Cvoice24.com


বিশ-বিষের আঁধারে ঢাকা জ্ঞানের আলো

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০
বিশ-বিষের আঁধারে ঢাকা জ্ঞানের আলো

নানা ঘটন-অঘটনের মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত ছিল শিক্ষাখাত

প্রবাদ আছে— শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। কিন্তু পুরো পৃথিবীর মানুষ্য সমাজই যেন কাটালো কয়েক শতাব্দীর সবচেয়ে বাজে বছর, ২০২০। নানা ঘটন-অঘটনের মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত ছিল শিক্ষাখাত। বিষকাঁটায় বিদ্ধ হয়েছে শিক্ষাঙ্গন। একদিকে স্কুল খুললে সংক্রমণের আশঙ্কা। অন্যদিকে স্কুলে না যাওয়ার একাধিক নেতিবাচক ফল। দুইয়ের মাঝে দোদুল্যমান দেশের অগণিত ছেলেমেয়ের শিক্ষার ভবিষ্যৎ। 

অভিভাবকরাও একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমন এক আতঙ্কের আবহে গুছিয়ে ভাবার মতো অবস্থাও থাকে না। তাই অনেকেই বলছেন— শিক্ষা বড়, না জীবন? কিন্তু যখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে, তখন হয়তো তারাও অনুধাবন করবেন— শিক্ষার থেকে যেমন জীবন বড়, তেমনই যথাসময়ে যথাযথ জ্ঞানের আলো না জ্বালাতে পারলে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সেটা অনেক প্রতিকূল হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে কোনো ঝুঁকিই নিতে চায় না সরকার। তাই বছর শেষ হলেও খুলে দেওয়া হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আপাতত পড়াশোনা হোক ঘরে থেকেই। 

দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকেই অর্থাৎ গত ১৭ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় সরকারি নির্দেশে । দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে সেই সময়সীমা। সর্বশেষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ থাকবে সব স্কুল-কলেজ। এ পরিস্থিতিতে দেশের উচ্চশিক্ষাসহ সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীই পার করছে এক সংকটময় জীবন। অনেকে তো পড়ালেখাই ছেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অসংখ্য শিক্ষক-কর্মচারী। পেটের টানে লজ্জার আবরণ সরিয়ে রাস্তার ধারে ফল কিংবা সুরক্ষা সরঞ্জামও বিক্রি করেছেন শিক্ষক। আবার লকডাউনকালে অন্ধকারে মুখ ঢেকে খাবারের জন্য হাতপাততেও বাধ্য হন কেউ কেউ। তিন শিক্ষক তো পথ হারিয়ে আত্মহত্যাই করে বসেন। ভাড়া দিতে না পেরে বিদ্যালয় বিক্রির বিজ্ঞাপনও বিদ্ধ হয়েছে কোমল হৃদয়। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয় অটোপাস পদ্ধতি।

এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল ও অটোপাস  

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) বা সমমান। পরীক্ষায় না বসেই করোনার কৃপায় এবার ইতিহাস গড়ে সবাই পাস! এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় । জেএসসিতে ২৫ এবং এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে। তবে যাদের জেএসসি ছিল না তাদের ফল তৈরি করা হবে এসএসসি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরকেই শতভাগ ধরে। অর্থাৎ কেউ আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে এইচএসসিতেও আসবে সেই ফল। বিষয়ভিত্তিক ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই সূত্র অনুসরণ করতে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে এইচএসসির ফলাফল তৈরি করতে বেশ বেগই পেতে হচ্ছে মন্ত্রণালয়কে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির ঘোষণা অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বরের আগেই ফলাফল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে ফল প্রকাশের জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি না করায় সেটি আটকে যায়। তাই সবকিছু ঠিক করে এইচএসসির ফলাফল জানুয়ারিতে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

দেশের ১১টি বোর্ডে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ শিক্ষার্থীর এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। আর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের তথ্যমতে, এই অঞ্চলের ২৭৪টি কলেজ থেকে মোট ৯৭ হাজার ৯০৫ শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় বসার জন্য ফরমপূরণ করেছিল। এর মধ্যে ছাত্র ৪৭ হাজার ৮৬৭ এবং ছাত্রী ৫০ হাজার ১৮ জন। 

বাতিল হয় পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা 

করোনার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাও হয়নি চলতি বছর। একই সঙ্গে বাতিল করা হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (ইইসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। এবার এবার পিইসিতে প্রায় ৩২ লাখ শিক্ষার্থী ছিল। অন্যদিকে জেএসসি-জেডিসিতে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ লাখ। 

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে অটো প্রমোশন ও সংক্ষিপ্ত পাঠ পরিকল্পনা

দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বছরজুড়ে বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। তাই নিরূপায় হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীই পরের শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। তবে পাঠদানের ঘাটতি পূরণে সব শ্রেণির জন্যই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সংক্ষিপ্ত পাঠ পরিকল্পনার। শিক্ষার্থীদের কিছুটা ব্যস্ত ও পাঠমূখী করার জন্য শিক্ষা অধিদপ্তর অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবস্থা চালু করে। সে অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে একটি করে অ্যাসাইনমেন্ট জমার নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। সেগুলো মূল্যায়ন করেই পরবর্তী ক্লাসে তাদের ঘাটতিগুলো পূরণের চেষ্টা করা হবে।

করুন দশা কিন্ডারগার্টেনগুলোর

শিক্ষক যখন ‘ভ্যানচালক’, ‘ফল বা তরকারি বিক্রেতা’, কিংবা ‘রাজমিস্ত্রির জোগালি’— তখন লজ্জিতই হতে হয়। কারণ তারাই তো জাতির মেরদণ্ড তৈরির কারিগর। আজ তাদেরই শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর জো নেই। করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে শিক্ষার্থীদের বেতনের উপর নির্ভরশীল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছেন না কিন্ডারগার্টেনগুলোর শিক্ষকরা। ভাড়া দিতে না পেরে বিদ্যালয় বিক্রির বিজ্ঞাপন দিতেও দেখা যায়। জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে টিকে থাকতে করছেন পেশা বদল।  

লকডাউন ও চলমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে চট্টগ্রাম নগরীরই প্রায় ১১শ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৪ হাজারের মতো শিক্ষক বেকার হয়ে পড়েন। কোনো আয় না থাকায় তাদের বেতন, বাড়ি ভাড়া ও বিদুৎ বিল দিতে পারছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ। ফলে নগরীতে জ্ঞানের আলো ছড়ানো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আবার শিক্ষা বোর্ডের অধিনস্থ না থাকায় এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষা ও পাঠগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।  

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিকল্প হিসেবে অনলাইনে পাঠদানের ব্যবস্থা করে সরকার। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও জুলাই থেকে চালু হয় অনলাইন ক্লাস। তবে এর সুফল পুরোপুরি পাওয়া যায়নি বলেই ধারণা করেছেন দেশের শিক্ষাবিদরা। শহরাঞ্চলে অনলাইনে পাঠগ্রহণের সুযোগ পেলেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা তাতে বঞ্চিত। চড়া দামের পাশাপাশি দুর্বল ইন্টারনেটের সংযোগের কারণেই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অনলাইন পাঠের বাইরে ছিল। তবে প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে সরকার সংসদ টেলিভিশন ও রেডিওতে দূরশিক্ষণ পাঠদানের ব্যবস্থা করে।  

উচ্চশিক্ষায় জট ও বেকারত্ব

করোনা মহামারির কারণে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য চরম হতাশার ছিল বছরটি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়েছেন সেশনজটের হুমকিতে। সবচেয়ে বিপাকে অনার্স শেষবর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা। এ বছর সরকারি ব্যাংক নিয়োগসহ কোনো সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাও নেওয়া হয়নি করোনার কারণে। আইএলও তথ্যমতে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছে এই মহামারিতে। 

এদিকে এইসএসসির ফল না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব হয়নি বিদায়ী বছরে। এই পরীক্ষা কবে নেওয়া হতে পারে সে বিষয়েও অনিশ্চিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

-সিভয়েস/এইচবি 

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়