Cvoice24.com

নারীবাদীদের কেন নেতিবাচকভাবে দেখা হয় বাংলাদেশে?

বিবিসি

প্রকাশিত: ১৬:৪০, ৮ মার্চ ২০২১
নারীবাদীদের কেন নেতিবাচকভাবে দেখা হয় বাংলাদেশে?

বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে নারীবাদ এবং নারীবাদের চর্চাকারীদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। অনেকেই একে পুরুষ বিদ্বেষ বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু নারীবাদ মানে কি আসলেই পুরুষ বিদ্বেষ? আর এই নেতিবাচক ধারণাগুলোই আসলে কেন এলো?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘বাংলাদেশে নারীবাদ সম্পর্কিত নানা ধরণের ভুল ধারণা আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, নারীরা শার্ট-প্যান্ট পরবে, নারীরা ছোট চুল রাখবে, সিগারেট খাবে, নারীরা পুরুষ বিদ্বেষী, নারীরা পরিবার বিদ্বেষী, বিয়ে বিদ্বেষী অন্যতম।’

এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, নারীবাদকে আসলে নারী-পুরুষসহ সব ধরনের বিষয় থেকে আলাদা করে দেখা হয়। এর আরেকটি ধারণা হচ্ছে, অনেকেই এটাকে মনে করেন যে, নারীবাদ হচ্ছে একটি পশ্চিমা জ্ঞান।

তিনি বলেন, ‘নারীবাদকে পুরুষ বিদ্বেষী বলার মধ্য দিয়ে এক ধরনের লেভেল তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয় যে, যারা নারীবাদী তারা আসলে পুরুষতান্ত্রিকতার বিপক্ষে নয় বরং পুরুষদেরকে বিপক্ষ হিসেবে দেখে। এই ভুল ধারণাগুলো যত বেশি চর্চিত থাকবে, তত বেশি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাটাই আরো জেঁকে বসবে।

নারীবাদীদের বিষয়ে পুরুষতান্ত্রিক এক ধরনের ‘অচ্ছুৎ ভাব’ আছে বলে মন্তব্য করেন ড. জোবাইদা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘মনে করা হয় যে, ওতো নারীবাদী- ও তো এরকম করবে, ওতো নারীবাদী- ও তো সেরকম করবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানা বলেন, ‘নারীবাদ নিয়ে যে ধারণার কথাগুলো শোনা যায় তার সবগুলোর সাথে শুধু নারীরাই জড়িত। মনে হতে পারে যে, নারীবাদ মানেই নারী। আসলে তা নয়। পুরুষরাও নারীবাদী হতে পারে।’ এগুলো ভুল ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করেন ড. সুলতানা।

নারীবাদ কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘নারীবাদ হচ্ছে লিঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রশ্ন তোলা। নারীবাদের মূল লক্ষ হলো নারী-পুরুষসহ সব ধরণের লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা।’

তিনি বলেন, ‘এখানে একটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। সেটা হচ্ছে পুরুষকে পুরুষতন্ত্রের সাথে এক করে ফেলা যাতে না হয়। পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র এক নয়। পুরুষ মানেই যেমন পুরুষতান্ত্রিকতা নয়, তেমনি নারীবাদ মানেই পুরুষ বিরোধিতা নয়। নারীরা যেমন নারীবাদী হতে পারে, তেমনি পুরুষরাও নারীবাদী হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নারীবাদ শুধু নারী বা পুরুষের অধিকারেরই যে সমতা চায় তা নয়। বরং নারীবাদে সম্প্রতি যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের সমতা বিধান যা ট্রান্স-ফেমিনিজম হিসেবে পরিচিত।’

নারীবাদ মানে হচ্ছে, সব লিঙ্গের মধ্যে জারি থাকা অসমতা ও বৈষম্যগুলো রয়েছে বা আলাদা করে দেখার ধরণগুলোকে নিয়ে প্রশ্ন করা এবং এগুলো যতভাবে যত দ্রুত কমিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে কাজ করে।

নারীবাদীদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা কেন?

নারীবাদীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ধারণার জন্য নানা রকম কারণ রয়েছে বলে মনে করেন ড. জোবাইদা নাসরীন। 

তিনি বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জেন্ডার বা লৈঙ্গিক সমতা নিয়ে ধারণা খুব বেশি স্পষ্ট নয়। ধারণা করেই নেয়া হয় যে, নারীরাই শুধু পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়, কিন্তু আসলে তা নয়। পুরুষরাও পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়। পুরুষতান্ত্রিক দাপট যেখানে থাকবে, সব লিঙ্গের মানুষেরাই সেখানে কম বেশি শিকার হবে।’

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন অনেক সময়ই জানা যায় যে, পুরুষরাও ধর্ষণের শিকার হন, যৌন নিপীড়নের শিকার হন, কিন্তু তারা সেটি বলছেন না পৌরুষদীপ্ততার কারণে।

কোন পুরুষ যদি তার যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা অন্যের সাথে শেয়ার করেন, তাহলে সমাজের চোখে তিনি হয়ে পড়বেন দুর্বল পুরুষ, সমাজের চোখে তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হবে এবং তাকে ‘হাফ-লেডিস’ বলা হবে- এসব কিছুই পুরুষতান্ত্রিক এক ধরণের বুলিয়িং। তাকে বুলিয়িংয়ের শিকার হতে হয়। আর এসব কারণেই একজন পুরুষ নিপীড়নের শিকার হলেও তা বলতে চান না।

‘নিপীড়নের কথা বলতে না পারার যে বড় খাঁচাটি, এই খাঁচার নামই পুরুষতন্ত্র। এই খাঁচা থেকে বের হওয়ার যে অভিপ্রায়, সেটিই হচ্ছে নারীবাদ।’— বলেন ড. জোবাইদা নাসরীন।

পুরুষতন্ত্র চায় না যে, লৈঙ্গিক সমতা আসুক। কারণ তাহলে পুরুষতন্ত্রের আরাম, আয়েশ, দাপটের জায়গা বা দমন নিপীড়নের কৌশল সেটি অনেকাংশেই কমে যাবে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীবাদের বিষয়টা হয়ে যাচ্ছে কি, যে আমরা যখন আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, আমাদের ইতিহাস, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের বাস্তবতা- এগুলোকে নিরিখে না রেখে, এগুলোকে আমলে না নিয়ে, যখন হঠাৎ করে নারীবাদী চর্চাকে সামনে আনতে চেষ্টা করি তখনই মানুষকে ভুল ধারণা দেয়ার বা মানুষ ভুল বোঝার একটা অবকাশ থাকে।’

তার মতে, এ কারণেই এখনো নারীবাদ ড্রয়িংরুমের আলোচনার বিষয়, নারীবাদ অনেক বেশি উচ্চমার্গীয় বিষয়, উচ্চশিক্ষিত মানুষের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে বলেন যে, ‘লোক দেখানো নারীবাদী’।

এ শব্দগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বেশি পরিচিত এবং প্রচলিত। একজন নারী হয়তো সিগারেট খেতে খেতে ছবি দেন বা শর্ট ড্রেস পরেন এবং বলেন যে তিনি নারীবাদী, তাহলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে।

বাংলাদেশের যে খেটে খাওয়া নারী যিনি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন, অন্যের বাড়িতে খেটে খাচ্ছেন যাদের জন্য নারী দিবসের সূচনাও, সেই শ্রমিকের রাজনীতি যদি বুঝি, শ্রমিকের সমতার জায়গা যদি বুঝি, তার শ্রমকে ঘিরে যদি টাকা উপাজর্নের মধ্য দিয়ে যদি অর্থনৈতিক মুক্তিকে খুঁজি তাহলে বাংলাদেশের নারীবাদের প্রতীক আসলে সেই শ্রমজীবী নারীরাই।

ড. উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানা বলছেন, নারীবাদ বা এর চর্চাকে আসলে বাংলাদেশে কখনোই ইতিবাচকভাবে দেখা হয়নি। তাই এই নেতিবাচক ধারণাগুলো যে আসলে কোন সময় থেকে শুরু হলো সেটিও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না।

তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে নারীবাদের ইতিহাস দেখলে দেখা যায় যে, আসলে এক সাথে কখনো নারীবাদ চর্চা হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বেগম রোকেয়া পর্যন্ত যারাই এ বিষয়ে কাজ করেছেন, তারা এক সময়ের ছিলেন না। সেসময় লোতে একদিকে যেমন নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ চলছিল, সেই সাথে নারীদের পড়তে নিরুৎসাহিতও করা হয়েছে, তাদের পোশাক-আশাক নিয়ে কটূক্তি বা তিরস্কারও করা হয়েছে। সেই সময়ের সাথে নারীবাদ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ার একটা যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

তবে তিনি বলেন যে, যারা নারীবাদ নিয়ে তেমন কিছু জানেন না বা চর্চা করেন না তারাই আসলে নানা ধরণের মন্তব্য করে থাকেন। এটা এক ধরণের নারী বিদ্বেষ বলে মনে করেন তিনি।

নারীবাদীদের পোশাকের বিষয়ে তিনি বলেন, নারীবাদের বিকাশ বা বিভিন্ন ধারার বিকাশ হচ্ছে পশ্চিমা সমাজে। তাই অনেক সময় সেটার সাথে মিলিয়ে ফেলতে বা পশ্চিমা নারীবাদীদের পোশাকের সাথে সাদৃশ্য টানার চেষ্টা থেকেও অনেক সময় এটি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।

তরুণ নারীবাদী লেখক ও সাংবাদিক শারমিন শামস, বাংলাদেশে নারীবাদ শব্দটা উচ্চারণ করে নারীবাদের চর্চা খুব বেশি দিনের নয়। বর্তমানে নারীবাদের চতুর্থ ধাপ চলছে। যার বড় একটা প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে অনলাইনে ফেমিনিজম চর্চা। এ কারণে নারীবাদ শব্দ হিসেবে মানুষের কাছে পৌঁছানো শুরু হয়।

বাংলাদেশের মানুষ বেশিরভাগেরই শিক্ষার হারের জায়গা কম। এছাড়া মৌলবাদ, ধর্মীয় অন্ধত্ব, গোঁড়ামির পাশাপাশি এক ধরণের রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী সংস্কৃতি রয়েছে যা ধর্ম এবং মানুষের অশিক্ষাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখতে। এর কারণেই মনের বিকাশ হয়নি, বলছেন মিজ শামস।

‘আর এ পরিস্থিতিতে যখন নতুন কিছু তত্ত্ব বা নতুন কিছু বিপ্লবের কথা বলে তখন সবাই সেটা নিতে পারে না। তখন একটা বিশেষ জায়গায় স্বার্থে আঘাত হয়েছে। এ কারণেই নারীবাদীদের সম্পর্কে এক ধরণের মনগড়া ধারণা তৈরি করা হয়, কথা ছড়ানো হয়।’

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন যে, বলা হয় নারীবাদীরা বড় টিপ পরে। এটা কেন বলে? কারণ, এক সময় সুলতানা কামাল বা খুশি কবীরের মতো নারীবাদীরা বড় টিপ পরতেন।

তার মানে এই নয় যে, নারীবাদীরা সবাই টিপ পরে। কারণ যে নারীবাদী না, সেও বড় টিপ পরতে পারে। কিন্তু এই বিষয়গুলো ধরেই নেয়া হয়েছে যে এগুলো নারীবাদীদের প্রতীক।

তিনি মনে করেন, এগুলো খুব কৌশলী পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। কারণ বাংলাদেশে ধরেই নেয়া হয় যে, টিপ হিন্দুয়ানী বা হিন্দু নারীরা টিপ পরে। কিন্তু এটা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ, হিন্দু নয়।

‘কিন্তু ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে যে, নারীবাদীরা ধর্ম মানছে না, তারা নাস্তিক, তারা সংসার করে না, তারা দেশের ঐতিহ্যবাহী নিয়মনীতির পরিপন্থী।’— তিনি বলেন।

তবে নারীবাদ আসলে তা নয় এবং এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে। শুধু নারী নয়, পুরুষ এবং অন্য লিঙ্গের কথাও বলে।

‘একটা শত্রু বাহিনী আছে যারা নারীবাদকে আটকাতে চায়। এটা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা।’— শারমিন শামস বলেন।

‘ভীতি থেকে আসে নেতিবাচকতা’

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, নারীবাদীদের নিয়ে যে নেতিবাচক বিভিন্ন মন্তব্য বা তাদেরকে একটা ছাঁচে ফেলে দেয়ার যে প্রবণতা সেটা শুধু বাংলাদেশে নয় বরং বিশ্বের বহু দেশেই দেখা যায়। যেমন আমেরিকায় মনে করা হয় যে, যারা নারীবাদী তারা ওয়্যাক্স করে না। তাদের হাতে পায়ে লোম থাকবে ইত্যাদি।

এই নেতিবাচক প্রবণতা মূলত ভীতি থেকে আসে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, পিতৃতান্ত্রিকতা যখন দেখে যে নারীরা কথা বলছে, তখনই তাদের মধ্যে এক ধরণের ভীতি কাজ করে যে, সেটি পিতৃতন্ত্রকে ভেঙ্গে দেয় কিনা।

‘মেয়েরা কেন কথা বলবে? মেয়েরা কথা বললে তো পিতৃতান্ত্রিকতার যেসব যন্ত্র আছে যেমন পর্দা, ঘরের মধ্যে থাকা যাকে বলা হয় মডেস্টি-এগুলো পেট্রিয়ার্কির যন্ত্র, এগুলোতো সরে যাবে, ভেঙ্গে যাবে।’— বলেন তিনি।

তার মতে, এসব ‘পেট্রিয়ার্কির যন্ত্র’ দিয়ে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যখন সেই নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার ভয় আসে, তখন এই ভীতি থেকে আসে ক্রোধ এবং নেতিবাচক মন্তব্য।

‘কারণ তারা মনে করে যে, এগুলো ঠেকাতে হলে যেসব নারীরা কথা বলবে তাদেরকে ডেমন বা দানব হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।’

তিনি বলেন, এ ধরনের চর্চা হঠাৎ করেই চলে যাবে না। কারণ, পুরুষের মতো সমান অধিকার পেতে হলে সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতার ভিতে যেভাবে আঘাত করা দরকার, যেভাবে লড়াই করা দরকার সেটি খুব শিগগিরই আসবে না। সেজন্যই এসব প্রচলিত ধারণাগুলো থাকবে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়