চিন্ময়কাণ্ডে আলিফ হত্যা
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আইনজীবী নেতার
সিভয়েস২৪ প্রতিবেদক
# সিএমপি কমিশনারের পদত্যাগ দাবি; নইলে টেনে হিঁচড়ে নামানোর হুঁশিয়ারি
# আসামিদের পক্ষে দাঁড়াবে না কেউ, ডিভিশন বাতিলের দাবি
চট্টগ্রামে ‘ইসকন নেতা’ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ঘিরে আদালত প্রাঙ্গণের ঘটনা ও আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী নেতা নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। পুরো ঘটনার পেছনে পুলিশের ইন্ধনও দেখছেন তিনি। চিন্ময়কে প্রিজনভ্যানে তোলার পর পুলিশের নিস্ক্রিয়তা, প্রিজনভ্যানে চিন্ময় দাসের হাতে হ্যান্ডমাইক কিভাবে গেল— তিনি তারও জবাব চেয়েছেন। আইনজীবী আলিফকে হত্যার সময়ে ‘জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে পর্যাপ্ত পুলিশ, আর্মি, বিজিবি ছিল’ উল্লেখ করে তাদের কেন ডাকা হয়নি তা নিয়েও প্রশ্ন রেখেছেন। এমনকি এসবের জন্য পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেছেন, নইলে টেনে হিঁচড়ে নামানোরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। তবে, নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজের দাবি—ঘটনার দিন পুলিশ পেশাদারিত্বের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) সকালে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার বিচার চেয়ে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে এসব প্রশ্ন রাখেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির শীর্ষ এ নেতা। আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ‘ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে এতে জেলা আইনজীবী সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, নিপীড়ন বিরোধী আইনজীবী সমাজসহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরাও যোগ দেন।
আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আজ অত্যন্ত শোকাহত এবং ভারাক্রান্ত আমরা। আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে আছি। আমাদের চট্টগ্রামের আদালত অঙ্গন ও আশেপাশে এ ধরনের ঘটনা আগে হয়নি। গত পরশু ইসকনের এক সন্ত্রাসী নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাকে আদালতে তোলার পর বিজ্ঞ আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন এবং প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো। আমরা পরবর্তীতে দেখলাম তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম। ওই প্রিজন ভ্যানে তোলার পর ইসকন সমর্থিত সন্ত্রাসীরা ভ্যান ঘেরাও করে আদালত অঙ্গনে উল্লাস করেছে। আমরা পুলিশকে দেখেছিলাম নিষ্ক্রিয়। তারা নিরাপদ স্থানে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। এটার পেছনে পুলিশের ইন্ধন আছে বলে আমরা মনে করি।’
পুলিশ প্রিজনভ্যান ফেলে সেখান থেকে চলে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, পুলিশ প্রিজন ভ্যান ফেলে সেখান থেকে চলে গেছে। আমি পত্রিকায় দেখেছি এই চিন্ময় দাস প্রিজন ভ্যান থেকে হ্যান্ডমাইক দিয়ে বক্তব্য দিয়েছে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি অনুরোধ করবো যতগুলো মামলা হবে এই চিন্ময় দাসকে যেন এক নম্বর আসামি করা হয়। যদি তাকে আসামি না করা হয় আমরা মানবো না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য দেশে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আন্দোলনের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। পুলিশের মধ্যে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রেতাত্মারা এখনো রয়েছে। আলিফকে যেদিন হত্যা করা হচ্ছে এই জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে পর্যাপ্ত পুলিশ, আর্মি, বিজিবি ছিল। তাদেরকে কেন ডাকা হয়নি?
পুলিশ কমিশনারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘চিন্ময় দাসের হাতে হ্যান্ডমাইক কিভাবে গেল— এর জবাব দিতে হবে। নাহলে পুলিশ কমিশনার চট্টগ্রাম থাকতে পারবেন না। আমরা পুলিশ কমিশনারকে চাই না। জুলাই ৩৬ এ অনেক রক্ত গিয়েছে। অনেকে শহীদ হয়েছে। তাদের রক্তের সাথে বেঈমানি করা যাবে না। আমরা সব জানি, চিনি। পুলিশ প্রশাসন এখনো বসে আছে। আপনাদের হুঁশিয়ার করছি, আপনারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করুন। আমরা গিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলবো না হয়।’
কোন ধারায় চিন্ময়কে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে জানতে চেয়ে আইনজীবী নেতা নাজিম উদ্দীন বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি চিন্ময় দাসকে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে। জেল কোডের নিয়ম এবং আইনের কোন ধারা অনুযায়ী আপনি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামিকে ডিভিশন দিয়েছেন? জেল সুপার এবং সিনিয়র জেল সুপারকে অনুরোধ করবো আপনি ডিভিশন প্রত্যাহার করবেন। তাকে সাধারণ কয়েদির সাথে রাখবেন। সে এমন কোনো ইম্পরট্যান্ট ব্যক্তি নয়। বিগত সরকারে আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে ডিভিশন না দিয়ে অসম্মান করা হয়েছে।’
আসামিদের পক্ষে না দাঁড়ানোর ঘোষণা
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহাদ মুস্তফা বলেন, ‘কেন প্রশাসন ওইদিন নিশ্চুপ ছিল আমি জানি না। কেন আমার ভাইকে সেদিন টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে একটা সন্ত্রাসী দলের জন্য আমি জানি না। আমার একটাই প্রতিজ্ঞা, আমি ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার এই ভাইয়ের খুনীর শাস্তির দাবি জানাই। আমার অ্যালামনাই থেকে আমাদের প্রিমিয়ারের কোনো ভাই খুনীদের পক্ষে কোনো আইনজীবী দিবে না।'
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা আমাদের ভাইকে হারিয়েছি। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের ১৮৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা এটি। আমার ভাইয়ের রক্তে আজ আমাদের ক্যাম্পাস লাল হয়ে গেছে। আমরা মানুষকে ইনসাফ দিই, অথচ আমরা আজ বে-ইনসাফের শিকার হয়েছি। আমরা তার দুই বছরের শিশুপুত্রকে কি জবাব দেব? আমরা তার অনাগত সন্তানকে কি জবাব দেব? সাইফুল হত্যার বিচার যতদিন হচ্ছে না ততদিন আমরা আইনজীবী সমাজ আমাদের অন্য কোনো ইরাদা নাই। অপরাধী ও তাদের প্রশ্রয়দাতা-ইন্ধনদাতাদের কোনো জায়গা চট্টগ্রামে আদালত ভবনে হবে না। আমার কালো কোর্টের ওপর, পেশার ওপর হামলা আমাদের কাম্য নয়। ভবিষ্যতেও কেউ যদি করে তাদের বিষদাঁত উপরে ফেলা হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী পরিবার এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের কোনোভাবেই সহযোগিতা করবে না। কেউ সহযোগিতা করতে আসলে প্রতিহত করা হবে।'
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। একইসাথে জঙ্গি সংগঠন ইসকনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পাশাপাশি হত্যাকারীদের পক্ষে আমরা যেন কেউ ওলাকতনামা না দিই আমি সেই অনুরোধ করবো সবাইকে। সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশর এই ব্যাপারে সকল সহযোগিতা করবে। আমরা সবসময় পাশে আছি এবং থাকবো।’
মানবন্ধনের একপর্যায়ে উপস্থিত আইনজীবীরা আগামী ৩ ডিসেম্বর চিন্ময় কৃষ্ণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে হওয়া মামলার শুনানি না করার দাবি জানান। আইনজীবী নেতৃবৃন্দও এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
উপস্থিত আইনজীবীরা এ সময় ‘ইসকনের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান', 'ইসকনের আস্তানা, জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’, 'সাইফুলের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না', 'ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, চিন্ময়ের ফাঁসি চাই' এসব স্লোগান দিতে থাকেন। মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল আদালত চত্বর হয়ে লালদিঘী মোড় ঘুরে ফের আদালত চত্বরে এসে শেষ হয়।
আইনজীবীদের কর্মবিরতি চলছে
এদিকে, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার প্রতিবাদে জেলা আইনজীবী সমিতির পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দ্বিতীয় দিনের মতো বৃহস্পতিবারও বন্ধ রয়েছে আদালতের কার্যক্রম। ঘোষণা অনুযায়ী, সকালে জেলা আইনজীবী সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
এর আগে, বুধবার চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক স্বাক্ষরিত এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার প্রতিবাদে ৬টি সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়৷
সিদ্ধান্তসমূহ ছিল—সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালোব্যাজ ধারণ, ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের সকল আদালতের কার্যক্রমে কর্মবিরতি, আইনজীবী আলিফের আত্মার মাগফেরাত কামনায় বৃহস্পতিবার বাদ জোহর কোর্ট হিল জামে মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন এবং একইদিনের অবকাশকালীন প্রীতি সমাবেশে বাতিল। এছাড়া ১ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় আইনজীবী দোয়েল ভবনের সম্মুখ থেকে শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হবে এবং সমিতির বার্ষিক ইনডোর গেইমস স্থগিত থাকবে।
`বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে মোকাবিলা করেছে'
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজের দাবি—ঘটনার দিন পুলিশ পেশাদারিত্বের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
তিনি সিভয়েস২৪'কে বলেন, ‘পুলিশ শুরু থেকেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে ছিল। এছাড়া বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতেও প্রস্তুত ছিল। গত পরশু সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে মোকাবিলা করেছে।'
সিভয়েস২৪/
- আলিফ হ/ত্যায় পুলিশের ইন্ধন দেখছেন আইনজীবী নেতা
- চিন্ময়কাণ্ড : আইনজীবী আলিফকে কু/পি/য়ে হ/ত্যা করা হয় যেখানে...