Cvoice24.com


সিএমপি : অপরাধে পুলিশের সোর্স

প্রকাশিত: ১২:৫৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০
সিএমপি : অপরাধে পুলিশের সোর্স

ডবলমুরিং পুলিশের সোর্স চান্দু মিয়া কিশোরী ধর্ষণে জড়িত

অপরাধ অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহে নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যক্তিকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তারা। লিখিত কোনও নিয়োগ না থাকলেও অপরাধী গ্রেপ্তারে এসব সোর্সই মূল ভরসা পুলিশ কর্মকর্তাদের। কিন্তু এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে হয়রানিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে সোর্সরা। কয়েকটা অপরাধ প্রকাশ্যে আসলেও বেশিরভাগ অপরাধই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সোর্সদের বেশ কয়েকটি অপরাধনামা প্রকাশ্যে আসার পর সোর্সের বিষয়টি আবার নতুন করে আলোচনায় এলো। 

তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি) স্বীকৃত কোনও সোর্স নেই বলে দাবি করেছেন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। তবে স্বীকৃত না থাকলেও ১৬ থানা পুলিশ ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের শত শত সোর্স কাজ কার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষ করে সাব ইন্সপেক্টর পদ মর্যাদার কর্মকর্তারাই এসব সোর্সকে কাজে লাগান। এমনকি অনেক সোর্সের কাছে আছে থানা পুলিশের দেওয়া বিশেষ চিহ্নযুক্ত সোর্সের পরিচয় পত্রও! 

আর তাদের প্রত্যেক তথ্যের ভিত্তিতে যদি অভিযান সফল হয় তখন প্রদান করা হয় সোর্স মানি হিসেবে টাকা। মাদক ও স্বর্ণের তথ্যের জন্য দিতে হয় সোর্সকে উদ্ধারকৃত মাদক ও স্বর্ণ থেকে চার ভাগের এক ভাগ! তবে এরকম কেউ যদি সোর্স বলে নিজেকে পরিচয় দেন সোর্সের বিরুদ্ধে ও সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন সিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তা সালেহ মোহাম্মদ তানভীর।

মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করে বলছেন, অনেক সময়ই পুলিশের সোর্সরা নিজ স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সোর্সদের ওপর এতো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে তাদের দেয়া তথ্য যাচাই না করেই অভিযান চালায় যাতে অনেক নিরীহ মানুষ বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হয়।

সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোচিত টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকাণ্ডটির নেপথ্যে এখনো পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা বলছে, বাহারছড়ার সাবেক আইসি পুলিশের তিন সোর্সের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সিনহার গাড়ি থামায় এবং ডাকাত মনে করে গুলি করেন। কেননা এই সোর্সরাই লিয়াকত আলীকে বলেছিলেন, পাহাড় থেকে দুজন ডাকাত নেমেছে তাদের একজনের পরনে আর্মির পোশাক রয়েছে। আসামি লিয়াকতও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে একথা জানিয়েছেন। 

শুধু এই ঘটনাতেই সোর্সের ওপর নির্ভর হয়ে ভুল পথে পা বাড়াননি কক্সবাজার পুলিশের বরখাস্ত ইনস্পেক্টর লিয়াকত আলী। এরকম সিএমপিতে অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশের সোর্সরা। কয়েকটি প্রকাশ্যে আসলেও অনেক ঘটনা থেকে গেছে আড়ালে। এরপরও যেসব ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে তারমধ্যে অন্যতম হল-

এ বছরের ১৬ জুলাই মধ্যরাতে চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিংয়ের আগ্রাবাদে একটি বাসায় পুুুুলিশ চুরির আসামি ধরতে গিয়ে মারধর করেন এক কিশোরকে এবং অপদস্ত করেন তার মা-বোনকে। এই অপমানে নিজ ঘরের সিলিংয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেন ওই কিশোর। এরজন্য দায়ি করা হয় ডবলমুরিং থানার এসআই হেলাল ছাড়াও পুলিশের দুই সোর্সকে। পরে অবশ্য হেলালকে বরখাস্ত করা হলেও অধরাই থেকে যায় সেই সোর্সরা।

গত ২৯ আগস্ট রাতে রৌফাবাদের বাসায় ফেরার পথে বায়েজিদ থানার অক্সিজেন মোড়ে শফি নামের এক ব্যক্তি বাদশা মিয়া আর রবিনকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পথ আটকান স্বামী-স্ত্রী দুজনকে। তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী নয়, এমন দাবি করে তাদের পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। পরে সেখান থেকে সিএনজিচালিত ট্যাক্সিতে করে তুলে নিয়ে গিয়ে অদূরের ছালমা কলোনিতে রাত আড়াইটা পর্যন্ত ৫ জন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করে স্ত্রীকে। এই ঘটনার মূলহোতা শফি পুলিশের সোর্স হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ঘটনার পর অন্য আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও পুলিশের সোর্স শফি এখনও পলাতক।

সোর্সদের বিরুদ্ধে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হয়রানিসহ মামলা দেওয়ার অভিযোগ কম নয়। এমনকি নিজেও সোর্সের আড়ালে মাদক সেবন ও ব্যবসার সাথে জড়িত থাকে। গত বছরের ১৫ মে জহিরুল ইসলাম নামে একজনকে  বাকলিয়া থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। যে নিজকে সোর্স হিসেবে পরিচয় দিত। এর আড়ালেই মূলত বিক্রি করত ইয়াবা।

সোর্সের বিষয়টি সিএমপিতে আলোচনার জন্ম দেয় চট্টগ্রামের আলোচিত পুলিশ সুপার (অব) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনায়। ২০১৬ সালের ৫ জুন নগরীর জিইসি মোড়ে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে হত্যার নির্দেশদাতা ছিল তাঁরই সোর্স আবু মুছা। অস্ত্র সরবরাহ করে অপর সোর্স এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা। যেই অস্ত্রে খুন হন মিতু। 

সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিজের ফুফাতো বোনের বান্ধবীর সহযোগিতায় ডবলমুরিং থানার সুপারিওয়ালাপাড়ার একটি বাসায় ধর্ষণের শিকার হন স্বর্ণা নামের এক কিশোরী। ধর্ষণের মূল হোতা পুলিশের সোর্স চান্দু মিয়া। তার বিরুদ্ধে পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক দলের কর্মী, বিভিন্ন ছোট অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়া দাগী আসামি, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষকে পুলিশ সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। তথ্যের বিনিময়ে এই সোর্সদের টাকা দিতে হয়, যা সোর্স মানি হিসেবে পরিচিত। পুলিশ সদর দফতর থেকে যখন এই টাকা দেওয়া হয়, তখন তা ‘অপারেশন মানি’ হিসেবে উল্লেখ থাকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সোর্স মানি বলা না হলেও ঘটনার রহস্য উদঘাটনের পর বা অপরাধী গ্রেপ্তারের পর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনকারী অফিসারদের পুরস্কার হিসেবে 'অপারেশন মানি' দিয়ে থাকেন।   

একজন ওসি থেকে পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত সোর্স মানি পেয়ে থাকেন। তবে যারা আসল কাজটিই করেন মাঠ পর্যায়ে সেই এসআইরা পাননা কোনো সোর্স মানি। বর্তমানে সিএমপির প্রত্যেক থানার ওসি ১৩ হাজার টাকা মাসিক সোর্স মানি পান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জেলার আকৃতি কিংবা মামলার অপরাধের ভিত্তিতে সোর্স মানির পরিমাণ কম-বেশি হয়ে থাকে। বড় জেলা বা ইউনিটের জন্য বছরে ১০-১২ লাখ এবং ছোট জেলা বা ইউনিটের জন্য বছরে ৮-১০ লাখ টাকা সোর্স মানি বরাদ্দ দেওয়া হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। এই সোর্স মানির বরাদ্দ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ রয়েছে। সিনিয়ররা এই সোর্স মানি পেলেও জুনিয়ররা না পাওয়ায় তারা সোর্সদের ভিন্নভাবে ম্যানেজ করে থাকে।

একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, হত্যা মামলার আসামি ও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সোর্সকে টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকা নিজের পকেট থেকে না হয় পরে সিনিয়রদের থেকে প্রাপ্ত অপারেশন মানি বা পুরস্কারের অর্থ থেকে দেওয়া হয়। আর মাদক ও স্বর্ণের বেলায় সোর্সকে নগদেই মাদক ও স্বর্ণের একটা অংশ দিয়ে দিতে হয়। সোর্সরাও টাকার বদলে ইয়াবা ফেন্সিডিল ও স্বর্ণ নিতে আগ্রহী। ফলে উদ্ধারের একটা অংশ সোর্সদের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকসেবীদের হাতে আবার চলে যায়। 

পুলিশের সোর্স নিয়ে বিবিসি বাংলাকে সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেছেন, সোর্সদের দেয়া তথ্য যাচাই করেই পুলিশকে এগুতে হয়, তবে অনেক সময় নিজেই সঠিক তদন্তের প্রয়োজনে সোর্স নিয়োগ করতে হয় কর্মকর্তাদের। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সোর্স বা ইনফরমার থাকা অপরিহার্য। এটা ছাড়া তো কাজ করা যাবেনা। অনেক সময় সোর্সদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠলে সেটারও তদন্ত হয়। 

তবে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি বা প্রবিধান না থাকায় পুলিশের সোর্স বিষয়টি জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যায়। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তাদের তথ্য পাওয়ার জন্য ব্যবহার করার বদলে অনেক সময় ক্ষমতা প্রদর্শন বা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। আবার এই সুযোগে সোর্সরাও অনেক সময় পুলিশকে ব্যবহার করে ফেলে। পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে অপরাধমূলক কাজের অভিযোগও অনেক সোর্সের বিরুদ্ধে উঠেছে।

তবে সোর্স সম্পর্কে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সিভয়েসকে বলেন, 'গোপন সংবাদ বের করাই মূল উদ্দেশ্য থাকে। এক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষও সোর্স হতে পারে। আবার কোনো বিজ্ঞজনও হতে পারেন সোর্স। মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, যে কেউ সোর্স হতে পারে। আবার কখনো কখনো কোনো ঘটনা বা চক্রে জড়িত কাউকেও সোর্স করা যেতে পারে। তবে এটি পুরোটাই নির্ভর করে কর্মকর্তার দক্ষতা বা কৌশলের ওপর।'

তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু কাগজে কলমে স্বীকৃত কোনও সোর্স রাখার নিয়ম নেই৷ তাই কেউ সুনির্দিষ্ট সোর্স বলা যাবে না বা সোর্স বলেও কেউ দাবি করতে পারবে না। আমি সিএমপিতে ক্রাইম জোনের ডিসিদের স্পষ্টই বলে দিব, কেউ যাতে সোর্স না পালে। এরকম হলে যদি কোনও সোর্স অপরাধ করে তার দায় ওই কর্মকর্তাকেও নিতে হবে। সোর্স পরিচয় দিলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। সেই সাথে তার শেল্টারদাতাকেও জবাবদিহির মধ্যে আসতে হবে।'

সিএমপি কমিশনার বলেন, 'আপনি বলতে পারেন সিএমপিতে কোনো সোর্স নেই। কেননা আমাদের গোয়েন্দা বিভাগকে আমরা আরও তৎপর করছি৷ পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে জোরদার করছি৷ যাতে জনগণই আমাদের সোর্স হয়ে উঠে। আমরা মনে করতে চাই পুরো নগরবাসীই আমাদের সোর্স।'  

সিভয়েস/এডি

 

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়