ডেঙ্গুতে যে বয়সের মানুষ বেশি মারা যাচ্ছে চট্টগ্রামে
শারমিন রিমা
অতিমারি করোনার পর দেশজুড়ে অনেকটা মহামারি রুপে আলোচনার জন্ম দিয়েছে ডেঙ্গু। বিশেষ করে চলতি বছরের শুরু থেকে; তাতে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রামও। আক্রান্ত কিংবা মৃত্যু দুটোতেই গত কয়েক বছরের রেকর্ডকেও ছাড়িয়েছে এই শহর। আক্রান্তের সংখ্যায় পুরুষরা এগিয়ে থাকলেও ডেঙ্গুতে পুরুষের তুলনায় নারী ও শিশুদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। একইসাথে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বেশি মারা যাচ্ছে শূন্য থেকে দশ বছর বয়সী এবং ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষ।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের গত ৯ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব জানা গেছে। এতে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ শিশু ও ৩৪ শতাংশ নারী। বাকি ৩১ শতাংশ পুরুষ। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার শূন্য থেকে দশ বছর বয়সী ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের। যা শতকরায় ৪৮ শতাংশ। বিশেজ্ঞরা বলছেন— ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হওয়া ৭৪ জনের মধ্যে শিশু ২৬ জন, নারী ২৫ জন, এবং পুরুষ ২৩ জন। চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে শিশুরা কম আক্রান্ত হলেও মৃত্যু বেশি। তারমধ্যে শূন্য থেকে দশ বছর বয়সী রয়েছে ১৮ জন যা মোট মৃত্যুর ২৪ শতাংশ। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী রয়েছে ১০ জন। এ বয়সী মানুষের মৃত্যুহার ১৪ শতাংশ। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী মানুষ রয়েছে ৮ জন যা মোট মৃত্যুর ১১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মৃত্যহার ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষদের। এ বয়সী মানুষ ছিল ১৮ জন। আর চট্টগ্রামে এ বয়সী মানুষদের মৃত্যুহার ২৪ শতাংশ। আবার ৪১ থেকে ৫০ বছরের ছিল ৮ জন ও ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষ ছিল ৮ জন যা মোট মৃত্যুর ১১ শতাংশ করে ২২ শতাংশ। ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী ২ শতাংশ ও সত্তরোর্ধ্ব মানুষের ডেঙ্গুতে মৃত্যু হার ছিল ৩ শতাংশ।
এদিকে, মৃত্যু হওয়া নারীদের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে আছে ৪ জন। ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে আছে ১৩ জন। ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে আছে ৪ জন এবং ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে আছে ৪ জন। অন্যদিকে, পুরুষ ২৩ জনের মধ্যে ১৮ বছর বয়সী ৩ জন, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৪ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৩ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৫ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী ৩ জন এবং সত্তরোর্ধ্ব রয়েছে ১ জন।
৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষ বেশি মারা যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ সিভয়েসকে বলেন, এ বয়সী মানুষেরা একটু বেশি একটিভ। দেখা যাচ্ছে তারা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে, কাজকর্ম করছে। হয়তো তারা একটু এক্সপোজ বেশি হচ্ছে যে কারণে আক্রান্ত হচ্ছে। দেখা যায় আক্রান্ত হলে তারা অবহেলাও করছে। সে কারণে এই বয়সীদের মৃত্যুহার বাড়ছে।’
কোন মাসে কত আক্রান্ত
সাধারণত ডেঙ্গুর পিক সিজন ধরা হয় আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে। কিন্তু ২০২০ সালে বছরের শুরু থেকে দুয়েকজন শনাক্ত হলেও সারাবছরে সে সংখ্যা ছিল কেবল ১৭ জন। কিন্তু গত বছরের জানুয়ারি থেকেই চট্টগ্রামে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়া শুরু হয়। গত বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু শনাক্তের হার ছিল ৫ হাজার ৪৪৫ কিন্তু এ বছরের প্রথম নয় মাসেই সেই সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি। ঢাকার পর চট্টগ্রামেই এ সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরের নয় মাসে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে পুরুষদের আক্রান্তের হার ৪৬ শতাংশ, নারীদের আক্রান্তের হার ২৮ শতাংশ এবং শিশুদের আক্রান্তদের হার ২৬ শতাংশ। তারমধ্যে জানুয়ারিতে ছিল ৭৭ জন। ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা কমে ২২ জন। মার্চে কেবল ১২ জন। পরবর্তী মাসে বাড়তে শুরু করে। সেসময় শনাক্ত হয় ১৮ জন। আবার মে মাস থেকে ধীরে ধীরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। ওই মাসে আক্রান্ত হয় ৫৩ জন। পরে জুন মাসে এ আক্রান্তের হার ৩ শতাংশ থাকলেও জুলাইয়ে এসে তা দাঁড়ায় ২৪ শতাংশে। অর্থাৎ ওই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ২ হাজার ৩১১ জন। পরবর্তীতে আগস্টে আরও প্রায় এক হাজার রোগী বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ শতাংশ এবং পরবর্তী মাসে (সেপ্টেম্বর) সেই সংখ্যাকে ছাড়িয়ে মোট আক্রান্তের হার ৪০ শতাংশ হয়েছে। যদিও আক্রান্তদের মধ্যে কোন বয়সের মানুষ বেশি রয়েছে সে তথ্য জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
কোন মাসে কত মৃত্যু
চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৭৪ জনের মধ্যে জানুয়ারিতে মারা যায় ৩ জন, ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। জুন থেকে বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যাও। সেসময় ডেঙ্গুতে মুত্যু হয় ৬ জনের। যা মোট মৃত্যুর ৮ শতাংশ। পরবর্তীতে জুলাই মাসেই মারা যায় আরও ১৬ জন। ওই মাসের মৃত্যু হার মোট মৃত্যুর ২২ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে আগস্ট মাসে। যা মোট মৃত্যুর ৩৮ শতাংশ। পরের ২১ জনই মারা গেছেন সেপ্টেম্বর মাসে। যা মোট মৃত্যুর ২৮ শতাংশ। যেখানে চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মৃত্যুর সংখ্যা গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ৭ গুণ বেশি। ২০২২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে মারা যান মাত্র ৩ জন।
চিকিৎসকরা কী বলছেন
ডেঙ্গুতে পুরুষের তুলনায় নারীরা কেন বেশি মারা যাচ্ছেন সেটি নিয়ে এখনো বৈজ্ঞানিক কোন গবেষণা হয়নি। তবে ডেঙ্গুতে নারী ও শিশুদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে চিকিৎসকেরা বলছেন, জেনেটিক কারণে নারীদের জটিলতা বেশি দেখা দেয়। আর এ কারণে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার হার বেশি। এছাড়া গর্ভাবস্থায় ও ঋতুস্রাবকালে কোন নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে। অন্যদিকে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ডেঙ্গুর লক্ষণ পরিবর্তন, দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসার কারণে শিশুমৃত্যুও বাড়ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ সিভয়েসকে বলেন, ‘ডেঙ্গুতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে শিশুরা। শেষ সময়ে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। বড়দের মত বাচ্চারা ওরার্নিং সাইন (গুরুতর লক্ষণ) প্রকাশ করতে পারেনা। শিশুদের ক্ষেত্রে সিভিয়ার ডেঙ্গু যেটাতে ফ্লুইড লিক হয়, ব্লিডিং হয় বা শকে চলে যায় তা ম্যানেজ করা খুবই জটিল।
তিনি আরও বলেন, ‘১১ বছরের কম বয়সী শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এক বছরের কম বয়সী শিশুরা আছে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। অভিভাবকরা স্বাভাবিক জ্বর মনে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেরিতে করাচ্ছেন। দেখা যায় শেষ সময়ে হাসপাতালে আনার কারণে অনেক শিশু মারা যাচ্ছে।’
নারী মৃত্যুর প্রসঙ্গে এ চিকিৎসক বলেন, অন্যান্য নারীদের চেয়ে গর্ভবতী নারীরা ঝুঁকিতে থাকে। আমাদের দেশের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে নারীরা তাদের যত্ন নেন। কিন্তু নিজে অসুস্থ হলে গুরুত্ব কম দেন। অসুস্থ হলে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন তারা। এসব কারণে হাসপাতালেও দেরি করে আসেন। দেরি করে আসলে ঝুঁকিতে থাকেন তারা।’
একই মন্তব্য চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বিরও। তিনি বলেন, ‘নারীদের মধ্যে দ্রুত চিকিৎসাসেবা নেওয়ার প্রবণতা কম। তারা নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা সচেতন না। যে কারণে আক্রান্ত হলেও খুব একটা পাত্তা দেন না। বেশিরভাগ নারী দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাই পুরুষের তুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নারীর মৃত্যু বেশি।’
সিভয়েস/এসএস