবার কেউবা ব্যস্ত ছবি তুলতে। কেউ আবার আনমনে হেঁটে চলছেন ওয়াকওয়ে ধরে। কেউবা আবার একটু নিচে নেমে সমুদ্রের বালুচরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ওয়াকওয়ের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। চট্টগ্রামের নান্দনিক পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গেলে চোখ পড়বে এমন সৌন্দর্যের।  

তবে পরিবেশ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থার আপত্তির পরও নান্দনিক সমুদ্র সৈকতের একাংশ ২৫ বছরের জন্য ইজারা দিয়ে পর্যটন জোন করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এটি বাস্তবায়ন হলে সংরক্ষিত অঞ্চলে ঘুরতে যেতে দর্শনার্থীদের গুনতে হবে টিকিটের মূল্য। তবে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের অজুহাত দেখিয়ে নাগরিকদের পছন্দের এ  বিনোদন স্পটটি বাণিজ্যকরণে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম। গেল ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সৈকতের ইজারা বাতিলের দাবিতে সিডিএর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনটি। সংবাদ সম্মেলনে সিডিএকে চিঠি দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছিলেন তারা।

যদিও সিডিএর দাবি, সমুদ্র সৈকতে রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যবস্থাপনা দূর করে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে সৌন্দর্যবর্ধন করে গড়ে তুলতে সৈকতে এ  পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, জনগণের প্রবেশাধিকার জায়গায় সমুদ্র সৈকতে ইজারা দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই কাম্য নন।  এর ফলে দোকানপাট রেস্টুরেন্টসহ শত শত স্থাপনা নির্মাণ তথা বহুমুখী বাণিজ্য হলে এবং সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সিডিএ সূত্রে জানা যায়, সমুদ্র সৈকতের পতেঙ্গা অংশ থেকে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকায় হবে ‘পর্যটন জোন-১’। এর মধ্যে ৭০০ মিটার অংশ থাকবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। টেন্ডারের মাধ্যমে সেখানে অপারেটর নিয়োগ করা হবে। বাকি সোয়া পাঁচ কিলোমিটার সৈকত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে এর রক্ষণাবেক্ষণ করবে একই বেসরকারি অপারেটর প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া আকমল আলী রোড সংলগ্ন সৈকতের যে অংশটি সাগর থেকে ল্যান্ড রিক্লেইমের (জমি পুনরুদ্ধার) প্রক্রিয়ায় পাওয়া গেছে, সেখানকার ২৩ একর জমি নিয়ে করা হবে ‘পর্যটন জোন-২’। জোন-২ তে পর্যটকদের জন্য হোটেল-মোটেল-রাইডসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে এখনও বেরসরকারি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আগামী ৫০ বছরের জন্য এ পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে আগামী সপ্তাহে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গড়ে ওঠা অবৈধ  স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চালাবে সিডিএ।

সমুদ্র সৈকতে ইজারের বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সিভয়েসকে বলেন, আমরা যখন সমুদ্র সৈকতে কাজ করেছিলাম, তখন অনেক সুন্দর ফুলের বাগান ছিল। সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল, মানুষ হাঁটাচলা করতে পারতো। এখন সেখানে ট্রাক টার্মিনাল বসিয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা যততত্র দোকানপাট বসিয়ে ছয় কিলোমিটার ওয়াকওয়ে বন্ধ করে দিছে। মাফিয়া চক্ররা সেখানে জড়ো হয়েছে। এসব অব্যবস্থাপনা দূর করতে আমরা অপারেটর নিয়োগ করতে যাচ্ছি। সেখানে অপারেটররা হয়তো কিছু রাইড করবে, বাগান করবে, দর্শনার্থীদের জন্য টয়লেট থাকবে, পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকবে। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের তাদের বেতন দিতে হবে। সমুদ্র সৈকত এলাকায় আলোকসজ্জা না থাকায় দর্শনার্থীরা সন্ধ্যার আগে চলে আসছে। অপারেটরা সেখানে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করবে। তবে টিকিট দিয়ে মানুষ প্রবেশের কোনো এলাকা সংরক্ষিত করবো না। এখনও অপারেটরা আমাদের বিনিয়োগের জন্য প্রপোজাল দেয়নি। তাদের কাছ থেকে প্রপোজাল আসলে পরিবর্তীতে পরিকল্পনা ঠিক করা হবে। কিন্তু বিষয়টিকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে আমরা সংরক্ষিত এলাকা ২৫ বছরের জন্য ইজারা দিচ্ছে। 

এক প্রশ্নে সিডিএর এই প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ওয়াকওয়ে নির্মাণের সময় সৈকতে আগে দোকান করা ব্যবসায়ীদের পুর্নবাসন করা সম্ভব হয়নি। ওই জায়গাটি বঙ্গবন্ধু টানেল কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করেছে। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে ভবিষ্যতে আমরা সেখানে আরও ২০ একর জমি নিবো। চলতি বছরে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে এখানে (পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত) প্রচুর গাড়ির চাপ বাড়বে। অনেক মানুষের সমাবেশ ঘটবে। সেখানে আমরা পার্কিং স্পট করবো। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুর্নবাসনে দোকান করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। বিচের ওপর কোনো দোকান থাকা যাবে না।  

এ বিষয়ে কথা হয় সিলেট লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক জেরিন হোসেনের সঙ্গে। তিনি সিভয়েসকে বলেন, এখানে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট, আমরা এমন সিদ্ধান্তের বিরোধী করছি। জনগণের অবাধ প্রবেশের জায়গায় এভাবে তারা (সিডিএ) ইজারা দিতে পারে না। মানুষ কী বিশাল ওয়াকওয়েতে হাঁটার জন্য সমুদ্র সৈকতে যায়? এর আগে এখানে ট্যুরিজমের জন্য উচুঁ রোড করা হয়েছে, ওয়াকওয়ে হলো। এসব কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে এর পরিকল্পনা আগে করবে না। সেখানে পরিকল্পনা করে কিছু করতে গেলে এক ধরনের খরচ আর যথারীতি পাথর দিয়ে রাখলে আরেক ধরনের খরচ আসবে। সৈকতের মান উন্নয়নের জন্য হোটেল-মোটেল-রাইডসহ অনেক কিছু করা হবে। কিন্তু জনগণের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে কেনো এসব করতে হবে। আমাদের বক্তব্য হলো প্রয়োজন হলে আমি রাইডে যাব, গণশৌচাগার ব্যবহার করবো। এসব ব্যবহার করতে ইচ্ছে না হলে বাচ্চারা সেখানে খেলাধূলা করবে, মানুষ হেঁটে চলে আসবে। কিন্তু পর্যটন জোন করা হলে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা যাবে না।

সিডিএর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে মনোযোগ আর্কষণ করা হলে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিন হোসেন বলেন, পৃথিবীতে কেবল ইজারা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এমন কথা কই আছে। উনাদের আগে জানতে হবে অপেশাদারিত্ব কিংবা দুর্নীতির জন্য কত টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। জনগণের জন্য পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন তাদের মতামত নিবেন না। উন্নয়নকে আরও অর্থবহ করে গড়ে তুলতে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। 

একই অভিমত প্রকাশ করে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকোশলী সুভাষ বড়ুয়া সিভয়েসকে বলেন, সমুদ্র সৈকত লিজ দিলে সেখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ সংরক্ষিত হয়ে আসবে। এমন সিদ্ধান্তে থেকে সরে আসতে আমরা সিডিএকে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে। 

প্রসঙ্গত, পতেঙ্গা সৈকতের টানেল প্রান্ত থেকে রাশমণি ঘাট পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার অংশকে দুটি জোনে ভাগ করে ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা বাস্তবায়ন হবে ২০২৪ সালে।

সিভয়েস/আরকে

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়