Cvoice24.com

চট্টগ্রামে আজ, মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪

সময় ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড


খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতা যেন নিয়তি, সিডিএর প্রকল্পে ধীরগতি

প্রকাশিত: ০৩:২২, ২১ অক্টোবর ২০২০
খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতা যেন নিয়তি, সিডিএর প্রকল্পে ধীরগতি

প্রতি ভরা পূর্ণিমায় জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। বিশেষ করে প্রতি বর্ষায় জোয়ারের পানির কারণেই শতকোটি টাকার ক্ষতি গুনছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের বিস্তর অভিযোগ থাকলেও পরিকল্পনা ও প্রকল্পের হিসেবে প্রতিবছরই মার খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা‌। ফলে বর্ষা মৌসুমে দিনে দুইবার করে কর্ণফুলীর পানিতে নষ্ট হচ্ছে নিচু আড়তে থাকা ভোগ্যপণ্য। এ নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) একটি প্রকল্প হাতে নিলেও ক্যাটাগরির মারপ্যাঁচে পড়ে অর্থ ছাড়ের ফাঁদে পড়ে কাজ চলছে মন্থর গতিতে।

খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কর্ণফুলী নদী নিয়ম মাফিক ড্রেজিং ও নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে মেগাপ্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করলেই জোয়ারের পানি থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পাশাপাশি নগরবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। ২ হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এই প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদীর পাশে বেড়িবাঁধ এবং ১২টি খালে স্লুইসগেট নির্মাণ করা হবে।

সিডিএ সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত ৮ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা তৈরি করা হবে। পাশাপাশি আর.এল ৪ মিটার হতে ৯ দশমিক ৪০ মিটার উচ্চতায় নদীর উত্তর পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ফলে এ প্রকল্পে দেখা যাবে কালুরঘাট সেতু হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত শহর রক্ষাকারী বাঁধ ও রাস্তা। সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে এ প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পেয়েছে ৫৯৪ কোটি ৪৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা। এতে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। কিন্তু প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি না থাকলে কাজের অগ্রগতি হবে না।

খাতুনগঞ্জ হামিদউল্লাহ মিয়া মার্কেট (পেঁয়াজ) ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস সিভয়েসকে বলেন, 'চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ীদের দুর্দশা পিছু ছাড়ছে না। করোনা সংকটেও জোয়ারের পানির এ দুর্ভোগ আমাদের সহ্য করতে হয়েছে। গুদাম ও দোকানপাট তলিয়ে যাওয়ার কারণে কয়েকদিন ধরে ৫ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টা কোনো ব্যবসা হয়নি। বিভিন্ন আড়তে ও গুদামে পানি ঢুকে পড়ছে। পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন পণ্য নষ্ট হচ্ছে। এ সময় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে দৈনিক ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ব্যবসাতে পড়ছে।'

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদ সিভয়েসকে বলেন, 'আমরা প্রতি বছরই কর্ণফুলী নদী ও চাক্তাই খাল ড্রেজিং করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। এ কাজগুলো না করলে আমাদের প্রতিবছর লোকসান হবে। আর এরকম লোকসান নিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব না। কর্ণফুলীতে বাঁধ নির্মাণের একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে প্রকল্পেরও কোনো অগ্রগতি নেই।'

খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে জোয়ারের পানি ঠেকাতে স্লুইস গেইট নিমাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এ প্রসঙ্গে খাতুনগঞ্জের এক বাসিন্দা বলেন, 'আমরা বারবার শুনছি স্লুইস গেটের কাজ চলতেছে। কিন্তু দুই থেকে আড়াই বছরে কোনো কাজেই হয়নি এখানে। আমাদের দাবি দ্রুত যেন কাজ শেষ হয় এবং এটার সুফল আমরা যেন ভোগ করতে পারি।'

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের কাছে এ প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়। তিনি সিভয়েসকে বলেন, 'এ প্রকল্পে আমাদের ভৌত বা বাস্তব অগ্রগতি ৩৮ শতাংশ। প্রকল্পের শুরু থেকে আমরা সর্বশেষ অগাস্ট পর্যন্ত প্রকল্প ব্যয় বাজেটের ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ টাকা পেয়েছি। এটি 'সি' ক্যাটাগরিতে থাকায় আমরা অর্থ পাচ্ছি দেরিতে, তাই কাজও হচ্ছে দেরিতে। 'সি' ক্যাটাগরিতে থেকে 'এ' ক্যাটাগরিতে নেয়ার জন্য আমরা চেষ্টা-তদবির করছি। এটি 'সি' ক্যাটাগরিতে থাকলে আমরা এ বছরও কোনো কাজ করতে পারবো না। ক্যাটাগরি পরিবর্তন হয়ে এগিয়ে আসলে আর্থিক অগ্রগতি ভালো থাকবে। ফলে কাজ দ্রুত হবে।'

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামকে বলা হতো ‘গেটওয়ে অব দি ইস্ট’। এখানে খ্রিস্ট্রীয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে আরব, তুর্কি ও পর্তুগিজ বণিকরা ব্যবসার জন্য আসেন। চট্টগ্রামে হামিদুল্লাহ খাঁ নামে এক সওদাগর ছিলেন। স্ত্রীর নাম ছিল খাতুন বিবি। তার নামে খোলা হয় নানা দোকানপাট। ব্যবসায়ীদের আনাগোনা শুরু হলে খাতুন বিবির দোকানপাটগুলোর নাম ‘গঞ্জ’ হয়ে ওঠে। খাতুন ও গঞ্জ মিলে নাম রাখা হয় খাতুনগঞ্জ। তখন থেকেই খাতুনগঞ্জের নাম ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। 

ত্রয়োদশ শতকে আরব বণিকরা ভারতবর্ষে আসেন কর্ণফুলী নদী দিয়ে। পরে পর্তুগিজ, ফরাসি ও ব্রিটিশরাও নদীপথে আসেন। সপ্তম শতাব্দী থেকে দূরপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের আরব বণিকরা কর্ণফুলী নদী বিধৌত এ ব্যবসাকেন্দ্রে সওদা করতেন। কালক্রমে বিশ্বের বৃহৎ নদ-নদীর তীরে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক নগরীর মতো এ কর্ণফুলীর তীরে খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, চাক্তাই, বক্সির হাট, টেরিবাজার নিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে ওঠে। নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজারে রূপ নেয়। এ বৃহৎ বাণিজ্যিক এলাকাটি বাংলাদেশের অনেক সওদাগর, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতির সূতিকাগার।

এখানকার ব্যবসায়ীরা দুভাগে বিভক্ত ছিলেন। বাঙালি ও অবাঙালি। বাঙালি ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই ছিলেন চট্টগ্রামের লোক। তারা পরিচিত ছিলেন চাটগাঁইয়া হিসেবে। অবাঙালিরা ছিলেন বোম্বাই ও গুজরাটের বাসিন্দা। অবাঙালি ব্যবসায়ীরা খাতুনগঞ্জে সব সময়ই দাপুটে ছিলেন। কারণ তাদের পুঁজি তুলনামূলক ভালো ছিল। পণ্য আমদানির অনুমতি ছিল। বাঙালি ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির অনুমতি কদাচিৎ পেতেন। অবাঙালি ব্যবসায়ীদের অনেকে খাতুনগঞ্জের পাশাপাশি করাচিতেও ব্যবসা করতেন। ফলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা তাদের আমদানি করা পণ্য পাইকারিতে কিনে নিতেন। অনেক বাঙালি ব্যবসায়ী অবাঙালিদের পণ্য আমদানি অনুমতিপত্র কাজে লাগাতেন।

কিন্তু জোয়ারের পানির দুর্ভোগসহ এই খাতুনগঞ্জ ছেড়ে অন্যত্র অফিস নিয়েছে এরকম প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপও কম নয়। যে মার্কেটে দৈনিক শত শত কোটি টাকার লেনদেন, সেই মার্কট এলাকাকে ঘিরে কোনও সময়েই পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি।

-সিভয়েস/এসবি/এডি

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়