Cvoice24.com


ক্লিনিকে করোনা চিকিৎসা, সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশয়

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৮ মে ২০২০
ক্লিনিকে করোনা চিকিৎসা, সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশয়

চট্টগ্রাম মহানগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৪ হাজার ১৫৭টি শয্যা থাকলেও এসবের কোনটিই করোনারোগীদের কাজে আসছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার উদ্যোগ নিলেও বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা তাতে রাজি হচ্ছেনা। তবে এতে তারা প্রথম বাধা হিসেবে তারা সামনে আনছেন সরকারি সিদ্ধান্তের 'অস্পষ্টতা ও বৈষম্যমূলক আচরণকে'। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সমান সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া ও আর্থিক নিশ্চয়তার দাবি তুলছেন বেসরকারি হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসকরা।

করোনা রোগীদের সেবা বঞ্চনার হাহাকারের মধ্যেই গত ২৪ মে নতুন করে ৫০ শয্যার বেশি থাকা সব হাসপাতালগুলোকে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এতেও চট্টগ্রামের করোনা রোগীদের জন্য কার্যত কোনও সুখবর নেই। নানা শর্ত আর কথার বেড়াজালেই সরকারি সেই সিদ্ধান্ত থমকে যাবে- সেটা অনেকটাই স্পষ্ট ক্লিনিক মালিকদের কথায়। ফলে শুরু থেকে থাকা অনিশ্চিয়তা ও সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে আলাদা ইউনিট করে চিকিৎসা সেবা দেয়ার নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত রোববার (২৪ মে) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেশের সব সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, মেডিকেল কলেজ ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
 
সরকারের এই আদেশটি চট্টগ্রামের বেসরকারি সব হাসপাতালগুলোর কাছে ইতোমধ্যে পৌঁছে দিয়েছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ও। তবে পরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক মোস্তাফা খালেদ আহমেদও স্পষ্ট কোনও আশার বাণী শুনাতে পারেননি। সিভয়েসকে তিনি বলেন, ‌‌‘এই আদেশটি সারা দেশের ক্লিনিকের জন্য। আমরা চট্টগ্রামের  সব হাসপাতালগুলোর কাছে পাঠিয়েছি। তাদের সক্ষমতার ওপর ডিপেন্ড করবে কে কীভাবে সেবা দিতে পারবে। আদেশ পৌঁছে দিয়েছি, দেখি তারা কি করে। আমিতো সবে মাত্র দায়িত্ব নিলাম আর কটা দিন যাক।’

চট্টগ্রাম বিভাগের শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কন্ঠেই যখন এমন সুর। তখন এই আদেশের ভবিষ্যত নিয়ে আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত মিললো চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর কথায়। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘সরকারের আদেশতো আদেশই। আমরা সেটা দেখেছি। কিন্তু আমরাতো আর হাসপাতালগুলোতে অন্য রোগীদের সেবা না দিয়ে খালি ফেলে রাখিনি। করোনা রোগী ভর্তি করব কেমনে? হাসপাতালেতো জায়গা থাকতে হবে! এখনতো চট্টগ্রামের কোনও হাসাপাতালের বেডই খালি নেই। সব রোগীতে ঠাসা। খালি থাকলেই না তখন করোনা রোগী আর সাধারণ রোগী নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পাব।’

এক প্রশ্নের জবাবে লিয়াকত আলী বলেন, ‘সরকারের আদেশ মানতে গেলে তো আমাদের বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীদের বের করে দিতে হবে। এছাড়া আমরা এখন সব রোগীকেই চিকিৎসা দিচ্ছি। কে কভিড আর নন কভিড পেশেন্ট তা দেখা হচ্ছেনা। পরে কভিড রেজাল্ট পজেটিভ আসলে হয়তো ডেডিকেটেড হাসপাতালে রেফার করছি অন্য রোগীদের স্বার্থেই।’

তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, 'বেসরকারি হাসপাতালগুলো অন্য জটিল রোগীদের চিকিৎসার সুবিধার্থে প্রস্তুত রেখে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলাম। বিকল্প হিসেবে আমরা প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল সংস্কার করে দিয়েছি শুধু মাত্র কভিড রোগীদের জন্য। এখন এটি চালু করা সরকারের দায়িত্ব। উদ্বোধন করা হলেও ট্রেনিং প্রাপ্ত জনবলের অভাবে তা চালু করতে পারছেনা বলে জেনেছি। সেটা চালু হলে চাপ কিছুটা কমতো।’

লিয়াকত আলীর কথার সাথে সুর মিলিয়ে বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী সিভয়েসকে বলেন, 'সরকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনারোগীদের চিকিৎসার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। প্রজ্ঞাপন জারি করছে ভালো কথা। কিন্তু সেখানে যারা চিকিৎসাসেবা দিবেন তাদের বিষয়েতো কোনও স্পষ্ট ঘোষণা দেয়নি। সরকারী স্বাস্থ্যকর্মীরা পদ অনুযায়ী স্বাস্থ্য বীমাসহ নানা প্রণোদনা পাবেন। এমনকি মারা গেলে পদ মর্যাদা অনুয়ায়ী ৫০ লাখ টাকাও পাবেন। প্রণোদনার পাশাপাশি তাদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এসবের কোনওটিই নেই বেসরকারি চিকিৎসক নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। এখন আপনিই (প্রতিবেদক) বলুন, বেসরকারি চিকিৎসক নার্সরা কি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করবে?’

একই কথা বলেছেন চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীও। তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত সুবিধা আর সুরক্ষা না পেলে বেসরকারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে রাখা সম্ভব না। তারা যদি চাকরি ছেড়ে দেন তাহলে আমারাতো আর জোর করে তাদের কাজে রাখতে পারব না। সব কিছু ঠিক না করে যদি চাপাচাপি করা হয় তাহলে তো আমাদের চিকিৎসকই শূণ্য হয়ে যাবে। সরকার যদিও লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিচ্ছে, তখনতো এমনিতেই ক্লিনিকগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। সাধারণ ও অন্য রোগীরা চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হবার উপক্রম হবে। তাই সরকারের উচিত চট্টগ্রামে যে কটা ডেডিকেটেড কভিড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়েছে তাতে দ্রুত লোকবল নিয়োগ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা।’

রোগীদের নিয়ে কাজ করা রক্তদাতা সংগঠন ‘কণিকা’র প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল্যাহ মনিরও একই দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি স্বাস্থ্য কর্মীদের অবশ্যই নিজেদের পরিবার আছে, সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারি সকলেরই। তাই আমি মনে করি সরকারের পক্ষ হতে যেভাবে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদিত করেছে। একই পদ্ধতিতে বেসরকারি ক্লিনিকের ডাক্তার নার্সদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা আর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিৎ৷ তাহলে তারাও সেবাদানে আন্তরিক হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

জানা গেছে, নগরে ৯০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ১৮৩টি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) আছে। এসব হাসপাতালে অনুমোদিত শয্যা আছে চার হাজার ১৫৭টি। এর মধ্যে শত শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল আছে এক ডজনেরও বেশি। পার্কভিউ, ন্যাশনাল, ম্যাক্স, মেট্রোপলিটন, মেডিকেল সেন্টার ও সার্জিস্কোপ এর মধ্যে অন্যতম। আবার রয়েল, সিএসসিআর, ডেল্টাসহ দেড় ডজন হাসপাতালের প্রতিটিতে শয্যা আছে পঞ্চাশেরও বেশি। এসব হাসপাতালের সঙ্গে আছে প্যাথলজিক্যাল ল্যাব। আছে আইসিইউ। আছে ভেন্টিলেশন সুবিধাও। কাগজে কলমে ৩১টি আইসিইউ থাকলেও এইচডিইউসহ অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট যুক্ত করে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা যাবে আরও দ্বিগুণসংখ্যক রোগী। কিন্তু কোনো বেসরকারি হাসপাতালই করোনা রোগীদের দিতে চাচ্ছে না সেবা।

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়