Cvoice24.com

রাঙ্গুনিয়া বোয়ালখালীতে আত্মগোপনে ছিল হানিফ বাহিনী— গোয়েন্দা জালে আসলো যেভাবে

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:২৫, ২৩ নভেম্বর ২০২২

চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট ফাঁড়িতে হামলা করে ছিনিয়ে নেওয়া মাদক সম্রাট হানিফ পালিয়ে রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালীতে আত্মগোপন করে। সেখান থেকে পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে পালানোর পথেই মঙ্গলবার মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হয় হানিফসহ চার সহযোগী। পরে ছিনিয়ে নেওয়া আরেক আসামি মহিউদ্দিন শরীফকে বোয়ালখালীর খরণদ্বীপ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। দাঁড়ি চুল কেটে, বারবার স্থান বদল করে, নতুন মোবাইল-সিম পরিবর্তন করেও শেষ রক্ষা হয়নি হানিফ গংদের। তাদের গোয়েন্দা পুলিশের ঝালে ধরা পড়তেই হয়েছে।

গ্রেপ্তার অভিযানে থাকা সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের (বন্দর) এসআই রবিউল ইসলাম সোহেল সিভয়েসকে সে বিষয়ে দিয়েছেন বিস্তারিত বর্ণনা।

তিনি জানান, কালুরঘাট ফাঁড়িতে হামলার দিন রাতেই সিএনজি করে রাঙ্গুনিয়ার পোমরার একটি পাহাড়ি এলাকার কুড়ো ঘরে আশ্রয় নেয় হানিফসহ তার চার সহযোগী। সেখানে হিজড়া ইয়াসিনের বন্ধু আরেক হিজড়ার বাসায় আশ্রয় নেয় তারা। রাঙ্গুনিয়া যাবার পথেই তাদের সিম ও মোবাইল পরিবর্তন করে ফেলে তারা। রবিবার রাতে রাঙ্গুনিয়ার পোমরায় অভিযান চালায় ডিবির একটি টিম। তবে সেখানে তাদের নাগাল পায়নি ডিবি।

ডিবির টিম যখন খালি হাতে ফিরে আসে এর ঘণ্টা তিনেক আগে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে পোমরা থেকে বোয়ালখালীর ভাণ্ডারজুরিতে মহিউদ্দিন শরীফের বোনের বাসায় আত্মগোপন করে তারা। রবিবার, সোমবার ও মঙ্গলবার সেখানে অবস্থান নেয়। চুল দাঁড়ি কেটে চেহেরাতে আনা হয় পরিবর্তন। এরই মাঝে পোমরায় যে হিজড়ার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল তার কাছ থেকে হানিফের নতুন নম্বরের সন্ধান পায় ডিবি। এরপর তাদের অবস্থান নিশ্চিতে চেষ্টা চালালেও দু’দিনেও নাগল মেলেনি।

এরইমধ্যে মঙ্গলবার রাতে পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জে পালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় হানিফ গং। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে বাস স্টেশনে পাঠানো হয় অগ্রগামী দল! হানিফের দুলাভাই চুন্নুর দেওয়া তথ্য পেয়ে ভাণ্ডারজুরি থেকে রওনা দেয় তারা। যদিও এরআগে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে হানিফ পরিবহন, শাহী পরিবহন ও এস আলম বাসের টিকিট কাটে তারা। তারও আগে হানিফের দুলাভাই চুন্নুকে দুই ঘণ্টা আগে ঢাকার একটি বাসে পাঠানো হয় মহাসড়কে পুলিশের তৎপরতা অনুসরণ করতে। চুন্নু দুই ঘণ্টায় নিশ্চিত করে যে অলংকার থেকে মিরসরাই পর্যন্ত পুলিশের কোন চেক পোস্ট বসেনি।

এরপরই বাসে চড়ে বসে হানিফ ও তার তিন সহযোগী। কিন্তু গাড়িতে উঠা থেকে শুরু করে তাদের যাত্রাপথের পুরোটাই ডিবির নজরদারিতে ছিল। হানিফদের বাস যখন ভাটিয়ারিতে অবস্থান নিচ্ছিল তখনই ভাটিয়ারিস্থ সীতাকুণ্ড পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বের হয়ে সড়কেই অবস্থান নেয় সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানিক টিম। পরপর তিনটি বাসে তল্লাশি করতেই হানিফসহ তার সহযোগিদের গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর হানিফের দেয়া তথ্যে বোয়ালখালীর ভাণ্ডারজুরি ও ফাঁড়ি থেকে পলাতক অপর আসামি মহিউদ্দিন শরীফকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন— হানিফ (২৪), ইয়াসিন (২১), মহিউদ্দিন শরীফ (২৩), রেজাউল করিম (২০) এবং হৃদয় (২১)।

এর আগে, গতকাল সোমবার (২১ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মৌলভীবাজার রেললাইন সংলগ্ন এলাকা থেকে ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শরীফ রোকনুজ্জামানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া ওয়ারলেস সেটটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। 

উল্লেখ্য, গত ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় ৯ নম্বর পুলের গোড়ায় হানিফের বাসা থেকে চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই রোকনুজ্জামান মাদক কারবারি হানিফ ও শরীফকে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। আটকের কিছুক্ষণ পরই কালুরঘাট পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে হানিফ ও শরীফকে ছিনিয়ে নেয় তার সহযোগিরা। এসময় পুলিশের সঙ্গে হানিফ বাহিনীর সংঘর্ষ হলে হানিফের বোন নাজমা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং দুই পুলিশ সদস্যও আহত হন। এমনকি চান্দগাঁও থানার ওসিসহ সিএমপি থেকে অতিরিক্ত দাঙ্গা পুলিশ সেখানে গেলেও হানিফকে নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারেনি পুলিশ। 

এরপর মৌলভী বাজারের ৯ নম্বর পোল এলাকায় হানিফের ডেরায় ব্লক রেইড দিয়ে হামলার ঘটনায় জড়িত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিরা হলেন— রাব্বি ইসলাম রবিন প্রকাশ মনি হিজড়া (২২), ফরিদুল ইসলাম প্রকাশ সুন্দরী হিজড়া (২০),  বাদশা প্রকাশ ববিতা হিজড়া (১৮), আব্দুল জলিল (২০), দিল মোহাম্মদ (১৮), আব্দুর রহমান (১৮), আকলিমা আক্তার আঁখি (৩৫) ও মো. ইব্রাহিম (২৮)। 

চান্দগাঁও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পুলিশের ওপর হামলা, ফাঁড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় একটি এবং ইয়াবাসহ আটকের ঘটনায় আরেকটিসহ মোট দুটি মামলা করে পুলিশ। হামলা মামলায় এজহার নামীয় ১৪জন ও অজ্ঞাত ২১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে মাদক মামলায় হানিফ ও শরীফকে আসামি করা হয়েছে। আটক আটজনকে ইতোমধ্যে হামলা ও ভাঙচুর মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। 

এদিকে স্থানীয়রা জানান, ২০২০ সালের ১২ অক্টোবরের দিকে মৌলভী বাজারের ৯ নম্বর পোল এলাকায় মাদক ব্যবসার অভিযোগ পেয়ে হানিফকে আটক করে র‌্যাব সদস্যরা। এ খবর পেয়ে সড়ক অবরোধ করে সিনেমাটিক স্টাইলে তাকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে নেন হিজড়াদের একটি দল। হানিফের বাবা লোকমান, ভাই ইয়াছিন ও বোন নাজমা সবাই মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। মৌলভী বাজারের পোল বস্তিসহ মোহরা এলাকা মাদককারবার নিয়ন্ত্রণ করতে ইয়াছিন আরাফাতকে সুকৌশলে হিজড়া বানিয়েছে তার পরিবার। প্রতিদিন হিজড়া রুপ নিয়ে এলাকায় জোর করে টাকা তোলে ইয়াছিন। কেউ কিছু বললে সবার সামনে উলঙ্গ হয়ে মারধর করে। মানুষ বাধ্য হয়ে তাকে টাকা দেয়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জের বাসিন্দা হানিফ মোহরার ৯ নম্বর ও ৮ নম্বর রেল লাইন কেন্দ্রিক ইয়াবা-মদসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। এই কাজে হিজড়া নামধারী বিশাল বাহিনী রয়েছে তার। সরকারদলীয় কতিপয় নেতাদের ভাগ বাটোয়ারা দিয়ে দেদারসে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিল হানিফ। তার নামে মাদক-খুনসহ একাধিক মামলা থাকার পরও পুলিশের একাধিক অভিযানে সে ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশি অভিযানে তার সহযোগীরা আটক হলেও সে সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় রহস্যজনক কারণে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়