Cvoice24.com

গৌরবের ৫৭ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০১:৪২, ১৮ নভেম্বর ২০২২
গৌরবের ৫৭ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি)। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে সুদীর্ঘ ৫৬ বছর পূর্ণ করে ৫৭’তে পা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। পথচলায় নানা অর্জন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদানের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ‘শাটল ট্রেন’র ক্যাম্পাসটি।

শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) দিবসটি উদযাপনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সেজেছে বর্ণিল সাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনাগুলোতে করা হয়েছে আলোকসজ্জা। দিনব্যাপী নানা আয়োজনে রয়েছে র‍্যালি, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, কেক কাটা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠার দিন থেকে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসার নয়, ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ৫৭ বছরের পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্তির ঝুড়ি যেমন অনেকটা পূর্ণ হয়েছে, তেমনই কিছু অপ্রাপ্তির বোঝা এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

যাত্রাটা যেভাবে

মাত্র ৮ জন শিক্ষককে নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রথমে চালু হয় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি এ চার বিভাগ। যার অধীনে ছিল মাত্র ২০৪ জন শিক্ষার্থী। তখন প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. আজিজুল রহমান মল্লিক।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। পাঠদানে রয়েছেন ৯০৬ জন গুণী শিক্ষক। এখানে ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ ছাড়াও রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১৪টি আবাসিক হল ও ১টি ছাত্রাবাস রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ছেলেদের ও ৫টি মেয়েদের হল। আবাসিক হল ও হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৭ হাজার আসন বরাদ্দ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে রয়েছে শাটল ও ডেমু ট্রেন।

গুণীজন

বাংলাদেশ থেকে একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। বিশ্বখ্যাত বিশ্বতত্ত্ববিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতবিদ একুশে পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। যিনি শুধুমাত্র দেশের টানে বিদেশের চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক ও শিক্ষাবিদ আবদুল করিম, একুশে পদকজয়ী সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, শিক্ষাবিদ আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরী, কলামিস্ট আবুল মোমেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সাবেক জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অপরাজেয় বাংলার স্থপতি ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদ, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুনসহ দেশ বরেণ্য বহু কীর্তিমান মনীষীর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত এ বিশ্ববিদ্যালয়।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

অপরূপ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ঘন পাহাড় আর সবুজের আচ্ছাদন যেন নীল আকাশ ছুঁয়ে যায়। পাহাড়, ঝরণা, লেক, আর স্বতন্ত্র জীববৈচিত্র্য এ ক্যাম্পাসকে করেছে অতুলনীয়। ক্যাম্পাসের প্রতিটি জায়গা যেন এক একটি পর্যটন স্পট। ফরেস্ট্রি ইনস্টিটিউটের সাজানো রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি, পাশে লেক, অসাধারণ প্রশাসনিক ভবন হ্যালিপ্যাড সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে একরাশ মুগ্ধতা। ৬০ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বোটানিক্যাল গার্ডেন দর্শনার্থীদের জন্যে চমৎকার এক বাড়তি পাওনা। কলা অনুষদের পেছনে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা প্রাকৃতিক ঝরণার শীতল পানি পর্যটন পিয়াসী মানুষকে বিমোহিত করে তুলে।

ষড়ঋতুর ক্যাম্পাস

ছয়টি ঋতুর এক আশ্চর্য লীলা নিকেতন এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত— এ ছয়টি ঋতুর আবির্ভাবে নানা সাজে বিভিন্ন রঙে বিচিত্ররূপ ধারণ করে এখানকার চারপাশের প্রকৃতি। বাংলার ষড়ঋতুকে সত্যিকারভাবে উপভোগ করতে হলে দ্বিধাহীনভাবে ছুটে যেতে হবে এই ক্যাম্পাসে। প্রত্যেকটি ঋতুর যে অপূর্ব মেলবন্ধন তা লিখে বোঝানো যাবে না শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় এখানে।

গ্রীষ্মের প্রখর তাপদাহের মাঝেও সুশীতল বাতাস, নানান ফলের সম্ভার, বর্ষায় আষাঢ়ের জলধারার চিরচেনা সবুজাভ প্রকৃতি, শরতের শেষ বেলায় সাদা মেঘের ভেলা আর শুভ্র জ্যোৎস্না ও পুষ্প সুষমা, শিশিরে ভেজা মাতাল হেমন্ত, শীতে সাদা কুয়াশার চাদর, নবপল্লবে সুশোভিত বসন্ত-ষড়ঋতুর এমন ছয় রঙে চবি ক্যাম্পাসে রঙিন হয়ে উঠার জন্যে বছরজুড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যকর্মে বাঙালির বিজয়গাঁথা ইতিহাস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পীর নজরকাড়া সব স্থাপত্যকর্ম। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত এসব শিল্পকর্ম সবাইকে বিমোহিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের গৌরবমাখা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ভাস্কর্যে বাঙালির বিজয়গাথা ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দু’টি স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রচেষ্টায় স্থাপন করা হয় স্বাধীনতা ভাস্কর্য। একই বছর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর নকশায় নির্মিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। ২০০৯ সালে স্থাপিত হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’র স্থপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কলাভবনের সামনে নির্মাণ করা হয় স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য। দেশের একমাত্র স্টিলের তৈরি এ ভাস্কর্যটির স্থপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযয়ের সাবেক অধ্যাপক প্রখ্যাত শিল্পী মর্তুজা বশীর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরের মধ্যবর্তী চৌরাস্তার মধ্যখানে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে। লাইভ কাস্টিং মেথডে তৈরি করা হয়েছে এ ভাস্কর্যটি, যা বাংলাদেশে প্রথম। ধূসর রঙের আস্তরণে মার্বেল ডাস্ট ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রোদ বৃষ্টিতেও ভাস্কর্য মলিন হবে না। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ২০১৮ সালে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহান। তাঁর সহযোগী ছিলেন মুজাহিদুর রহমান মুসা, জয়াশীষ আচার্য ও তপন ঘোষ। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ ও সমান অংশগ্রহণের বিষয়টি যেমন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের ভূমিকা ও উপজাতি এক নারীর অবয়ব উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথেই সাত মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’ ভাস্কর্যটি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবিদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবন সম্মুখস্ত এ স্মৃতিস্তম্ভের ডিজাইনার চবি চারুকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও একুশে পদক বিজয়ী প্রখ্যাত তাপিশ্রী শিল্পী রশীদ চৌধুরী।

ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চবি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। কাটা পাহাড় রাস্তার মাথায় নির্মিত চবির প্রথম শহীদ মিনারটি ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হলে একইস্থানে বর্তমান শহীদ মিনারটি ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী এ শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের নকশা করেন ‘অপরাজেয় বাংলা’র স্থপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। প্রায় দশ শতক জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গৌরবের অন্যতম নিদর্শনটি।

মুক্তিযুদ্ধে চবির সূর্যসন্তানেরা

মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রায় দুই শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে যখন উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তখনও চবি ক্যাম্পাসের শক্ত ঘাঁটিতে বহাল তবিয়তে ছিল পাকিস্তানিরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হানাদার মুক্ত করতে বিজয়ের নয়দিন পর ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত লড়াই করতে হয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেদের।

মুক্তিযদ্ধে শহীদ হন ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সর্বমোট ১৫ জন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী শহীদ মোহাম্মদ হোসেনকে দেওয়া হয় বীরপ্রতীক খেতাব। চাকসুর প্রথম জিএস এবং ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আব্দুর রব, দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়ুয়া, ইংরেজী বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারী, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ-উদ-দৌলা, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আলাওল হলের প্রহরী সৈয়দ আহমদ, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন খান ও আবদুল মান্নান, বাংলা বিভাগের ছাত্র মুহাম্মদ হোসেন, মোস্তফা কামাল ও মনিরুল ইসলাম খোকা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় এ স্বাধীনতার জন্য।

সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভাবনাময় এক প্রাকৃতিক আধার হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য মতে, এখানে বসবাস করছে ৩০৮ প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। এর মধ্যে পাখি রয়েছে ২১৫ প্রজাতির। ব্যাঙ রয়েছে ১৭ প্রজাতির, সরীসৃপ রয়েছে ৫৬ প্রজাতির ও স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২০ প্রজাতির।

ক্যাম্পাসের অসংখ্য গাছপালা ও তৎসংলগ্ন ঝোপঝাড় যেন বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়াশ্রম। এই অপরূপ জীববৈচিত্র্যের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যপ্রাণীরা যেভাবে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় সেটা বিশ্বের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না। বন্যশূকর, সজারু, বনরুই, মায়া হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ অন্যান্য প্রাণীর দেখা মেলে। ক্যাম্পাসে হাঁটলে বিরল প্রজাতির গিরগিটি ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী চোখে পড়ে। 

ক্যাম্পাস যেন পাখির রাজ্য। বন মোরগ, মথুরা, সবুজ তাউরা, কাঠ শালিক, রেড হেডেড, ভীমরাজ, হাঁড়িচাচা, কানাকোয়া, কাবাসি, চন্দনা টিয়া, মদন টিয়া, কানাকুয়া, শিষধামা, হলদে বক, মালকোহা, পাকড়া মাছরাঙা, বসন্ত বাউরি, রুপাস নেকড, বেনেবউ এবং মৌটুসীসহ ২১৫ প্রজাতির পাখি রাজত্ব করে এই ক্যাম্পাসে। ২১৫ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১০৮টি গায়ক ও ১০৭টি অগায়ক পাখি। এগুলোর মধ্যে আবার ১৬০টি প্রজাতির পাখির স্থায়ী নিবাস ক্যাম্পাসেই। ৫১টি অতিথি পাখি হিসেবে বিভিন্ন মৌসুমে ক্যাম্পাসে আসে, আবার চলে যায়। চার প্রজাতির পাখি মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে প্রাণীর আরেক অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ২০ প্রজাতির বেশি প্রাণী এই ক্যাম্পাসের বাসিন্দা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য বিরল প্রজাতির গাছ-গাছালি আর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজের হাতছানি। পাহাড়ের ওপর ফুল, ফল আর কাঠ জাতীয় গাছের শোভা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে পাহাড় ও পাহাড়ি বন আছে ২৫০ একর জায়গায়। ৬০০ একরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সৃজিত বন। ১৫০ একর ভূমির মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ উদ্যান।

আছে সমস্যা-সংকট

এতকিছুর মাঝে সমস্যাও কম নয়। ১৯৮৮ সাল থেকে শাটলট্রেন চলাচল করলেও ঝুঁকিপূর্ণ রেল লাইন পুরনো বগি দিয়ে চলছে শিক্ষার্থীদের প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা। বছরের পর বছর শিক্ষার্থী বাড়লেও এ খাতে উন্নতি হয়নি। শুধু বেড়েছে শিক্ষার্থীদের ট্রেনে গাদাগাদি আর হাসফাঁস। এখনো শতভাগ আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়। মাত্র ১৯ শতাংশের মত আবাসিক সুবিধা পায় শিক্ষার্থীরা। হলগুলোতে বেশিরভাগ কক্ষ ও খাবারের মান ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে আবাসিক শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। হলে কক্ষ না পেয়ে বাকি শিক্ষার্থীরা আবাসিক সুবিধা নিতে জিম্মি হয়ে পড়েছে নিম্নমানের কটেজগুলোয়। ছেলেদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল দীর্ঘদিন আগে উদ্বোধন হলেও এখনো চালু না করে নির্মাণ কাজ চলছে। তবে এ খাতে প্রশাসনের চেষ্টা কিছুটা আশাব্যঞ্জক।

এছাড়া ৩২ বছরেও হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ছয়বার হয়েছে চাকসু নির্বাচন। এজন্য সবসময় ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য থেকেছে ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় এসব সংগঠনের কার্যক্রম কার্যত পরিহাসের নামান্তর। এত পাওয়া না পাওয়ার মাঝে শিক্ষার্থীরা অভাব বোধ করছেন একটি ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), একটি সুইমিংপুল এবং সর্বপরি তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন।

৫৭ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেকবার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি। প্রাণ গেছে ১৮জন শিক্ষার্থীর। কিছুদিন যেতে না যেতেই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য, সংঘর্ষ আর হানাহানি, টেন্ডারবাজী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে নেতিবাচক খবর হিসেবে গণমাধ্যমে এসেছে বেশিরভাগ সময়। এত কিছুর পরও এগিয়ে চলছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

-সিভয়েস/এমআর

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়