Cvoice24.com


‘আমাদের তুলনা হবে ভারত, চীন, ভিয়েতনামের সাথে; পাকিস্তানের সাথে নয়’ (ভিডিওসহ)

প্রকাশিত: ১৭:৪৫, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮
‘আমাদের তুলনা হবে ভারত, চীন, ভিয়েতনামের সাথে; পাকিস্তানের সাথে নয়’ (ভিডিওসহ)

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের বিশেষ সাক্ষাৎকার।ছবি: সিভয়েস

ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক সফল গভর্নর, সেই সাথে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ। অর্থনীতিকে যিনি বিশ্লেষণ করেন স্বচ্ছভাবে, এতোকিছুর বাইরে তার মধ্যে রয়েছে সাহিত্য রস-বোধ। রবীন্দ্র গবেষক হিসেবেও তার রয়েছে সুখ্যাতি। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। সম্প্রতি সিভয়েসের সাথে আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন দেশের অর্থনীতি, তারুণ্যের সম্ভাবনা, গ্রামীণ অর্থনীতি, নগরায়ন, শিল্পখাত, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যাংক খাত, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং বাংলাদেশের সম্ভাবনার তথ্য। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিভয়েস প্রতিবেদক তানভীরুল মিরাজ রিপন। সিভয়েসের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:

সিভয়েসঃ দেশের বর্তমান অর্থনীতিকে আপনার দৃষ্টিতে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ড. আতিউর রহমানঃ বাংলদেশের অর্থনীতি এখন এই মুহূর্তে অত্যন্ত স্থিতিশীল। এই বছর আমরা যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবো তা আট শতাংশের কাছাকাছি যাবে বলে আমাদের পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন। তিন বছর থেকে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে। গত ১০ বছরের গড় প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশেরও বেশি। যেটি পুরো চার দশকের ইতিহাসে এইভাবে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি কখনোই ছিলো না। 

সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিচারে এটা অনেকটাই স্থিতিশীল। অর্থনীতির অন্যান্য যে সূচকগুলো আছে ম্যাক্রো ইকোনোমিক সূচক, সেগুলো ইতিবাচক। যেমন, ইনফ্লেশন আমরা হয়তো প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো করলাম। কিন্তু ইনফ্লেশন বেশি হয়ে গেলো তাহলে ইনফ্লেশন প্রবৃদ্ধিকে খেয়ে ফেলবে। সেদিক থেকে আমাদের প্রবৃদ্ধি এখনো পজিটিভ। কারণ আমাদের প্রবৃদ্ধির যে হার ইনফ্লেশনের যে হার প্রায় তা ২.৫ বা ৩ শতাংশে পার্থক্য তার মানে আমরা পজিটিভ গ্রোথ করছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রবৃদ্ধি অনেক ইনক্লুসিভ অর্থাৎ এটা আমরা সবাই মিলে ভাগ করে নিচ্ছি। সাধারণত গ্রাম এবং শহরের মধ্যে যে পার্থক্য হয়, সম্প্রতিকালে আমরা লক্ষ্য করছি যে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক বেশি চাঙ্গা। গ্রামের মানুষ খেয়ে পরে আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। 

বরং শহরে দারিদ্র্য পরিস্থিতি খানিকটা তীব্র হচ্ছে। শহরে অনেক বেশি মানুষ চলে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জের কারণে শহরে বেশি মানুষ আসায় শহরের যানজটসহ অন্যান্য ম্যানেজমেন্ট নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। গ্রামে সে অর্থে স্বস্তির পরিবেশ আছে। সুতরাং অর্থনীতির বিচারে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল আছে। আমাদের এক্সপোর্ট বাড়ছে, ইমপোর্টও বাড়ছে। বরং ইমপোর্ট আর এক্সপোর্ট খানিকটা সমন্বয়ের সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে বাণিজ্য ঘাটতিতে, কারেন্ট এ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। সবকিছু বিচার করলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের অর্থনীতি বাড়ন্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সিভয়েসঃ গ্রাম মরে যাবে শহর কি বেঁচে থাকবে? যেমন এক সময় আপনাদের সময়কার এবং তার কয়েক দশক ধরে গ্রামের পৈতৃক ভিটে মাটি বেছে শহরমুখী হয়েছে এতে যে সামাজিক অবক্ষয়, দায়বদ্ধতার অবনতি ঘটেছে পাশাপাশি যে ব্যক্তি গ্রামের সবকিছু বিক্রি করে শহরে চলে এসেছে হয়তো একটা ফ্ল্যাট কিনলো কিন্তু তাদের সন্তানদের সেটি আর ভাগ করে রাখতে পারছেনা। এটিওতো অবক্ষয়। এটিকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

ড. আতিউর রহমানঃ আগের চেয়ে আমি মনে করবো যে গ্রামীণ পরিস্থিতি  খানিকটা ভালো। আগে গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো, গ্রামের মানুষের দারিদ্র্যতা অনেক বেশি ছিলো। ১৯৭২ সালে ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ গরীবই ছিলো। সে তুলনায়তো পরিস্থিতি অনেক ভালো। গ্রামের মানুষ এখন শহরের মানুষের মত অনেক সুবিধা পায়। গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা বলেই আজকে খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, মাছে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সবজিতে ভালো করছি, গ্রামীণ দারিদ্র্যতা কমছে। এখন আর গ্রামে এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না যার গায়ে জামা নাই, পায়ে জুতো নাই, শিক্ষা দীক্ষার কোনো সুযোগ নাই, স্বাস্থ্যের তেমন সুবিধে  নাই। এমন কোনো গ্রাম কিন্তু নাই। 

সুতরাং গ্রাম বাংলার চেহারা বদলে যাচ্ছে, গ্রামগুলো ধীরে ধীরে শহর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আগামী দিনের পরিকল্পনা থাকা উচিত। দক্ষিণ কোরিয়া যেমনটি করেছে, গ্রামটাকেও শহরে রূপান্তর করা। কিন্তু সেটা হয়তো একটা অঞ্চলের শহরের মতো বসবাস করবে গ্রামের মানুষ। বাকীটা গ্রামীণ পরিবেশ যেটা আছে সেটা বজায় রাখবে। সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা দরকার। বাংলাদেশ সরকার যে কাজটি খুব স্মার্টলি করছে সেটি হলো আগামী একশো বছরের ডেল্টা-পরিকল্পনা করছে, আমরা মূলত একটা ডেল্টা, একটা ব-দ্বীপ। একটা ব-দ্বীপে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। কারণ সভ্যতার সবচেয়ে বড় উৎস হলো নদী। নদী মরে গেলে সভ্যতা মরে যাবে। সুতরাং আমাদের গ্রাম বাংলাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে নদী যদি নষ্ট হয়। সেদিক থেকে সরকার কিন্তু উদাসীন নয়। আমি বলবো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করছে। 

শহরগুলো নিয়ে আমাদের অনেক কাজ করা বাকি, তুমি বলছো যে গ্রাম মরে যাবে শহরের জন্য। আমি বলবো উল্টো শহর মরে যাবে শহর থেকে মানুষ গ্রামে চলে যাবে। সেরকম একটা পরিবেশ তৈরি হবে। আজকের শহর কিন্তু বসবাস যোগ্য নয়, আজকে আমরা যে শহরে বসবাস করি, সেখানকার যে পরিবেশ এতোটাই চ্যালেঞ্জিং যে এই শহরে আসলেই এমনিতে বেঁচে থাকা মুশকিল। আমাদের রাস্তা ঘাটগুলো এতো সরু, সেখানে এতো গাড়ি, সেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট  সমস্যা এগুলোকে মোকাবেলা করে যদি স্মার্ট শহর না করতে পারি তাহলে শহরের চেয়ে গ্রামে মানুষ যেতে বেশি পছন্দ করবে। 

আমার নিজের ধারণা, আগামী দিনগুলোতে বড় বড় শহর যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম এরকম শহর থেকে বরং উপশহর বেশি হবে যেখান মানুষ সকালে এসে কাজ করে সন্ধ্যেবেলা ফিরে যাবে। রেল কানেকশন হবে, নদী কানেকশন হবে। এমন সব চমৎকার কানেকশন করতে হবে যাতে এই শহরগুলোর ওপরে সকল চাপ সৃষ্টি না হয়। সত্যি সত্যি আমাদের জেলা শহরগুলোতে একটা হাব করতে হবে। আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের একটা কেন্দ্রবিন্দুতে তৈরি করতে হবে। সেটা যদি করা যায় তাহলে এই শহরগুলোর ওপর চাপ কমবে। তখন শহরও বাঁচবে, গ্রামও বাঁচবে। শহর আর গ্রামের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন যে “শহরের একটা দরজা খোলা রাখতে হবে গ্রামের জন্য।” আমরা সেই শহরই চাই যেখানে গ্রামের সমস্ত সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে এবং গ্রামে শহরের সমস্ত সুবিধাগুলোও পাওয়া যাবে। যদি এমন হয় যে গ্রামের সকল সম্পত্তিগুলো যদি শহরে এসে জমা হয় তাহলে কিন্তু গ্রাম সত্যি সত্যি মরে যাবে। আজকের পরিস্থিতি কিন্তু তা না, বাংলাদেশে তার উল্টো ঘটছে, তিদিন শুধু ঢাকা শহর থেকে ১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা শুধু মোবাইল ব্যাংকিং এ গ্রামে যাচ্ছে। সে জন্য গ্রামের চেহারা বদলে যাচ্ছে। 

গ্রামের মানুষ এতো উৎপাদন করছে যে গ্রাম শুধু খেয়ে পরে বেঁচে নেই আমরা শহরের মানুষও সবজি পাচ্ছি, মাছ পাচ্ছি, দুধ পাচ্ছি। এবছর দেখো কুরবানি ঈদে আমাদের বাইরের দেশ থেকে গরু আনতে হয়নি, আমাদের গ্রামে সে সকল গরু উৎপাদন হয়েছে, আমরা সবাই সেই সুবিধা পেয়েছি। সুতরাং গ্রাম এবং শহর উভয় মিলে একটা সমন্বিত রূপে এগোতে হবে।

সিভয়েসঃ বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট বিষয়-ভিত্তিক সম্মান কোর্স চালু আছে। অথচ তারপরেও একজন ইইই পড়া ছাত্র- ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে না গিয়ে কেনো প্রশাসন ক্যাডার হয়? তাহলে, লোক প্রশাসন বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় কেনো? 

মাইক্রোবায়োলজি পড়া ছাত্র কেনো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়া ছাত্র থাকতে পররাষ্ট্র ক্যাডারভুক্ত হবে? এটা আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্ম ব্যবস্থা আমাদের অর্থনীতির বিরাট ভূমিকা রাখে। সামঞ্জস্য রাখাটা উচিত কিনা?

ড. আতিউর রহমানঃ আসলেই তোমার এই কথাতে আমি একমত এখনকার শিক্ষা-ব্যবস্থায় আমরা যেটা দাঁড় করিয়েছি সেটা জীবনের খাদ্য নয়। এই শিক্ষা আমাকে, জীবনকে পরিপূর্ণ করছে না। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলেছেন। "আমরা কি শিখবো?, আমরা কি হবো?" এই দুটো জিনিস একেবারে গায়ে গায়ে সংলগ্ন। আমরা যা হতে চাই আমাকে শিক্ষা কি তাই দিচ্ছে? 

আমরা সেরকম শিক্ষা পাচ্ছি না। বরং মুখস্ত করে, ডিগ্রি দিয়ে এমন সব শিক্ষা দিচ্ছি যে শিক্ষা জীবন থেকে বহুদূরে। সে কারণে আমরা লক্ষ্য করছি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি। তারা যে শিক্ষা নিচ্ছেন, তুমি যেটা বললে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা নিয়ে তারা নিজ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান খুঁজে পাচ্ছেন না। খুঁজে পাচ্ছেন না বলেই দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এতো বেশি। তারা সকলে প্রশাসনে যেতে চাচ্ছে, কারণ প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা বেশি। 

প্রশাসনে একবার ঢুকলে পরে তার জীবনটা শেষ পর্যন্ত খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতো একটা সুযোগ আছে। আমাদের অন্যান্য ক্ষেত্রে এমন সুযোগ তৈরি হয়নি, যেমন মাইক্রোবায়োলজিতে যিনি ভালো করছেন তার জন্য আমরা একটি ভালো ল্যাবরেটরি বাংলাদেশে গড়ে তুলতে পারিনি। সে কাজটা কোথায় পাবে? আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যে ধরনের গবেষণা হওয়া দরকার তা কিন্তু নেই, প্রত্যেক ইন্ডাস্ট্রিতে আর এন ডি (Rnd)  থাকা দরকার। 

যদি তাই থাকে তারা সে ল্যাবগুলোতে গিয়ে তারা কাজ করতে পারতো। তো, আমাদের সেরকম শিল্পই গড়ে উঠেনি। আমাদের প্রধান শিল্প হলো গার্মেন্টস, তারপরে চামড়া, এরপরে সিরামিকস। এই যে কয়েকটা মাত্র শিল্প, এই শিল্পগুলোতে আমরা যাদের তৈরি করছি তাদের সবাইকে তো প্রোভাইড করতে পারছে না। বরং এই শিল্পের জন্য যে আমাদের মধ্যম লেভেলের ব্যবস্থাপক দরকার, যে ইঞ্জিনিয়ার দরকার, যে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার দরকার সে পরিমাণ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার আমরা তৈরি করছিনা। আমি কয়েকদিন আগে তেজগাও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বক্তৃতা করতে গেলাম, ভাইস চ্যান্সেলর বললেন স্যার আপনারা বেকারত্বের কথা বলেন। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েটও নাই বেকার। 

অর্থাৎ তার চাহিদা এতো বেশি যে তারা সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ারে উঠলে তাকে চাকরি দেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পরে। অথচ আমরা এমবিএ তৈরি করছি কিন্তু তাদের ডিম্যান্ড নাই। আমরা তাদের সমন্বয়টা করতে পারছি না। ৬ বিলিয়ন ডলারের মতো আমরা খরচ করি শ্রীলঙ্কা, ইন্ডিয়া থেকে বিদেশি ব্যবস্থাপক আনার জন্য। আমাদের এই গার্মেন্টস শিল্প পরিচালনা করার জন্য। অথচ গার্মেন্টস শিল্পের জন্য যে ব্যবস্থাপক দরকার, যে ইঞ্জিনিয়ার দরকার সেগুলো আমরা তৈরি করছিনা। সুতরাং আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার এই যে অসামঞ্জস্যতা সেটাতো রয়েই গেছে। শিক্ষাকে জীবনের খাদ্য হিসেবে তৈরি যতদিন না করতে পারছি এই যে সংকটটা সেটা থেকেই যাবে।

সিভয়েসঃ বাংলাদেশে বেকারত্বের সংখ্যা ২৬ লাখ তার মূল কারনটা কি? এবং কাস্টমসে যে সিভি জমা পড়ে তার চেয়ে কম জমা পড়ে  ডাক বিভাগে কেনো?

ড. আতিউর রহমানঃ সমস্যা হলো আসলে চাকরি দিয়ে বেকারত্ব দূর সম্ভব না। সরকারি চাকরি দিয়ে বেকারত্ব দূর সম্ভব না। আমাদের একটা উপায় হলো আমরা শিক্ষা দিবো উদ্যোক্তা হবার জন্য। যদি উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারি, তাহলে একজন উদ্যোক্তা আরো তিন জন বা চার জনকে চাকরি দেবে। তাহলে উদ্যোক্তা যতি বেশি তৈরি করবো তত বেশি চাকরি তৈরি হবে। আমি একটা উদাহরণ দিই, যেটা ছোট্ট উদাহারণ, মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা এজেন্ট ব্যাংকিং আমরা যেটা চালু করেছি প্রায় নয় লাখ এজেন্ট এখন বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। 

সেন্ট্রাল ব্যাংকের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে। নয় লাখ এজেন্ট প্রত্যেকে যদি তিন জন করে চাকরি দেয়  তাহলে ২৭ লাখ চাকরি কিন্তু তৈরি হয়ে গেছে। এটা সরকারি চাকরি না। এরা সব প্রাইভেট, এরা মানুষকে সেবাও দিচ্ছে, আবার চাকরিরও ব্যবস্থা করছে। আমরা এরকম শিক্ষা চাই যে আমাদের ছেলেমেয়েরা একেকজন উদ্যোক্তা হয়ে বের হবে আমাদের কয়েক লাখ নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়ে গেছে। ইকমার্সের মাধ্যমে, এফ কমার্সের মাধ্যমে। এই মেয়েরা আরো অনেক ছেলেমেয়েদের অ্যাপয়নমেন্ট দিচ্ছে, পণ্যটাকে পৌঁছে দিতে হচ্ছে, পণ্যটাকে প্যাকেজ করে দিতে হচ্ছে, পণ্যটার বিজ্ঞাপন তৈরি করতে হচ্ছে, সব মিলে এই উদ্যোক্তারা আমাদের কর্মসংস্থানের যে বিপুল বিস্তার সেটা কিন্তু এই উদ্যোক্তারা তৈরি করছে। সুতরাং আমাদের উদ্যোক্তা তৈরির কাজ করতে হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি মনে করি যে বিষয়টি পড়ুক না কেনো, বিকেল বেলা তারা যেনো একটা ইনোভেশন হাব বা ইনোভেশন সেন্টারে আসতে পারে সেখান থেকে তারা কি করে উদ্যোক্তা হওয়া যায়, কি করে একজন শিল্পপতি  হওয়া যায়, কি করে একজন ব্যবসায়ী হওয়া যায়, কি করে একজন বিজ্ঞানী হওয়া যায়  এই যে প্র্যাক্টিকেল কনসেপ্টগুলো যেনো তৈরি হয়। এমন কিছু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া দরকার। যেকোনো কারণে হোক আমরা কিন্তু এমন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারছিনা। যেমন বিজিএমইএ তারা একটা ফ্যাশন এবং টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে, তাদের ছেলেমেয়ে কিন্তু বেকার নাই। 

সুতরাং আমরা উপযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উচ্চ শিক্ষা তৈরি করতে পারছিনা। আমাদের বেকারত্বের ঘটনাটি ঘটছে কিন্তু প্রযুক্তিহীন শিক্ষা থেকেই। আমাদের যে টেকনিক্যাল এডুকেশন,, যারা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, এরকম গ্র্যাজুয়েট মাত্র তিন শতাংশ। সবগুলো গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ওরা তিন শতাংশ। এরা কিন্তু প্রত্যেকে চাকরি পাচ্ছে। আমরা ওরকম শিক্ষা কেনো দিচ্ছিনা? উল্টো শিক্ষা দিচ্ছি কেরানি বানানোর জন্য, সাহেব বানানোর জন্য। সে শিক্ষায় তো চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এই কারণে বেকারত্বের ঘটনা ঘটছে।

সিভয়েসঃ এক্ষেত্রে যে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মননশীলতা নিয়ে কেমন ভাবছেন? যে প্রযুক্তিকেন্দ্রীক অনেক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়?

ড. আতিউর রহমানঃ এটাও শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। আমি শিক্ষার ওপর মাধ্যমে যদি বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করতে পারি, শিক্ষার মাধ্যমে যদি নৈতিকতার প্রসার ঘটাতে পারি, শিক্ষার মাধ্যমে যদি দেশপ্রেম বেশি করে ছড়াতে পারি তাহলে কিন্তু সে প্রযুক্তি শিখে দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করবে। 

রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলেছিলেন যে, ভেরেন্ডার তেল দিয়ে আমরা কুপি জ্বালাই, সারা জীবন কি তাহলে ভেরেন্ডার তেল দিয়ে কুপি জ্বালাবো? তিনি উত্তর দিচ্ছেন যে “না; আমরা বিজলি বাতি চাই, তবে একই সঙ্গে সকলের জন্য চাই। এই যে প্রযুক্তি, এই প্রযুক্তি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই। কিন্তু সে প্রযুক্তি দিয়ে যদি কেউ অন্যায় কাজ করেন, তো সেটার জন্য এক নম্বর হলো যে প্রশাসনকে  নিয়ম মাফিক একটা অবস্থায় রাখতে হবে। দুই নম্বর হলো, শিক্ষার মধ্য দিয়ে কোনটা ইতিবাচক কোনটা নেতিবাচক সেটা যদি আমাদের সন্তানদের শিখাতে পারি যেটা শিক্ষালয়ে এবং পরিবারেও শিখাতে হবে। 

ফেইসবুক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমি নই কিন্তু ফেইসবুকটা আমি কি কাজে ব্যবহার করবো, কতোটা ব্যবহার করবো সেটা তদারকির দায়িত্ব আমাদের অবিভাবকদের, শিক্ষকদের এর একটা নীতিমালা দিতে হবে সুতরাং সব মিলিয়ে এগোতে হবে তবে, উন্নয়ন একটা খুব ক্লামজি বিজনেস। অনেকেই মনে করে যে বিষয়টা খুব মসৃণ, কিন্তু আসলে তা না। যখন উন্নয়ন ঘটে ঐ উন্নয়নের রাস্তা দিয়ে হাটলে গায়ে কাদা লাগবে, মুখে কাদা লাগবেই। সুতরাং এই ধরনের সামান্য বাড়তি কিছুর কারণে আমরা প্রযুক্তি গ্রহণ করবোনা আমরা সেই দলে নই।

সিভয়েসঃ প্রতিনয়ত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, আইনের ওপর বল প্রয়োগ না করলে কার্যকর হয় না। আইন আগে না সচেতনেতা?

ড. আতিউর রহমানঃ দুটোই লাগবে, আমাদের সচেতনেতা অবশ্যই দরকার। আইনও জীবন্ত হওয়া দরকার। আইন যেটা ১০০ বছর আগের, সে আইন আমি আজকে যদি প্রয়োগ করি তাহলে আজকের বাস্তবতার সাথে সেটা সামঞ্জস্য হচ্ছে না। যেখানে আইনের সমস্যা হচ্ছে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। আইনটা হতে হবে অংশগ্রহণমূলক৷ কোথায় তারা বাধা পাচ্ছে, কোথায় সমস্যা হচ্ছে আইন নিয়ে সেটা বলার একটা সুযোগ থাকতে হবে। 

প্রতিটি আইনের প্রয়োগের পর সেটির অবস্থা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার, সেগুলো মূল্যায়ন হওয়া দরকার এবং একটা রিড্রেসাল মেথড থাকতে হবে। প্রত্যেকে যেনো তার অভিযোগের কথা বলতে পারে। আমাদের দেশে আইনের একটা সমস্যা হয়ে গেছে যে, আইন প্রয়োগ করার সময় মানবিকতার দিকটি মনে রাখেনা। একটা ছাটে ফেলার চেষ্টা করা হয়। 

কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছু যখন রূপান্তর করতে যায়, কিংবা প্রয়োগ করতে যায় তখন হয়তো আপনাকে একটু দূরদর্শী হতে হবে যে এইটুকুন করা যাবে এইটুকুন করা যাবে না। এই জায়গাগুলোতে আমি মনে করি একটা পরিবর্তন করতে হবে। যথোপযুক্ত আইন তৈরি করা যেমন চ্যালেঞ্জিং কাজ তেমনি যেটার পরিবর্তন যে দরকার হয় তার জন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

সিভয়েসঃ কাঠামোগত উন্নয়ন নাকি মননশীলতার উন্নয়ন আগে?

ড. আতিউর রহমানঃ শিক্ষায় আসলে সবচেয়ে বড় শক্তি। মনশীলতাটা  কি? এটাতো একটা আর্ট। শিল্পটা কি? শিল্পটা হলো সৌন্দর্য্যের ওপরে যে সর সেটাই হলো শিল্প। সুতরাং জীবনকে সুন্দর করা মানুষের মনোভঙ্গিকে বদলানো এটিইতো শিল্প। সে শিল্পের উৎস কোথায়? একটা হলো পরিবার, আমার বাবা মা আমাকে কিভাবে জীবনটা শিখাচ্ছেন। 

দ্বিতীয়ত, আমার শিক্ষক, তৃতীয় হলো সমাজ। সমাজ নিজেই সমস্ত অনাচার করবে আর আশা করবে তার সন্তানরা সব সাধু হয়ে যাবে এটাতো হবে না। সুতরাং সামগ্রিক মিলিয়ে কিন্তু মননশীলতার সৃষ্টি। সমাজ যদি মননশীল হয় তাহলে নিশ্চয় পরবর্তীকালে আইন কানুন সব সেভাবে চলবে। তবে এটা একদিনে হবে না সময় লাগবে। সুশাসন বলতে কিন্তু শুধু মাত্র ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয়। সকলে মিলে একটা অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা দরকার।

সিভয়েসঃ দেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে, এটা দূরীকরণে আপনার কি পরামর্শ  আছে এবং চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা তৈরিতে দেশের ব্যাংকগুলোর কি ভূমিকা রাখা উচিত?

ড. আতিউর রহমানঃ আসলে ব্যাংকই পারে উদ্যোক্তা তৈরি করতে। প্রথমই যে কেউ কোনো ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে ব্যাংকের কাছে আসে। ব্যাংক যদি তাদের ঠিকমতো বুদ্ধি পরামর্শ দেয় তাহলে তো তারা উদ্যোক্তা হবে। সকল উদ্যোক্তা কিন্তু ব্যাংক নির্ভর; আমাদের দেশে এখনো উদ্যোক্তা তহবিল হয়নি। সরকারের তরফ থেকে অনেক বেশি আরএন্ডডি ফান্ড দেওয়া উচিত। যে তহবিল থেকে আমাদের নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রচুর নারী উদ্যোক্তা তৈরীর সুযোগ দিয়েছিলাম। তখন লক্ষ লক্ষ নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছিলো। সুতরাং ব্যাংক যে পারে না তা না। দায়বদ্ধতা তহবিল গঠন করেছি যে তহবিল সামাজিক কর্মকাণ্ড করছে, আমি মনে করি যে উদ্যোক্তা তহবিল হওয়া দরকার। এখন সরকারের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, আমি মনে করি যে, যারা নিজের উদ্যোগে উদ্যোক্তা হতে চায় তাদেরকে আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ো সাথে সাথে কিছু অর্থের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। তারপর তাদের চলতে দাও, তারপর দেখো কি হয়। 

ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলে উদ্যোক্তা বাড়াতে পারে তবে ব্যাংককে গাইড করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ন্ত অর্থনীতি নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, এক্সপোর্ট বাড়ছে, গড় আয়ু বাড়ছে।

সিভয়েসঃ বাংলাদেশের ফ্যাশনখাতে যে গবেষণা হওয়া দরকার তা হচ্ছে না, না হওয়ার কারণও আছে-যেটি বিবি রাসেলের মতে, যথেষ্ট ফান্ডিং এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাও আছে। এতে নতুনত্বের তেমন উপস্থিতি, ঐতিহ্যগত কাপড়ের উত্থানের প্রতি যেমন মসলিনের প্রতি আমাদের মনোযোগ নেই। এতে নতুন ডিজাইনাররা যেটি করছে সেটি হলো অন্যান্য বিদেশি কাপড় এবং ডিজাইনকে প্রমোট করছে, এতে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি?

ড. আতিউর রহমানঃ আমি এরকম সাদা এবং কালো যেমনই হোক এভাবে বলতে চাইনা। আমাদের ফ্যাশনখাতে যথেষ্ট উন্নতি হচ্ছে এবং আমাদের গ্রামীণ সমাজের তাতশিল্পের বড় ধরনের একটা রূপান্তর ঘটেছে। তাতশিল্পের মেশিন আগের চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে যেকারনে পয়লা বৈশাখ এলে সারা বাংলাদেশ তাতশিল্পীদের পণ্যে ভরে যাচ্ছে এবং আমাদের ৪৫ লক্ষ যে নারী শ্রমিক আছে আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে প্রত্যেকেই পয়লা বৈশাখে একটা শাড়ি কিনছে এবং এগুলো আমরাই তৈরি করছি, বিদেশ থেকে আনা শাড়ি নয় কিন্তু এগুলো।

আমাদের দেশের ভেতরে তাতশিল্প এবং বুটিকস শিল্পের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটেছে। আমরা কয়টা পাঞ্জাবি বিদেশ থেকে পড়ি? দেশী ব্র্যান্ড বেড়েছে। বড় ধরনের দেশী সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে দেশী শিল্পগুলো গড়ে উঠছে। এই পরিবর্তন আসলে চোখে পড়ার মতো। মসলিন হারিয়ে গেছে কিন্তু মসলিন ফিরিয়ে আনার জন্য বস্ত্র মন্ত্রণালয়  আবার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমাদের পাট পণ্য দিয়ে যে শাড়ী তৈরী হচ্ছে এগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরছেন।

সিভয়েসঃ রিজার্ভ বাড়ছে, পাকিস্তানের ক্যাপিটাল টিভিতে, সমাজকর্মী জাইগাম খান বলেছেন,পাকিস্তানের অর্থনীতি আমাদের দেশের চেয়ে খারাপ এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন।
ড. আতিউর রহমান আমার খুব ভালো লাগছে, যে পাকিস্তান আমাদের এতো বঞ্চিত করেছে। ৫০ কিংবা ৬০ এর দশকে আমরা তখন পাট উৎপাদন করতাম এবং বাংলাদেশের তখন একমাত্র ফরেন এক্সচেঞ্জ পাট ছিলো। পাট থেকে আমরা যেটি পেতাম সেটি পাকিস্তান নিয়ে নিতো এবং তাদের শিল্পায়নে, তাদের আমদানির জন্য ব্যবহার করতো। মাত্র ১০ শতাংশ আমরা পেতাম। সেজন্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এই দুই দেশ এর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কখনো এক হতে পারে না। তাই তিনি ৬ দফা দাবি তুলেছিলেন। 

পাকিস্তান দাবি শোনেনি বরং তারা এটিকে একটা প্রদেশ বানিয়ে রেখেছিলো। সেখান থেকে বের হয়ে এসে আমরা অনেক ভালো করেছি। আমরা পবিত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছি এবং আজকে আমাদের দেশের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। পরিবার পরিকল্পনা আমাদের এখানে এতো সফল হয়েছে যে, ১৯৭২ এ আমরা ছয়/সাত জনের পরিবার যেমন দেখেছি এখন মানুষ সচেতন হয়েছে এখন সেটা ২ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার তুলনায় পাকিস্তানে বেড়েছে ৮ জন। আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে, আমাদের রয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের আছে ১৫ কি ১৭ বিলিয়ন, আমাদের অর্ধেকের মতো হবে। তাও আবার ১০ বিলিয়ন দিয়েছে আএমএফ, নিজেদের কিছুই নেই।

সিভয়েসঃ পাকিস্তানের প্রজন্মান্তরের যুদ্ধেও আমরা জিতেছি, এটা আসলেই আনন্দের।

ড. আতিউর রহমানঃ আমি এখন পাকিস্তানকে গুনিনা। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সারাবিশ্বের প্রবৃদ্ধির হারের দ্বিগুনেরও বেশি। উন্নয়নশীল দেশের যে প্রবৃদ্ধির হার তারও চেয়ে দেড় গুণ বেশি বাংলাদেশের। পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি আমাদের প্রবৃদ্ধি। আমাদের সাথে পাকিস্তানের তুলনা হয় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে পাকিস্তানের অর্থনীতির তুলনা করা উচিত হবে না।

আমাদের এখন প্রতিযোগিতা ভারত, চীন, ভিয়েতনামের সাথে। বাড়ন্ত দেশ হবো আমরা, সেটা করবে তরুন প্রজন্ম, তরুণ উদ্যোক্তারা। আর কৃষকেরা, কৃষি ভালো করছে বলে দারিদ্র্য কমছে। আগামী বছরে দারিদ্রের হার বিশ শতাংশে নেমে আসবে। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত সবাই মিলে আমরা কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের আকাঙ্খা কিংবা স্বপ্নের একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু বলতেন ১৮ শতকে এই অঞ্চলের মানুষের যে জীবনযাত্রা ছিলো তা ব্রিটেনের জীবন মানের প্রায় সমান ছিলো। 

ব্রিটিশরা এসে আমাদের বস্ত্র শিল্প নষ্ট করেছে আমাকে কলোনি বানালো, পাকিস্তান এসে এটাকে আরো বেশি করে শোষণ করলো। যার কারণে সোনার বাংলা শ্মশান হয়ে গেলো, শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলাতে তৈরি করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। রিজার্ভ বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দারিদ্র্যতা কমছে। স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে হলে সুশাসনের দিকে নজর দিতে হবে।

সিভয়েসঃ দেশের সম্ভাবনার জন্য নতুন পথ কোনটির ওপর আমাদের সকলেরই জোর দিতে হবে?

ড. আতিউর রহমানঃ আমরা ঠিক পথে হাটছি, আমাদের যে শিল্পায়ন, আমরা কৃষিতে খুব ভালো করেছি। কৃষিকে আধুনিক করতে হলে পরিবেশ সম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে, কৃষি ভালো করলে শিল্প ভালো করবে। সব শিল্পের প্রতি জোর দিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন আমরা হবো এ্যাভিয়েশন হাব, যেকোনো স্থান থেকে বাংলাদেশে বিমান এসে টাচ করে এশিয়া, আমেরিকা,ইউরোপ এরকম একটি হাব আমাদের হবে। 

বাণিজ্যেও ব্যাংকিংয়ের হাব হবো। একদিকে সুপার ইকোনমিতে পরিনত হওয়া ভারত, অন্যদিকে সুপার ইকোনমির স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মাঝখানে আমরা। সুতরাং আমরা তাদের সাথে যুক্ত থাকতে পারি। আমাদের প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি, আশাবাদী পরিবেশ, আমাদের মানুষেরা খুবই সৃজনশীল ও উদ্যোগী, উদ্যমী। আমরা স্বপ্নের সমান হবো। তবে শিক্ষাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জিডিপির ২.৫ শতাংশ শিক্ষাতে বিনিয়োগ করি। বিনিয়োগ দ্বিগুন করতে হবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে, তাহলে আমাদের করও দিতে হবে।

সিভয়েসঃ বাংলাদেশের জনগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলন করেন। কিন্তু আন্দোলনগুলোকে তুলনা করে বসে ৫২ সন ৭১ সনের প্রেক্ষাপটের সাথে। এটাকে কিভাবে দেখেন?

ড. আতিউর রহমানঃ আমাদের ইতিহাস সচেতন হতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে এটা জেনে রাখতে হবে যে, আমরা কোথায় ছিলাম আমরা কোথায় আছি? বিশেষ করে ৮ বিলিয়ন ডলারের ৭২ সনের বাংলাদেশ আর ২৮০ বিলিয়ন ডলারেরর বাংলাদেশ হয়েছে। সেটাওতো মনে রাখতে হবে। 

সিভয়েসঃ নৃ-বিজ্ঞানী ড. রাহমান নাসির এর সম্প্রতি প্রকাশিত বই “রোহিঙ্গা নয় রোয়াইঙ্গা” বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন রোহিঙ্গা হিসেবে নয় তারা রোসাইঙ্গা পরিচয়ে পরিচত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতির বিপর্যয় কতোটা? 

ড. আতিউর রহমানঃ নিঃসন্দেহে এই সমস্যাটি হঠাৎ করে ১০ লাখ শরনার্থী এসে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে যতোটা চ্যালেঞ্জের তৈরী করেছে তার চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে স্থানীয় অর্থনীতিতে। পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে, সেদিক থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক দূরদর্শী পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমস্যাটির মোকাবেলা করছেন, বিশ্ব  জনমত তৈরী করছেন। চাপ সৃষ্টি করে আবার ফেরত দিবেন।
আপনার মূল্যবান সময় সিভয়েস২৪ এর সাথে কাটানোর জন্য ধন্যবাদ।

-সিভয়েস/এসএ/এমডিকে/এমইউ

তানভীরুল মিরাজ রিপন

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়