Cvoice24.com

চট্টগ্রামে আজ, মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪

সময় ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড

চমেক হাসপাতাল
২৪ দিনেও মিলছে না ২৪ ঘণ্টার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ২১ নভেম্বর ২০২০
২৪ দিনেও মিলছে না ২৪ ঘণ্টার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

প্রতীকী ছবি

নিপতারা। বয়স ২৩ বছর। থাকতেন স্বামী আলমগীরের সঙ্গে নগরীর বন্দর থানার কলসির দীঘির পাড় এলাকার ভাড়া বাসায়। গত ১১ সেপ্টেম্বর বাসার ভেতর দরজার হুক লাগানো অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা ছিল তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এরপরও সন্দেহের বশে স্বামীকে আটক করে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। 

পুলিশ রেজ্যুলেশন অব বেঙ্গল বা পিআরবি অ্যাক্ট অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি দেওয়ার নিয়ম মেডিকেল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সেই নিয়ম মানা তো অনেক দূর! নিপতারার ময়না তদন্ত প্রতিবেদনটি পুলিশের হাতে এসেছে তার মৃত্যুর ঠিক ৫১ দিন পর গত ২৮ অক্টোবর। সেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশের ধারণাকে মিথ্যা করে রিপোর্ট এসেছে ‘হাত দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে’। 

এ রিপোর্ট হাতে পেয়ে চোখ কপালে উঠলো তদন্ত কর্মকর্তা বন্দর থানার এসআই শরীফুজ্জামান ভূঁইয়ার। কেননা ইতোমধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে স্বামী আলমগীরকে জেলে পাঠালেও তিনি ইতোমধ্যে জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা। পুলিশ এরজন্য দায়ী করছে, যে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাওয়ার কথা সেটি হাতে পাওয়া গেছে ৫১ দিন পর। ফলে ৫৪ ধারায় সন্দেহজনভাবে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি আসামিও আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জামিনে বের হয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। যদি ২৪ ঘন্টায় নয়, ২৪ দিনেও এই ময়না প্রতিবেদন হাতে পেতো পুলিশ তাহলে মূল অভিযুক্ত আসামি স্বামী আলমগীরকে জেলে আটকে রাখতে পারতো। 

শুধু এই একটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতেই এরকম দীর্ঘসূত্রিতা নয়। সিএমপির ১৬ থানায় শত শত মামলার তদন্ত থমকে আছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য। 

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেই তদন্ত প্রক্রিয়া থমকে থাকছে না। বিভিন্ন মারামারি ঘটনায় দায়ের হওয়ায় মামলার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ মেডিকেল সার্টিফিকেটের (এমসি) জন্যও তদন্ত আটকে আছে। গত ২০ নভেম্বর পর্যন্ত সিএমপির ১৬ থানায় মেডিকেল সার্টিফিকেটের (এমসি) জন্য মামলার তদন্ত আটকে আছে ১৬৭টি আর পোস্টমর্টেম (পিএম) রিপোর্টের জন্য তদন্ত আটকে ৬৯টি। এই দুইটি কারণে সিএমপিতে ২৩৬টি মামলার তদন্ত কার্যক্রম থমকে আছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মামলার তদন্ত থমকে আছে বায়েজিদ থানায় (৩৪টি)। অন্যদিকে কোনও প্রতিবেদনই আটকে নেই পতেঙ্গা থানায়।             

সিএমপি সূত্র বলছে, কোতোয়ালী থানায় মোট মামলার সংখ্যা ১৬টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ১৫টি আর পিএমের জন্য ১টি। চকবাজার থানায় মোট মামলা ৯ টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ৯টি আর পিএমের জন্য ৮ টি। সদরঘাট থানায় মোট মামলা ১টি আর সেটি এমসির জন্য। বাকলিয়া থানার মামলা সংখ্যা ২৫টি এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ১৯ টি আর পিএমের জন্য ৬ টি। 

এইতো গেল সিএমপির দক্ষিণ বিভাগের হিসাব। এবার উত্তর বিভাগের পাঁচলাইশ থানায় মোট মামলা সংখ্যা ১২টির সবই এমসির জন্য আটকে আছে। চান্দগাঁও থানায় মামলার সংখ্যা ১১টি। তারমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ৯ টি আর পিএমের জন্য ২ টি। বায়েজিদ থানায় মামলার সংখ্যা ৩৪টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ২১ টি আর পিএমের জন্য ১৩ টি। খুলশী থানায় মামলার সংখ্যা ১৯টি। এমসির জন্য আটকে আছে ১০টি আর পিএমের জন্য ৯ টি। 

উত্তর-দক্ষিণের পর সিএমপির পশ্চিম বিভাগের ডবলমুরিং থানায় মামলার সংখ্যা ২০টি। এমসির জন্য আটকে আছে ১৯টি আর পিএমের জন্য ১ টি। পাহাড়তলী থানায় মোট মামলার সংখ্যা ১২টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ৮ টি আর পিএমের জন্য ৪টি। হালিশহর থানায় মোট মামলার সংখ্যা ৩০টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ১৯ টি আর পিএমের জন্য ১১ টি। আকবর শাহ থানায় মোট মামলার সংখ্যা ২৪টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ১৩ টি আর পিএমের জন্য ১১ টি।

সিএমপির বন্দর বিভাগের মধ্যে পতেঙ্গা থানায় কোনও মামলা আটকে নেই এমসি কিংবা পিএম রিপোর্টের জন্য। তবে বন্দর থানায় মোট মামলা আটকে আছে ৮টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ৭টি আর পিএমের জন্য ১ টি। ইপিজেড থানায় মোট মামলার সংখ্যা ৫টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ১ টি আর পিএমের জন্য ৪ টি। কর্ণফুলী থানায় মোট মামলা আটকে আছে ১০টি। এরমধ্যে এমসির জন্য আটকে আছে ৫টি আর পিএমের জন্য ৫টি।

পুলিশ রেজ্যুলেশন অব বেঙ্গল বা পিআরবি অ্যাক্ট অনুযায়ী মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তরের সময়েই পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি তুলে দিতে হবে। সে অনুযায়ী মর্গেই লেখার কথা প্রতিবেদনটি। অবশ্য বাস্তবতার নিরিখে সরকারি নির্দেশনায় সে সময়টা বৃদ্ধি করে ২৪ ঘণ্টা করা হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তরের সঠিক সময় কখন তা কেউই জানেন না।

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিধিটা পিআরবি আর সরকারি নির্দেশনাতেই আটকে আছে। কোনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনই নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হয় না। ঘণ্টা পার হয়ে দিন, মাস আর বছর চলে গেলেও বেশিরভাগ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ পুলিশের। মাসের পর মাস মর্গে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে থাকার আড়ালেও মর্গ অফিসে টাকার খেলার তথ্য পাওয়া গেছে।

ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভিন্ন কর্মী সংশ্নিষ্ট মামলায় পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এই টাকা নেন। নিহতের পরিবার এই টাকার উৎস হলেও অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশের স্বজন না থাকায় আটকে থাকে সেসব ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। কোনো কোনো ঘটনায় মামলার চার্জশিট জমা নিয়ে সময়ের বাধ্যবাধকতা থাকায় পুলিশের সংশ্নিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার পকেটের টাকা খরচ করেই নিতে হয় এই প্রতিবেদন। 

বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত আলোচিত হত্যাকাণ্ড বা হত্যাকাণ্ড বোঝা যায়, এমন ঘটনাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দ্রুতই পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যা বা অজ্ঞাত পরিচয়ে উদ্ধার লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মাস থেকে বছর পার হলেও তা আর তৈরি হয় না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির বিলম্বের কারণে বদলে ফেলা হতে পারে মৃত্যুর আসল কারণ। ময়নাতদন্ত থেকে প্রতিবেদন দেওয়ার দীর্ঘ সময়ের ফাঁকে প্রভাবিত হতে পারেন চিকিৎসক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও। বিভিন্ন সময়েই ভুক্তভোগীরা টাকার বিনিময়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে আসছেন।

পিআরবি বিধি অনুযায়ী ময়নাতদন্ত শেষে লাশের সঙ্গে পুলিশ সদস্য বা কনস্টেবলের কাছে হস্তান্তর করা কার্বন কপিটিই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। কিন্তু বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলে তাতে বিলম্ব করা হয়। এই বিলম্বের মধ্যেই ঘটতে পারে অঘটন। 

বিধি অনুযায়ী পোস্টমর্টেম রিপোর্ট একটি। বিস্তারিত রিপোর্ট বলে আইনে বা বিধিতে কিছু নেই। ময়নাতদন্ত সংক্রান্ত সিআরপিসি ও পিআরবির ধারাগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলে পরবর্তী সময়ে কোনো চাপ, ভয়-ভীতি বা লোভের কাছে নতি স্বীকারের সুযোগ থাকে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও নিশ্চিত হয় বলে মনে করেন বিচার সংশ্লিষ্টরা।

তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিনের পর দিন মাসের পর মাস মর্গে আটকে থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত জনবলের অভাবে এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কম থাকায় প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হয়। এ ছাড়া ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্যও আটকে থাকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর প্রতিবেদন আগে দেওয়া হয়।

সিএমপি ও চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা বলছে...

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির সিভেয়সকে বলেন, ‘দেরি হচ্ছে না তা নয় কিন্তু। তবে সেটা সিস্টেমের কারণে। আবার আমরা ইচ্ছা করেই যে দেরি করছি তা নয়। হুট করেই চাইলে মনগড়া প্রতিবেদন দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই কিছুটা সময় লাগে।’ 

তবে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এস এম মোস্তাক আহমেদ সিভয়েসকে বলেন, ‘পিএম রিপোর্ট যেমন দেরিতে দেওয়া হয় তেমনি এমসি দিতেও সপ্তাহ মাস নয়, মাস ছয়েকও পার হয় অনেক সময়। এতে করে মামলার তদন্ত কাজে মারাত্মকভাবে বিঘ্ন ঘটে। আমরা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ থেকে আরও আন্তরিক সহযোগিতা আশা করি। তারা নানা কারণে এমসি ও পিএম রির্পোট প্রদানের ক্ষেত্রে দেরির কারণ দেখায় কিন্তু সেই দেরিতে ক্ষতিটা হয় কিন্তু ভিকটিম তথা বিচার প্রার্থীরই।’

তবে পুলিশের এ অভিযোগের বিপরীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পুলিশের অভিযোগ যদি থাকে তারা সরাসরি আমাদের করতে পারে। এখানে আসলে অভিযোগের কিছুই নেই। নানা কারণে হয়তো একটু দেরি হয়। কেননা, যেসব চিকিৎসক ছিলেন তারাও অনেক জায়গায় বদলি হয়ে গেছেন। আবার করোনার কারণেও কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। এছাড়া এমসি পেতে হলেও কতগুলো বিধি-বিধান মানতে হয়। হুট করে চাইলেই এমসি দেওয়া যায় না। রোগীকে সেই সময় কোন ডাক্তার চিকিৎসা দিয়েছিলেন তাকেই এই মেডিকেল সার্টিফিকেট রেডি করতেই হয়। এখন তাকে সব ব্যবস্থাপত্র দেখে তা রেডি করতে হয়।’ 

‘অনেক সময় দেখা যায়, যখন পুলিশ বা রোগী সেই এমসি নিতে আসলেন কিন্তু তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ছুটিতে বা বদলি হয়ে গেছেন। তখনতো স্বাভাবিকভাবেই দেরি হবেই।’- বলেন এস এম হুমায়ুন কবির।

পোস্টমর্টেম (পিএম) রিপোর্ট প্রদানে দেরি প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের এ পরিচালক বলেন, ‘সেটা যথা সময়ে দিতে আমরা সচেষ্ট। কিন্তু শুধু বডি কেটেই পিএম রিপোর্ট দেওয়া হয়না। তার সাথে ভিসেরা রিপোর্ট প্রস্তুতসহ নানা কাজ থাকে। যা ঢাকা থেকেই করতে হয়। সো, দেরি হচ্ছে কেন তা বললেই সমাধান মিলেনা। পুলিশ যদি সেরকম অভিযোগ করে থাকে তাহলে তারা আমাদের লিখিতভাবে জানাতে পারে।’

অন্যদিকে সিএমপির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, ‘রহস্যজনক মৃত্যুর পিএমের রিপোর্ট পেতে দেরি হলেও তা মানা যায়। কিন্তু সামান্য অপমৃত্যুর যেসব বডির পোস্টমর্টেম করা হয়, সেসবের কোনও ভিসেরা পরীক্ষা করা লাগে না। সেই সব রিপোর্ট পেতেও অনেক সময় সপ্তাহ পনের দিন পার হয়।’

এ অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার পরও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা আন্তরিক। যত দ্রুত সম্ভব রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এভাবে ঢালাওভাবে অভিযোগ করলে হবে না। তাছাড়া এসব বিষয়ে আমি মোবাইলে কথা বলতে ইচ্ছুক না, আপনি (প্রতিবেদক) আমার অফিসে এসে সরাসরি সাক্ষাতে কথা বলতে পারেন।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সুমন মুৎসুদ্দীর কাছে জানতে চাইলে তিনি সিভেয়সকে বলেন, ‘আমি পিএম রিপোর্ট নিয়ে মোবাইলে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নই।’ তখন প্রতিবেদক অফিসে দেখা করার অনুমতি চাইলে এসময় তিনি বলেন, ‘আমি অফিসে সাংবাদিকদের অ্যালাউ করিনা।’ 

তাহলে পিএম রিপোর্ট নিয়ে পুলিশের র্দীঘসূত্রিতার বিষয়ে জাবাব কি- সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে যদি পুলিশ অভিযোগ করে থাকে তাহলে তারা আপনাদের (সাংবাদিক) না বলে আমার কাছে এসে বলতে বলেন।’ 

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বা পিএম রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়ায় তদন্ত কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশীদুল হকও। তিনি সিভয়েসের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘লাশের হয়ে কথা বলে পিএম রিপোর্ট। কিন্তু সেই রিপোর্ট পেতে আমাদের ২৪ ঘন্টা লাগার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় সেটা ২৪ দিনে পাওয়াও দুস্কর। এমনকি ৬ মাস কিংবা এক বছরেও অনেক পিএম রিপোর্ট পাওয়া যায়নি এমনও আছে। তাই সংকটগুলোর সমাধান করে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে যথাযত সময়ের মধ্যে পিএম রিপোর্ট ও এমসি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ 

পোস্টমর্টেমকে বাংলায় কেন ময়নাতদন্ত বলা হয়

ইংরেজি পোস্টমর্টেমকে বাংলায় কেন ময়নাতদন্ত বলা হয়, তা নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। অনেকে বলেন, মূল যোগসূত্র মরদেহ বিশ্নেষণ করে মৃত্যুর কারণ শনাক্তের এই তদন্ত ধারার সঙ্গে বাংলাদেশের সুপরিচিত পাখি ময়নার চরিত্রগত মিল। তাদের মতে, ঘোর কালো বর্ণের হওয়ার কারণে অন্ধকারে ময়না পাখির অবস্থান চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। এ ক্ষেত্রে তার ডাক শুনে বুঝতে হয়। কিন্তু ময়না পাখি ১৩ রকমের ডাক ডাকতে পারে। ফলে অভিজ্ঞ পক্ষীবিশারদই কেবল বুঝতে পারেন, কোনটি আসল ডাক। ময়নার ডাক শনাক্তের মতো অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন অভিজ্ঞ তদন্তকারী। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব, যখন লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ঠিকমতো হয়।

লাশ যেভাবে কথা বলে...

মর্গ থেকে আদালত পর্যন্ত একটা কথা প্রচলিত আছে- লাশ কথা বলে। অবশ্য সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমন উক্তি তখনই ঠিক হয়, যখন লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটাও ঠিকঠাক হয়। এই দুটি প্রতিবেদন ঠিকঠাক হলে মর্গ থেকেই কোনো হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের কাজটা শুরু হয়। কিন্তু দেশে লাশের ময়নাতদন্ত আদৌ কি ঠিকঠাক মতো হচ্ছে? এর উত্তর মিলেছে অনেক ক্ষেত্রেই ‘না’। 

এর বাইরে মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা এবং আদালতে বিচার কার্যক্রমে মামলা নিয়ে লড়াই করা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, মামলার বিচারে সাক্ষ্য-প্রমাণ শুরু হওয়ার সময়ে ধরা পড়ছে অনেক ক্ষেত্রেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটি সঠিক নয়। এতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন বিচারপ্রার্থী।

চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফখরুদ্দীন চৌধুরী সিভেয়সকে বলেন, ‘লাশ তো আর কথা বলতে পারে না। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনই মূলত লাশের হয়ে আদালতে কথা বলে। এগুলোতে অসঙ্গতি ও ভুল থাকায় শেষ পর্যন্ত লাশ আর ‘কথা’ বলে না। অনেক মামলার বিচার চলাকালে সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও অন্যান্য আলামত সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে মেলে না। এতে ভিকটিম পরিবার ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। দোষী হয়েও খালাস পেয়ে যায় আসামি।’

‘এ জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায্য বিচারের জন্য এই প্রতিবেদনগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যেই যাতে পিএম রিপোর্ট ও মেডিকেল রিপোর্ট দিতে হবে। এসব বিষয়ে ফরেনসিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া জরুরী।’- বলেন অ্যাডভোকেট ফখরুদ্দীন চৌধুরী।

এর উদাহরণ দিতে গেলে সামনে আসে ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর লাশ উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে করা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে করা দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসে আঘাতের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে দিয়াজকে। এ থেকে বুঝা যায় ময়না তদন্ত প্রতিবেদনই লাশের হয়ে কথা বলে আদালতে। 

পোস্টমর্টেম কেন করা হয়

অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর কারণ জানার যে চেষ্টা করা হয়, তাকেই পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত বলা হয়। পোস্টমর্টেম শব্দটি অটোপসি, নিক্রোপসি ইত্যাদি দ্বারাও বোঝানো হয়ে থাকে। মৃত্যুর কারণ জানার জন্য পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত করা হয়। কোন ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে বা তার মৃত্যু নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরি হলে, মৃত্যুর সঠিক কারণটি জানার জন্য মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয়, ঠিক কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। 

অনেক সময় শরীরের ভেতরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখা হয়। যেমন ধর্ষণের অভিযোগে সিমেন সংগ্রহ করে ডিএনএ ম্যাচ করা হতে পারে। আবার আত্মহত্যার মতো অভিযোগে ভিসেরা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বোঝা যায় যে বিষ প্রয়োগের কোন ঘটনা ঘটেছে কী না। অনেক সময় কোন ব্যক্তি অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করার পরেও যদি ওই মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, তাহলে তখন যে পোস্টমর্টেম করা হয়, তাকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম।

কীভাবে ময়নাতদন্ত করা হয়

হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার মতো যেকোনো অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে। এ ধরনের ঘটনায় প্রথমেই পুলিশ একটি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। অর্থাৎ মৃতদেহ কী অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর মৃত্যু সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য ময়না তদন্ত করতে পাঠানো হয়। মর্গে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা সেই সুরতহাল প্রতিবেদন দেখে, প্রথমে মৃতদেহের বাহ্যিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেন। সেখানে কোন আঘাত বা ক্ষত আছে কিনা, ত্বক ও জিহ্বার রঙ ইত্যাদি দেখে প্রথম প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। 

এর পরে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভারসহ শরীরের ভেতরটা যাচাই করে দেখা হয়। ফলে শরীরের ভেতরে কোন আঘাত থাকলে, রক্তক্ষরণ বা বিষক্রিয়া থাকলে সেটি চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন। কোথাও আঘাতের চিহ্ন থাকলে সেটি কীভাবে হয়েছে, তা ভালো করে যাচাই করা হয়। এই কাজটি করতে গিয়ে মৃতদেহের নানা অংশ কেটে দেখতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। এ সময় শরীরের নানা প্রত্যঙ্গও সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। ময়নাতদন্ত শেষে মৃতদেহ আবার সেলাই করে আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। তবে শরীরের অভ্যন্তরীণ কোন কোন অংশ কেটে আরো পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারে পাঠানো হতে পারে।

ময়নাতদন্ত থেকে কি জানা যায়

ময়নাতদন্তে বেশ কয়েকটি বিষয় জানার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বিষয় হলো, মৃত্যু কীভাবে হয়েছে এবং কখন মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কিনা, আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে কিনা, বিষ খাওয়ানো হয়েছে কিনা, রক্তক্ষরণের কোন ঘটনা আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ও ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসে।

-সিভয়েস/এডি/এএ

আলম দিদার

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়