Cvoice24.com

একটি অভিশপ্ত জাতি এবং কিছু ওয়ার সিমেট্রির গল্প

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০
একটি অভিশপ্ত জাতি এবং কিছু ওয়ার সিমেট্রির গল্প

ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি সারা দেশে ৯৪২টি বধ্যভূমির খোঁজ পায়। কমিটির চেয়ারম্যান ড. এমএ হাসান অবশ্য বলেছেন, এ হিসাব অসম্পূর্ণ। বধ্যভূমির সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কিছুদিন আগে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ এক লেখায় বলেছেন— ‘বাংলাদেশে ছোট-বড় বধ্যভূমির সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে।’ এখানে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি তাদের গবেষণায় সারা দেশে যে ৯৪২টি বধ্যভূমি খুঁজে পায় তার মধ্যে ১১৬টিই রয়েছে চট্টগ্রামে। 

বধ্যভূমির সংখ্যা যদি হয় তিন হাজারের অধিক, আর প্রতিটাতে এক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়; তাহলে ১৯৭১ সালে শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় তিরিশ লাখেরও ওপরে। অথচ আমরা দেখতে পাই, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমির একটি গণকবরের কেবল একটা গর্ত থেকেই এগারোশ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়েছে। ওই বধ্যভূমিতে এরকম গর্ত ছিল একশোটির মতো। তাহলে একবার কল্পনা করুন তো— একা পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল? 

প্রিয় পাঠক একটু ধারণা করে বলুন তো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা তাহলে কত? নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে, মুক্তিযুদ্ধে নিহত সবাই বধ্যভূমিতে মারা পড়েননি। পাকসেনা এবং তাদের দোসরেরা আমাদের মেরেছে ঘরে ঘরে গিয়ে। শত-শত, হাজার-হাজার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শরণার্থী শিবিরে কলেরায়-ডায়রিয়ায়া মারা পড়েছে লাখ লাখ শিশু। যুদ্ধের প্রভাবে দেশের ভেতরে খাদ্যের অভাবে, ওষুধের অভাবে, চিকিৎসার অভাবে কত মানুষ মারা গেছে তার কি কোন হিসাব আছে? তারপরেও এদেশের অনেক মানুষ স্বীকার করতে চায় না, মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক।

আমাদের দেশের কিছু স্থানে ওয়ার সিমেট্রির খোঁজ পাওয়া যায়। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি এবং কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। ওয়ার সিমেট্রি হচ্ছে— কমনওয়েলথ যুদ্ধসমাধি। ১৯৪১-১৯৪৫ সালে সংগঠিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ৪৫ হাজার কমনওয়েলথ সৈনিক নিহত হন, তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই সমাধিক্ষেত্রগুলো তৈরি করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। বাংলাদেশেও অফিসিয়ালি বড় আকারে দুটি কমনওয়েলথ রণসমাধিক্ষেত্র। যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের প্রতি সম্মান জানাতে প্রতিবছর প্রচুর দর্শনার্থী সেগুলোতে আসেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সশস্ত্র বাহিনীর নিহত ৭৫৫ সদস্য চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রির সমাধিক্ষেত্রে শায়িত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৭৮, কানাডার ২৫, অস্ট্রেলিয়ার নয়, নিউজিল্যান্ডের দুই, অবিভক্ত ভারতের ২১৪, পূর্ব আফ্রিকার ১১, পশ্চিম আফ্রিকার ৯০, মিয়ানমারের দুই, নেদারল্যান্ডসের এক, জাপানের ১৯ এবং বেসামরিক চারজন রয়েছেন।
 
কুমিল্লায় আছেন যুক্তরাজ্যের ৩৫৭, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের চার, দক্ষিণ আফ্রিকার এক, অবিভক্ত ভারতের ১৭৮, রোডেশিয়ার তিন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, মিয়ানমারের এক, বেলজিয়ামের এক, পোল্যান্ডের এক ও জাপানের ২৪ জন। সর্বমোট ৭২৩ জন যাদের, অনেকের পরিচয় জানা যায়নি। প্রতি বছর একবার সব ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে একটি বার্ষিক প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়। 

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির প্রবেশমুখে একটি তোরণ ঘর, যার ভিতরের দেয়ালে সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলায় লিপিবদ্ধ করে একটি ফলক লাগানো রয়েছে। প্রশস্ত পথ, যার দুপাশে সারি সারি কবর ফলক। সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবীর পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টানদের কবর ফলকে ক্রুশ, মুসলমানদের কবর ফলকে আরবি লেখা (যেমন : হুয়াল গাফুর)। সোজা সম্মুখে রয়েছে সিঁড়ি দেওয়া বেদী, তার উপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিস্টধর্মীয় পবিত্র প্রতীক ক্রুশ। বেদীর দুপাশে রয়েছে আরো দুটি তোরণ ঘর। সেগুলো দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পিছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরো বহু কবর ফলক। 

প্রতি দুটি কবর ফলকের মাঝখানে একটি করে ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া পুরো সমাধিক্ষেত্রেই রয়েছে প্রচুর গাছ। সম্মুখ অংশের প্রশস্ত পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ২৩টি ফলক দিয়ে সেই স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। ওই স্থানটি ছিল মূলত ২৩ জন বিমানসৈনিকের একটি গণকবর, যেখানে লেখা রয়েছে— ‘These plaques bear the names of twenty three Airmen whose remains lie here in one grave.’ 
(ওয়ার সিমেট্রি সম্পর্কিত তথ্যগুলো পেয়েছি উইকিপিডিয়া, অফরোড বাংলাদেশ ওয়েবসাইট এবং কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে।)
 
আপনি যখন চট্রগ্রামের কিংবা কুমিল্লার ওয়ার সিমেট্রিগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে আসবেন ভেতরে একটা ভয়াবহ হাহাকার এসে ভর করবে। দেশের নানান প্রান্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষদের কবরগুলো অত্যন্ত যত্নের সঙ্গেই সংরক্ষণ করা হয়ে আসছে। আমি আমার শৈশবে সিলেটেও এরকম কিছু কবরের খোঁজ পেয়েছিলাম। এসব জায়গা এমনভাবে রাখা হয় যে, আপনা থেকেই শ্রদ্ধা চলে আসে।

হায়রে আমার অভাগা জাতি। হাজার হাজার বধ্যভূমি অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে, কারো একবার মনে হয় না— ‘যাই একটু ঘুরে আসি’। বছর বছর এই অভাগা শহীদদের জন্য লোক জড় হয়ে প্রার্থনা করা হয় না। তাদের শ্বেত কবরফলকে লেখা থাকে না বীরত্বের ইতিহাস। প্রবেশমুখে থাকে না কোনো তোরণ। অল্পকিছু বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে পেরেছি আমরা, যেটা মোটের ওপরে একশভাগের একভাগ কিংবা তারও কম। আমি মাঝেমাঝে চিন্তা করি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ২৩ বিমানসেনাকে একটি কবরে দেখে আমাদের মধ্যে যে হাহাকার তৈরি করে, পাহাড়তলী বধ্যভূমির একটা গণকবরে এগারোশ মাথার খুলি আছে— সেই কথা জেনে আমাদের মাঝে কতোটা হাহাকার তৈরি করা উচিত? 

এই দেশের মানুষ দল বেঁধে সাজানো গোছানো ওয়ার সিমেট্রিতে ঘুরতে যায়, শ্বেত-পাথরের মর্মরফলকে দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। কিন্তু এরাই মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে বিরক্ত হয়ে যায়, তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। এক ক্যাসেট নাকি তাদের আর ভালো লাগে না, একই প্যাচাল শুনতে শুনতে তাদের কান পচে গিয়েছে! ৩০ লক্ষ শহীদ আমাদের কাছে কেবল একটা সংখ্যা। কতোটা রক্ত, কতোটা কষ্ট, কতোটা যন্ত্রণায় ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়, সেটা আমাদের জাতির ধারণায় নেই।

মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা গবেষক

আরিফ রহমান

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়