Cvoice24.com

আমি আজ রক্তের গৌরবে অভিষিক্ত...

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আমি আজ রক্তের গৌরবে অভিষিক্ত...

‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নিচে/যেখানে আগুনের ফুলকির মতো/এখানে-ওখানে জ্বলছে রক্তের আলপনা,/সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।/আজ আমি শোকে বিহ্বল নই,/আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই,/আমি আজ রক্তের গৌরবে অভিষিক্ত।/...যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে হত্যা করেছে,/যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্ত/মাতৃ সম্বোধনকে কেড়ে নিতে গিয়ে/আমার এইসব ভাইবোনদের হত্যা করেছে/আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি...।’

একুশে রক্ত ঝরেছিল ঢাকায় অথচ কবিতার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে তার অনুরণন উঠেছিল চট্টগ্রামে। সেইদিনই রচিত হয়েছিল মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। কবিতাটি দ্রুত রচিত হয়েছিল, প্রকাশিত ও প্রচারিতও হয়েছিল সমান গতিতে আর নিষিদ্ধ হবার গৌরবও লাভ করেছিল সঙ্গে সঙ্গে। 

মাতৃভাষা রক্ষায় ১৯৫২ সালে বাংলার বুকে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য ভালোবাসার এমন অনন্য নজির আর নেই। আজ সেই মহান ২১ ফেব্রুয়ারি, ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভাষা শহীদদের স্মরণে যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হয়। 

রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশের প্রথম প্রহরে সরাসরি পুষ্পস্তবক করতে পারেননি। তবে তাদের পক্ষে ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবরা।

১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও শাসকগোষ্ঠীর প্রভূসুলভ মনোভাবের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং ভাষার ভিত্তিতে বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন ‘মায়ের ভাষার’ মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নবপ্রেরণা। 

এরই পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ- ‘বাংলাদেশ’।

তবে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই গৌরবগাঁথা ক্রমেই ঔজ্জল্য হারাচ্ছে; ক্রমেই আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে মায়ের কোল থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। ভাষার দূষণ আর বিকৃতির সর্ববিস্তারি হানা উপড়ে ফেলতে চাইছে আমাদের শেকড়। 

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে আইন ও হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা বরাবরই উপেক্ষিত। এমনকি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারির পাশে আজও বাংলা তারিখ ৮ ফাল্গুন চালু হয়নি। উচ্চ আদালতে রায় প্রদানের ক্ষেত্রে এখনো ইংরেজির ওপরই নির্ভরশীল দু-একজন ছাড়া অন্যসব বিচারপতি।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়