Cvoice24.com


লাশকাটা ঘরে ২৫ দিন, অবশেষে বাবার কোলে নিথর লাকিং

প্রকাশিত: ১৪:০২, ৪ জানুয়ারি ২০২১
লাশকাটা ঘরে ২৫ দিন, অবশেষে বাবার কোলে নিথর লাকিং

আইনি জটিলতা শেষ করে দীর্ঘ ২৫ দিন পর হাসপাতাল মর্গ থেকে আলোচিত লাকিং মে চাকমার (১৫) লাশ গ্রহণ করেছে পরিবার। সোমবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের রামুর কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ মহাশ্মশানে সমাহিত করা হয় লাকিং মের লাশ। এ সময় মা–বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

লাশ বুঝে নেওয়ার পর কক্সবাজারের টেকনাফ শিলখালী চাকমা পাড়ার লাকিং মে চাকমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে না বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্বজনেরা। কারণ, সেখানে সৎকার করলে প্রতিপক্ষের লোকজন লাশ তুলে ফেলার আশঙ্কা ছিল তাদের। যে কারণে লাশটি রামুতে সমাহিত করা হয়।

এর আগে পিতা লালা অং চাকমার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে লাশটি তুলে দেয়া হয়। লাকিংমে চাকমার লাশ হস্তান্তরকালে র‌্যাব-১৫ এর উপ-পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অঞ্জন চৌধুরী, সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মোহাম্মদ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

গত বছরের (২০২০ সাল) ১৩ জানুয়ারি আদালতে করা মামলায় লাকিং মে চাকমার বাবা লালা অং চাকমা অভিযোগ করেন, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া তার মেয়েকে অপহরণ করেছে টেকনাফের আতাউল্লাহ। সেই মামলার তদন্ত চলাকালে ১৫ ডিসেম্বর খবর পান- লাকিং মের লাশ পড়ে আছে হাসপাতালের মর্গে। মেয়ের লাশ নিতে গিয়েও পড়েন বিপত্তিতে। অপহরণ, নাবালিকার বিয়ে এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত আতাউল্লাহ  বাঁধ সাধলেন। নিজেকে লাকিংমে চাকমার স্বামী দাবি করে লাশ নেওয়ার আবেদন করেন তিনি। ফলে এই আবেদন গড়িয়েছে আদালতে। সেই পটভূমিতে তদন্ত সাপেক্ষে মৃতের ‘ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত’ হয়ে র‌্যাবকে মরদেহ সৎকার করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। 

তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র‌্যাবকে। বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে লাকিং মে চাকমাকে ‘শিশু’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তদন্ত কর্মকর্তা অঞ্জন চৌধুরী। বিষয়টি তিনি আদালতে অবহিত করেন। পরে বিধি মোতাবেক লাশটি পরিবারের নিকট হস্তান্তরের প্রক্রিয়া করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, মূলত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়ে লাকিং মে চাকমাকে তুলে নিয়ে ধর্মান্তরিত করে আতাউল্লাহ নামের যুবক বিয়ে করেছেন বলে পরিবারের অভিযোগ, থানা মামলা না নিলে তার পরিবারের আদালতে যাওয়া, পুলিশের প্রতিবেদনে মেয়েটির স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ার কথা, মেয়েটিকে নিজের স্ত্রী হালিমাতুল সাদিয়া দাবি করে লাশ ফেরত চাওয়া, জন্মদাতার দাবি নিয়ে মেয়ে লাকিং মের শেষকৃত্য করতে বাবার আবেদন সবকিছুর ঊর্ধ্বে এ নিথর দেহ। আইনি জটিলতার পরও অন্তত লাশটি পেয়ে প্রশাসন ও গণমাধ্যকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে লাকিং মে চাকমার বাবাসহ স্বজনেরা। 

বাবা লালা অং চাকমার দাবি, ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি তাঁর মেয়ে লাকিং মেকে অপহরণ করা হয়। ওই দিন তিনি কক্সবাজারের টেকনাফে শীলখালীর চাকমাপাড়ায় নিজের বাড়িতে ছিলেন না। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে স্থানীয় শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। বাড়ি ফিরে জানতে পারেন মেয়েকে অটোরিকশায় করে তুলে নিয়ে যান টেকনাফের বাহারছড়া মাথাভাঙ্গা এলাকার আতাউল্লাহ, ইয়াসিন, ইসা, আবুইয়াসহ আরও চার-পাঁচজন। জন্মসনদ অনুসারে ওই দিন মেয়ের বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। তিনি বিষয়টি ওই দিনই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে জানান। কিন্তু ইউপি সদস্য কোনো ব্যবস্থা নেননি। 

তখন লালা অং চাকমা টেকনাফ মডেল থানায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ (অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বরখাস্ত) মামলা নিতে রাজি হননি। ২৭ জানুয়ারি তিনি কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেন।

পিবিআই গত বছরের ৯ আগস্ট কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, লাকিং মে চাকমাকে অপহরণ করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে অন্তত পাঁচজন সাক্ষী জবানবন্দিতে লাকিং মেকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন বলে মেয়েটির বাবার দাবি।

এমন দাবির বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ক্যশৈনু মারমার ভাষ্য, ‘এজাহারে যে পাঁচজনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে, তারা লাকিংমের আত্মীয়। সাক্ষী ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। ওই পাঁচজন সাক্ষী ছাড়া এলাকার আর কেউ অপহরণের কথা বলেনি। ফলে আমি তদন্ত প্রতিবেদনে লাকিংমে নিজেই চলে গেছে বলে উল্লেখ করেছি।’

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়