Cvoice24.com


করোনাকালে চট্টগ্রামে অনলাইন ব্যবসায় নতুন সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৫ অক্টোবর ২০২০
করোনাকালে চট্টগ্রামে অনলাইন ব্যবসায় নতুন সম্ভাবনা

আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম বিস্ময়কর আবিষ্কার ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে দিন দিন ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটছে অনলাইন বাণিজ্যের। সারা বিশ্বের মহামারীকালীন এই সময়ে নতুন নতুন উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য অন্যতম শুভ সংকেত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের শুরুর দিকে চীনের ছোট্ট শহর উহান থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনাভাইরাসে অনেকটা থমকে গিয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি। করোনাভাইরাস হানা দেওয়ার শুরুর দিকে কড়া লকডাউনকালীন সময়ে চট্টগ্রামে অনেকেরই আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং ব্যাপকভাবে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

এসব কর্মহীন মানুষের অনেকেই ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা হিসেবে অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যকে বেছে নেয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী, গৃহিণীসহ নানান পেশাজীবির মানুষ দিন দিন যুক্ত হচ্ছে অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্যে। কাপড়চোপড়, জুতা বা প্রসাধনী সামগ্রী থেকে শুরু করে নানা রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর হরদম বেচাকেনা চলছে অনলাইনে। 

কাপড়চোপড় বা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি অনলাইনে হরেক রকমের খাবারের বেচাকেনাও চলছে পুরোদমে। অনলাইনে খাবারের ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী বা গৃহিনীরা। ঘরে বসেই ঘরে তৈরিকৃত খাবার ইন্টারনেটের সাহায্যে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন তারা। অনলাইনে বিক্রি হওয়া এসব খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো হরেক রকমের বিরিয়ানি, নানান ধরনের স্থানীয় খাবার, কেক ও নানান ধরনের ডেজার্ট।

অনলাইন কেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান 'কেকারি ক্রাফট' এর সত্ত্বাধিকারী নাফিসা তাসনীম সিভয়েসকে বলেন, আসলে অনলাইন প্লাটফর্মটাকে ব্যবহার করে ঘরে বসে তৈরিকৃত কেক ও নানান রকম ডেজার্ট আইটেম বিক্রি করে আমার মতো অনেক নারীই লাভবান হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের জন্য এই অনলাইন বাণিজ্যটা বেশি উপকারী, কারণ ঘরে বসেই সবখানে পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে সহজেই। এছাড়া অনলাইন বাণিজ্যে পুঁজিও খুব একটা বেশি লাগে না, বাহিরে দোকান নিয়ে ব্যবসা করতে গেলে তো বড় একটা পুঁজির দরকার পড়ে।

এছাড়া করোনাকালীন পরিস্থিতিতে নগরীর শপিংমলগুলো একটানা বন্ধ থাকা ও পরবর্তীতে খুলে দেওয়া হলেও ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় এসব শপিংমলের দোকান গুলোও ধাবিত হচ্ছে অনলাইনের দিকে।

ইউনেস্কো সিটি সেন্টারের 'আরবান ভগে'র সত্ত্বাধিকারী পাভেল সিভয়েসকে বলেন, "অনলাইনে বেচাকেনা আগের তুলনায় খুব ভালো হচ্ছে। আগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করতে পণ্যের মান নিয়ে নিরাপদহীনতায় ভুগতো। কিন্তু এখন এই প্লাটফর্মে নতুন নতুন উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে, তাই এখন ক্রেতাদেরও বিশ্বস্ততা বেড়েছে। ফলে চট্টগ্রামে এখন অনলাইন বাণিজ্যটা দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে মার্কেট বন্ধ থাকার কারণে আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এখন মাশাল্লাহ অনলাইনে ভালোই বেচা বিক্রি হচ্ছে।"

ইন্টারনেটের মাধ্যমে এধরণের বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হলো অ্যাপস, ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেইজ বা গ্রুপ। শপিং মলে বা বাজারে না গিয়ে ঘরে বসেই শপিং করতে পারার সুবিধার কারণে দিন দিন অনলাইন বাণিজ্যের ক্রেতার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অনলাইন মার্কেটের নিয়মিত ক্রেতা রোমানা আহমেদ সিভয়েসকে বলেন, "আমি প্রায় প্রতিদিনই অনলাইনে কেনাকাটা করি। কারণ অনলাইনে কেনাকাটা করলে সশরীরে মার্কেটে যেতে হয় না, তাই সময় এবং খরচ উভয় সাশ্রয় হয়। যে সময়টা আমার শপিংয়ে ব্যয় হতো তা আমি বাচ্চাদের দেখাশোনায় বা সংসারের অন্যান্য কাজে ব্যয় করতে পারি।"

অনলাইন মার্কেটের পণ্য বেচাকেনার পর ক্রেতাদের কাছে নির্ধারিত সময়ে এসব পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে অনলাইন কেন্দ্রিক কুরিয়ার সার্ভিস। এসব কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে হোম ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে অনলাইন মার্কেটের বিক্রেতারা সহজেই ক্রেতার কাছে তাদের পণ্য পৌঁছে দেয়।

নগরীতে হোম ডেলিভারি সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ইজিডেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মাসুদুল করিম সিভয়েসকে বলেন, "দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে অনলাইন কেন্দ্রিক বাণিজ্যের হার দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনাভাইরাসের হানা দেওয়ার শুরুর দিকে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়লেও এখন সেই হার অনেকটাই লাগাম টানলো অনলাইন ব্যবসার কল্যাণে। অনলাইন কেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে বসে সহজেই যেকোনো পণ্য কিনতে পারা এবং তা হোম ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে ঘরেই পৌঁছে যাওয়ার কারণে এই অনলাইন বাণিজ্যটা বর্তমানে চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করছে।"

অনলাইন কেন্দ্রিক বাণিজ্যে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে নারীরা। ঘরে বসেই কেবল সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেক নারী।

এ ব্যাপারে চিটাগাং উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ সভাপতি মুনাল মাহবুব সিভয়েসকে বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে যেহারে অনলাইন ব্যবসার প্রসার ঘটছে, নতুন নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টি হচ্ছে তার অনুভূতি নিঃসন্দেহে অনেক আনন্দের। আমাদের চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার গত দুই বছর ধরে নারীদেরকে ই-কমার্স এর উপর নানান ধরণের ট্রেইনিং প্রদান করে আসছে। তাদেরকে কিভাবে ব্যবসা শুরু করতে হয়, বোস্ট করতে হয়, পরিচালনা করতে হয় এসবের উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তাই বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার এটা একটা বড় কারণ বলে মনে করি। এখন এই অনলাইনে ব্যবসার প্রসার ঘটেছে, নারীরা নানান পণ্যের বেচাকেনা করছে অনলাইনে। 

এক্ষেত্রে ফুড বা ক্যাটারিংয়ের সেক্টরটা অনেক বেশি বেড়েছে। তবে দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময়ী এই অনলাইন বাণিজ্যের বিস্তারে মনিটরিং বডি বা গভর্নিং বডির প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। যেন কোনো অসাধু ব্যবসায়ী এই অনলাইন প্লাটফর্মের অবৈধ সুবিধা নিতে না পারে। সেক্ষেত্রে অনলাইন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা যেতে পারে। তাতে অনলাইন মার্কেটের প্রতি ক্রেতাদের বিশ্বস্ততাও বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ ইকোনমিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিইএ) এর সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, দেশে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে প্রসার লাভ করা অনলাইন বাণিজ্য সারা বিশ্বের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আগে থেকেই এই অনলাইন ব্যবসার বিস্তার হলেও আমাদের দেশে আগে এতটা প্রসার লাভ করেনি। বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন কেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের মতো বাংলাদেশেও অনলাইন কেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিস্তার লাভ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশ্বস্ততা। বিক্রেতাদের অবশ্যই ক্রেতার বিশ্বস্ততা অর্জন করতে হবে এবং তা ধরে রাখতে হবে।

একুশে পদকপ্রাপ্ত এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, করোনাকালীন এই পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রসার লাভ করা এই অনলাইন বাণিজ্যকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে। আর এই বাণিজ্যে ক্রেতাদের চাহিদার উপর জোর দিতে হবে। তারা যেন না ঠকে। ক্রেতারা যে পণ্য অনলাইনে অর্ডার করেছে ঠিক সেই পণ্যই যেন তারা বাড়িতে বসে পেয়ে যায়। এজন্য পণ্যের গুণগত মানের উপর নজর রাখতে হবে।

-সিভয়েস/জেআই
 

জুলহাজ ইব্রাহিম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়