Cvoice24.com

বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করেই মিতু হত্যা মামলায় পিবিআইয়ের চার্জশিট

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫:৪৮, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করেই মিতু হত্যা মামলায় পিবিআইয়ের চার্জশিট

মিতু হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের ডকেটভর্তি লাগেজ আদালতের প্রসিকিউসন শাখা জমা দেয় পিবিআই।

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারসহ সাত জনকে অভিযুক্ত করে মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার ২ হাজার ৮৪ পৃষ্ঠার চার্জশিট জমা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক চট্টগ্রাম আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় এ চার্জশিট জমা দেন।  

লাগেজভর্তি কেস ডকেটে ২ হাজার ৮৪ পৃষ্ঠার নথিপত্র রয়েছে। মূল অভিযোগপত্র নয় পৃষ্ঠার হলেও এর সঙ্গে দশ খণ্ডের নথি সংযুক্ত করা হয়েছে।

এসময় সঙ্গে যান মামলার তদারক কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মিতু হত্যা মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আমরা অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি। মামলায় বাবুল আক্তারকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে মামলাটি তদন্ত করেছি। আড়াই বছরের তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে সবরকমের তথ্যপ্রমাণ আমরা পেয়েছি তাদের আসামি করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।’

অন্যদিকে মিতু হত্যা মামলার কেস ডকেট গ্রহণ করে সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা এখনও কেস ডকেট পুরোপুরি দেখতে পারিনি। এখন আইন অনুযায়ী আমরা সেটা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠাব। আদালত সেটা সেশন জজ আদালতে পাঠাবেন। এরপর পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।’

অভিযোগপত্রে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে ; যিনি এই মামলার বাদী। অন্য ছয় আসামিরা হলেন— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলা, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া।

অন্যদিকে মিতু খুনের পর মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া চারজনকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দিয়েছে পিবিআই। তারা হলেন— মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু, নুরুন্নবী, রাশেদ ও গুইন্যা। এদের মধ্যে সাইদুল ও গুইন্যার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পায়নি আর হত্যাকাণ্ডের পর নুরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।

গ্রেপ্তার ভোলা, ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে মিতু হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। মামলার আসামিদের মধ্যে মুসা ও কালু পলাতক বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ মামলায় কারাগারে আছেন— বাবুল আক্তার, ওয়াসিম, শাহজাহান মিয়া ও আনোয়ার হোসেন। অন্য আসামি ভোলা জামিনে আছেন। 

হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই 'নিখোঁজ' আছেন কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা। তার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, মুছাকে হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৬ সালের ২২ জুন ‘প্রশাসনের লোকজন’ তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মিলছে না। মিতু হত্যা মামলায় মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে মোট ৯৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার, বাবুলের বন্ধু সাইফুলও আছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার জড়িয়ে পড়া নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তার স্ত্রীকে খুনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন লাখ টাকায় ‘খুনি’ ভাড়া করে স্ত্রীকে খুন করান। নিজেকে আড়ালে রাখতে প্রচার করেন— জঙ্গিরাই মিতুকে খুন করেছে। মিতুকে খুনের মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের ‘সোর্স’ মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। সঙ্গে ছিল আরও ছয়জন। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল মুসাকে ফোনে নির্দেশ দেন—গা ঢাকা দেওয়ার জন্য।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার। ২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয়— তদন্তে ঘটনার সঙ্গে বাদী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

একইদিন (১২ মে) দুপুরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার বাকি সাত আসামি হলেন— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু এবং শাহজাহান মিয়া।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা মামলার তদন্তভার যায় পিবিআইয়ের কাছে। শুরু থেকে মামলা তদন্ত করছিলেন পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা। তিনি খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বদলির পর পিবিআই পরিদর্শক একেএম মহিউদ্দিন সেলিম তদন্তের ভার পান। পরে সহকারী পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনিও বদলি হন পিবিআই থেকে সিএমপিতে। সর্বশেষ পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে মামলাটির চার্জশিট জমা দেন। মামলাটির তদন্ত তদারকের দায়িত্বে ছিলেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা।

নিহত মাহমুদা খানম মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন অভিযোগ করেছিলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবুল আক্তার। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর মিতুর সম্পর্কের অবনতি হয়। এর জের ধরে বাবুল আক্তারকে পরিকল্পিতভাবে লোক ভাড়া করে মিতুকে খুন করেন। তদন্তে মোশাররফের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পিবিআই।

মামলার আলামত হিসেবে উপহার পাওয়া বাবুল আক্তারের একটি বই জব্দের পর হত্যাকাণ্ডের জট খুলে। ২০১৩ সালে কক্সবাজার জেলা পুলিশে কর্মরত থাকার সময় বাবুলের সঙ্গে সেখানে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত গায়ত্রী অমর সিংয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গায়ত্রী বাবুলকে আহমেদ রশিদ রচিত ইংরেজি ভাষার ‘তালিবান’ নামে একটি বই উপহার দেন। ওই বইয়ের তৃতীয় পাতায় গায়ত্রী অমর সিংয়ের নিজের হাতের লেখায় এবং শেষ পাতা ২৭৬ এর পরের খালি পাতাটিতে বাবুল আক্তারের হাতে লেখা ইংরেজিতে তাদের ‘প্রথম সাক্ষাতের’ বিষয়সহ কিছু তথ্য লেখা আছে। 

গত ৭ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে বাবুল আক্তারের হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে পিবিআই নিশ্চিত হয় যে, বইয়ের পাতায় লেখাগুলো বাবুল আক্তারেরই।

গায়েত্রীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার কারণে বাবুল-মিতুর সংসারে শুরু হয় অশান্তি, দাম্পত্য কলহ। একই বাসায় আলাদা-আলাদা কক্ষে বসবাস শুরু করেন দু’জন। এর জেরে বাবুল আক্তার সিদ্ধান্ত নেন মিতুকে খুনের। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) বাবুল আক্তার তার বিশ্বস্ত সোর্স মুসাকে ‘কিলিং মিশনের’ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেন। বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুলের মাধ্যমে মুসার কাছে তিন লাখ টাকা পাঠানো হয়। সাইফুল আদালতে জবানবন্দিতে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

কিলিং মিশনে ছিলেন— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, শাহজাহান মিয়া, নুরুন্নবী ও রাশেদ। আর বাবুল আক্তারের নির্দেশে মুসাকে অস্ত্রের যোগান দিয়েছিল এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া।

 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়