বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অভিযান, ব্যবসায়ীরা বলছেন ‘না খেয়ে মরবো’
সিভয়েস প্রতিবেদক
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য রাত ৮টার পরে সারাদেশে দোকান, শপিং মল, মার্কেট, বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার খোলা না রাখার নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। সেই নির্দেশনা মানাতে এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আগস্ট মাসেই ১৪০ মামলায় ৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। তবে নিয়মিত জরিমানা গুনেও নগরের বিভিন্ন এলাকায় এ নির্দেশনা মানতে দেখা যায়নি ব্যবসায়ীদের। উল্টো সরকারি নির্দেশনাকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে চোর পুলিশ খেলছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের দাবি— তাদের বেচাকেনার সময় শুরু হওয়ার আগেই দোকান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের আয়রোজগার কমে গেছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রেক্ষাপটে খরচ বেড়েছে অনেক বেশি। এর ফলে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য দোকান বন্ধ রাখতে তাদের আপত্তি নেই জানিয়ে তারা বলছেন, এক্ষেত্রে কোন সময় থেকে কোন সময় পর্যন্ত দোকান বন্ধ রাখা হবে সেটি প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেই সবার জন্য উপকারে আসবে।
মঙ্গলবার ও বুধবার (১৬ ও ১৭ আগস্ট) রাতে নগরের প্রধান প্রধান সড়কের দুই পাশের অধিকাংশ দোকানপাট রাত ৮টার পর খোলা দেখা গেছে। তবে নগরের নিউ মার্কেট এলাকায় দেখা যায় উল্টো চিত্র। রিয়াজ উদ্দিন বাজার, তামাকুণ্ডি লাইন ও জহুর হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত সময় হতেই তাদের নিজস্ব জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে।
জহুর হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মানিক সিভয়েসকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অভিযান চলছে। তাই ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও রাত ৮টা বেজে যাওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কি করবো! যদি মামলা-জরিমানা দেয় তাহলে সেই টাকা পরিশোধ করবো কেমনে। সেই জরিমানার টাকা তো আমাদের জন্য বাড়তি একটা খরচ যোগ হবে। কেননা, সারাদিনে দোকান চালাতে যে খরচ হয়। তার অর্ধেকও আয় হয় না। মূলত যখন বেচাকেনা বাড়ে; তখনই দোকান বন্ধ করতে হচ্ছে। সারাদিনে আগে ১০-১২ হাজার টাকা মতো বেচাবিক্রি হতো। এখন ২ হাজার টাকা তুলতেও কষ্ট হয়।’
এদিকে রাত ৮টার পর শপিংমল ও এর আশপাশে লোকসমাগম কমে যাওয়ায় অনেকটাই বিপাকে পড়েছেন ভ্রাম্যমাণ দোকানিরাও। নিউমার্কেট মোড়ের একপাশে ভাসমান দোকানে জুতা, স্যান্ডেল বিক্রি করছেন ওসমান আলী। তিনি বলেন, ‘বিক্রি খুবই কম হচ্ছে। আমাদের তো সন্ধ্যার পর থেকে একটু বিক্রি বেশি হয়। দিনের বেলায় রোদের মধ্যে কাস্টমার তেমন একটা আসতে চায় না। আগে দিনে পাঁচ-ছয় হাজার বিক্রি হতো। এখন সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে।’
তার পাশেই বেল্টের দোকানি হোসাইনও জানিয়েছেন বেচাকেনা কমে যাওয়ার কথা। তিনি বলেন, ‘বেচাকেনা আগের মতো নেই। আগে রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে পারলেও এখন তো ৮টা বাজতেই বন্ধ করতে হচ্ছে। একদিকে সব জিনিসের দাম বাড়তি। তার উপর বেচাবিক্রি কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে চলাই কঠিন হবে।’
ব্যবসায়ীদের বলছেন, তাদের বেচাকেনার সময় শুরু হওয়ার আগেই দোকান বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। প্রশাসন যদি তাদের ব্যবসার কথা চিন্তা করে এবং বিক্রির নির্ধারিত সময়টুকু বিবেচনায় নিয়ে কোনো সিন্ধান্ত নিত তাহলে ভালো হতো। সারাদিন দোকান না খুলে তাদের যদি বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দিত তাহলে অন্তত ভালো বেচাবিক্রি হতো। কারণ, চাকরিজীবীদের অফিস ছুটির পরই সন্ধ্যার পর তারা মার্কেটে আসে। কিন্তু সেই সময়ে তাদের দোকান বন্ধের তোড়জোড় চলে। দিন দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। আর তাদের আয় রোজগার কমছে। প্রশাসনের উচিত তাদের রোজগারের বিষয়গুলোও মাথায় রাখা।
একইকথা বলছেন চট্টগ্রাম দোকান মালিক সমিতির সদস্যরাও। জহুর্স হকার্স মার্কেটের যুগ্ম সদস্য সচিব মো. ফজলুল আমিন সিভয়েসকে বলেন, ‘রমজানের ঈদের পর থেকে ব্যবসার অবস্থা খুবই শোচনীয়। তার উপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এরপর আবার আমাদের রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ। বিশেষ করে মার্কেটের কাস্টমারদের ১২টার আগে আসেও না। তাই কোনো দোকানদার এর আগে বেচাবিক্রি শুরু করতে পারে না। আমাদের ব্যবসায়ীদের দাবি, দরকার হলে দোকান দিনের ১২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকুক। আমরা দুপুর থেকে রাত ১০টা অবদি চালু রাখতে চাই। এটা আমাদের ব্যবসার জন্য এবং বেচাবিক্রির জন্য ভালো হবে।’
‘এখন সরকারের সিদ্ধান্ত আমরাও মানতে চাই। কিন্তু আমরা কি না খেয়ে মরবো?’ যোগ করেন ফজলুল আমিন।
প্রশসানের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে দোকান মালিক সমিতির সবাই মিলে আমরা বৈঠক করেছি। এছাড়া গত রোববার (১৪ আগস্ট) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ কমিশনার বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এখন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যেখানে দোকানের প্রতিদিনের সব খরচ ৫ হাজার টাকা হয়; সেখানে আয় হয় মাত্র ৮শ’ টাকা। ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। বেচাবিক্রি দিন দিন কমছে। আমরা এখন রাত ৮টার বদলে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলার রাখার ঘোষণার অপেক্ষায় আছি।’
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ১ আগস্ট ১৯ মামলায় ৫৪ হাজার টাকা, ৬ আগস্ট ২১ মামলায় ৪৫ হাজার ৫শ’ টাকা, ৮ আগস্ট ১৬ মামলায় ৮৮ হাজার টাকা, ১৩ আগস্ট ২০ মামলায় ৭৬ হাজার টাকা, ১৫ আগস্ট ৩৮ মামলায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫শ’ টাকা এবং ১৬ আগস্ট ২৬ মামলায় ৯৪ হাজার টাকাসহ মোট ১৪০ মামলায় ৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্লাবন কুমার বিশ্বাস সিভয়েসকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। অতিরিক্তি আলোকসজ্জা ও রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ করার নির্দেশনা থাকার পরও অনেকে মানছে না। তাই নিয়মিত তদারকিতে যারা নির্দেশনা মানছে না; তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।’
ব্যবসায়ীদের দাবি নিয়ে চিঠি পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তেমন কোনো চিঠি পায়নি। তবে দোকানের সময় নির্ধারণ করাটা জাতীয়ভাবে। তাই এটা সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত যেভাবে আসবে সেভাবেই আমাদের আদেশ মেনে চলতে হবে। সকলের উচিত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া এবং সরকারকে সহযোগিতা করা।’
উল্লেখ্য, গত ১৯ জুন সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’-এর ১৪৪ ধারার বিধান কঠোরভাবে প্রতিপালনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ইস্যুতে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত কার্যকরের কথা জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। সিদ্ধান্ত মোতাবেক, কেবল পচনশীল পণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সোমবার থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে সব ধরনের দোকানপাট রাত ৮টার পর বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে।
রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সিভয়েস/এমএম