‘মা-বাপ’ ছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
মিনহাজ মুহী, সিভয়েস২৪
সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল। যেদিকে মন চায় উঠছে আর নামছে। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে চলছে ফটোসেশনও। কখনো কখনো উঠে পড়ছে বড় বড় লরি ট্রাকও। কোনো বাধা নেই। যেন ‘মা-বাপ’ ছাড়া! ৫ আগস্টের আগে ‘ভিআইপি’ চলাচল করা চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এমন হাল এখন।
হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়া হয় পরীক্ষামূলক যান চলাচলের জন্য। এর আগে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত না হলেও ভিআইপি চলাচল ছাড়াও সিডিএ কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ‘এক ফোনে’ ছাড়া পেত প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ নানা যানবাহন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিএনজি অটোরিকশা থেকে শুরু করে মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের গাড়ি যাওয়া-আসা করছে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে। এমনকি লালখান বাজার র্যাম্প দিয়ে উল্টো পথেও উঠে যাচ্ছে যানবাহন। রবিবার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের লালখান বাজারের র্যাম্পের মুখে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে উল্টোপথে যানবাহন আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে থাকা কয়েকজন নিরাপত্তাপ্রহরী থাকলেও তারাও ‘ক্লান্ত’ তাদের আটকাতে।
এসব রুখতে সদ্য নিযুক্ত সিডিএ চেয়ারম্যান নানা ‘তরিকা’ খুঁজলেও ‘ঘুমে’ রয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান। এসব বিষয়ে জানতে বিভিন্ন সময়ে ফোন করে, এমনকি কার্যালয়ে গিয়েও পাওয়া যায়নি তাঁকে।
সিডিএ চেয়ারম্যান বলছেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। ভবিষ্যতে টোল কর্তৃপক্ষের লোকজনই এসব সামাল দেবেন।’
রাতবিরাতে ‘প্রমোদভ্রমণ’
পরীক্ষামূলকভাবে উন্মুক্ত হওয়ায় রাতবিরাতে এক্সপ্রেসওয়ের দিকে ছুটছে মানুষ। মাঝপথে গাড়ি পার্কিং করে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার নিয়ে ছবি তুলছেন, গল্প করছেন, কেউবা হাঁটছেন। আর অন্য পাশে দ্রুতগতিতে দিগ্বিদিক ছুটছে বড় বড় ট্রাক, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা, এমনকি মোটরসাইকেলও। একটু বেখেয়াল হলেই ঘটে যেতে পারে বড় কোন দুর্ঘটনা।
এদিকে, সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ হলেও বেপরোয়া গতিতে উড়াল সড়ক পাড়ি দিচ্ছেন মোটরসাইকেল আরোহীরা। কোনো কোনো মোটরসাইকেলকে তিন থেকে চারজনকে নিয়ে চলতে দেখা যায়। এছাড়া বেশিরভাগ মোটরসাইকেল আরোহীরা মাথায় থাকে না হেলমেটও।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিয়ম না মানা এবং গাড়ি পার্কিং করে আড্ডা দেওয়ার বিষয়ে অবগত করা হলে সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। আর টোল নেওয়া হলে তাদের কিছু লোক নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বে থাকবে। এছাড়াও, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে এসব বিষয়গুলো দেখানোর জন্য অবহিত করা হবে।’
বিনা টোলে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
পরীক্ষামূলক যানচলাচলের মাধ্যমে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়া হলেও এখনো টোল আদায়ের নির্দেশনা আসেনি। সেই হিসেবে টোল না দিয়েই অবাধে উড়াল সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। এদিকে, ‘বিনা টাকায়’ সব ধরনের গাড়ি চলাচলে সুবিধা ভোগ করলেও দিনশেষে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
টোল আদায় ছাড়া গাড়ি চলাচলের কারণে সরকার রাজস্ব হারানোর কথা স্বীকার করে সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম বলেন, ‘এখন গাড়ি চলাচল করলেও শুধু টোল আদায় করা হচ্ছে না। আর কয়েকটা র্যাম্প বাকি আছে। মন্ত্রণালয়ে মিটিং হবে সেখানে টোল নেওয়ার (কখন থেকে নেওয়া হবে) বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘টোল চালু করতে দুই-তিন মাস সময় লাগবে। এসব নিয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিবে। সামনে (এ মাসে) আমাদের বোর্ড মিটিং হবে। বোর্ড মিটিংয়ে ঠিক করবো আমরা কত টাকার প্রস্তাব দিব। আর ওই প্রস্তাবনা হিসেবেই মন্ত্রণালয় থেকে ঠিক করা হবে।’
সিএনজি অটোরিকশা-ট্রেইলর চলাচলে নিষেধে ক্ষোভ
১৬ কিলোমিটা দৈর্ঘের এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রাইম মুভার ট্রেইলার (কনটেইনার পরিবহনকারী যান) চলতে পারবে না। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এসব গাড়ি চালাতে চাইলেও তাতে সায় দেয়নি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এতে সাধারণ মানুষের ব্যবহার নিশ্চিত যেমন শঙ্কায় পড়েছে ঠিক তেমনি প্রত্যাশিত টোল আদায় নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তকে ভুল বলেও আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কি গাড়ি চলবে, টোল কত—
চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, কার, জিপ, মাইক্রোবাস, পিকআপ, মিনিবাস, বাস, ট্রাক (৪ চাকা), ট্রাক (৬ চাকা), কাভার্ডভ্যান এবং ট্রেইলার গাড়ি চলাচলের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ বিষয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনা সভায় মোটরসাইকেল, ট্রেইলার ও সিএনজি অটোরিকশা এই তিন ধরনের গাড়ি বাদ দিয়ে টোলের হার চূড়ান্ত করা হয়।
সিডিএ সূত্র জানায়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করতে মন্ত্রণালয় কারপ্রতি ১০০ টাকা, জিপ ১০০ টাকা, মাইক্রোবাস ১০০ টাকা, মিনিবাস ২০০ টাকা, বাস ৩০০ টাকা, ট্রাক (চার চাকা) ২০০ টাকা ও কাভার্ডভ্যানের জন্য ৫০০ টাকা টোল নির্ধারণ করে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৪ নভেম্বর নগরের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করা হয়। তবে নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। চার হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের জুনে। তবে এখনো পুরোপুরি চালু না হলেও আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে যানচলাচল করছে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উড়াল সড়ক দিয়ে।