কোটা সংস্কার আন্দোলন
বহদ্দারহাট ঘিরেই সহিংসতা যে কারণে…
মিনহাজ মুহী, সিভয়েস২৪
চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চলেছে নগরের বহদ্দারহাট এলাকায়। পুলিশ বক্সে দেওয়া হয় আগুন। চান্দগাঁও থানায় হয়েছে হামলা। পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয়ে ভাঙচুর করে আগুনে পোড়ানো হয়েছে মোটরসাইকেল-সরকারি গাড়ি। পড়েছে লাশ। প্রশ্ন ওঠেছে, ষোলশহর-দুই নম্বর গেট- টাইগারপাস মোড় থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কীভাবে হঠাৎ বহদ্দারহাট-নতুনব্রিজ অভিমুখী হলো? সহিংসতার জন্য সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাই বা কারা বেছে নিল?
নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, ‘চকবাজার, বৃহত্তর বাকলিয়া, রাহাত্তারপুল, বহদ্দারহাট, শমসেরপাড়া, বাড়ইপাড়া, শুলকবহর, চান্দগাঁও মোহরা এলাকায় শিবিরের আস্তানা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের হাতে যখন আন্দোলন ছিল তখন তারা ষোলশহর-দুই নম্বর গেট-টাইগারপাসমুখী ছিল। পরে আন্দোলনে বিএনপির সমর্থনে ছাত্রশিবির স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের ঘাঁটি বহদ্দারহাট এলাকার দিকে নিয়ে গেছে। যার প্রমাণ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা টার্গেট করে হামলা-নাশকতা।’
শুরুতে ছাত্রদের আন্দোলন সহিংস ছিল না উল্লেখ করে নগর ১৪ দলের সমন্বয়ক সুজন আরো বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলনে জামায়াত-শিবির আস্তে আস্তে বাংলা ব্লকেড নাম দিয়ে প্রবেশ করে। ছাত্ররা বড় বড় বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে। কিন্তু সড়ক অবরোধ করেনি। যখনই সরকার ছাত্রদের সাথে একটি সমাধানে যাবে; তখনই ছাত্রশিবির ছাত্রদের সামনে রেখে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তারা সন্ত্রাস করে, সংঘাত-সংঘর্ষ করে, আগুন দিয়ে, অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চেয়েছে।’
বহদ্দারহাট এলাকার বহদ্দারবাড়ির বাসিন্দা এবং নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদও দিয়েছেন একই ইঙ্গিত। তিনি বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পুঁজি করে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা মাঠে নেমেছে। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশবিরোধী চক্র বিএনপি-জামাত-শিবির পরিকল্পনা করে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে।’
স্থানীয় শুলকবহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং নগর জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান হেলালী বাদুরতলা আরাকান হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা। বহদ্দারহাটের সহিংসতায় জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে কথা বলতে শনিবার হেলালীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তাঁর সাড়া মেলেনি।
এরশাদ উল্লাহর ‘সক্ষমতা’ দেখাতেই সহিংসতা!
এদিকে নগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ নতুন দায়িত্ব পেয়েই তার ‘সক্ষমতা’ দেখাতে জামায়াত-শিবিরকে দিয়ে বহদ্দারহাট এলাকায় সহিংসতা করিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, ‘এরশাদ উল্লাহ সাহেব নগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক হয়েছেন। তাকে তো কিছু একটা করে দেখাতে হবে। আসলে এরা তো জন্মগতভাবে স্বাধীনতাবিরোধী। ওর বাবাও রাজাকার ছিল। নতুন আহ্বায়ক হয়ে আগের আহ্বায়কের চেয়ে নিজেকে একটু শক্ত-সমর্থ প্রমাণ তো করতে হবে। তাই এসব সহিংসতা, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে এরশাদ।’
সুজন আরো বলেন, ‘এখন বিএনপির তারেক রহমান জামাত-শিবিরের সঙ্গে যেসব বিএনপি নেতার সম্পর্ক নেই; তাদের কমিটি থেকে বাদ দিচ্ছেন। আর যাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তাদের কমিটিতে রাখা হচ্ছে; যাতে জামাত-শিবির-বিএনপি একসঙ্গে কাজ করতে পারে। তাই দেশে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সহিংসতায় বিদেশি সংযোগও থাকতে পারে।’
-এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে সম্প্রতি দায়িত্ব পাওয়া নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর মোবাইল ফোনে শনিবার একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে এ প্রসঙ্গে নগর বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘এই যে ছাত্র আন্দোলন; এটা মেধাবী ছাত্রদের আন্দোলন, সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। এখানে বিএনপির কোনো কিছু ছিল না। গত ১৫ জুলাই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ যে হামলা করেছে, এরপরই আন্দোলনে সহিংসতা শুরু হয়।’
ছাত্রদের আন্দোলনকে শুধু সমর্থন দিয়েছে বিএনপি –এমনটি উল্লেখ করে ইদ্রিস আলী বলেন, ‘কারণ ছাত্ররা যৌক্তিক আন্দোলন করছে, ন্যায্য আন্দোলন করছে। কেন্দ্র থেকেও আমাদের কোনো নেতাকর্মীকে বলা হয়নি যে, ছাত্রদের সহযোগিতা করতে বা মিছিলে যেতে। ছাত্রদের আন্দোলনে মাঠে থাকার জন্য বিএনপির কোনো সাংগঠনিক নির্দেশনাও ছিল না।’
ইদ্রিস আরো বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলন-মিছিলে চট্টগ্রাম বিএনপির কেউ যায়নি। তবে আমাদের পার্টি করে; কিন্তু বিভিন্ন কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে। এমন কেউ সাংগঠনের কর্মী হিসেবে নয়; ছাত্র হিসেবে আন্দোলন গেছে। মূলত তারা তো রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়; কলেজের ছাত্র হিসেবে গিয়েছে।’
‘কোটা সংষ্কার আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় বিএনপির কোনো সম্প্ক্ততা নেই। প্রশাসন ও সরকারদলীয় লোকেরা নাশকতা করে এখন হত্যাকাণ্ড এবং সহিংসতার দায় বিএনপির ওপর চাপাচ্ছে’-যোগ করেন নগর বিএনপি নেতা মো. ইদ্রিস আলী।
প্রসঙ্গত, এরশাদ উল্লাহর বাড়ি চান্দগাঁও থানার মোহরা এলাকায়।
সরকারবিরোধী গোষ্ঠির সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে নিশ্চিত নগর পুলিশ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, চট্টগ্রামে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে; এর নেপথ্যে সরকারবিরোধী একটি গোষ্ঠির সংশ্লিষ্টতা আছে— এটা নিশ্চিত। একটি সূত্রে জানা গেছে, নগরের চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, শুলকবহর, চান্দগাঁও আবাসিক, শমসেরপাড়া, বাড়ইপাড়া, বৃহত্তর বাকলিয়া, রাহাত্তারপুল এলাকায় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা বাসা ভাড়া নিয়ে ‘মেস’ (ছাত্রাবাস) করে থাকেন। তাদের সুবিধার্থেই ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির অজুহাতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি দুই নম্বর গেট, টাইগারপাস থেকে সরিয়ে বহদ্দারহাটের দিকে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে অতর্কিত অগ্নিসংযোগ, হামলা চালানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘আমরা প্রথমদিকে দেখেছি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি একেবারেই অহিংস। শিক্ষার্থীরাও সড়কে শান্তিপূর্ণভাবে বসেছিল। পুলিশও সাথে ছিল। চট্টগ্রামে যেসব সহিংসতা হয়েছে এর নেপথ্যে সরকারবিরোধী একটি গোষ্ঠির সংশ্লিষ্টতা আছে—এটা নিশ্চিত। আমাদের ৬৪ জন পুলিশ আহত হয়েছেন ওই সহিংসতায়। নাশকতাকারীদের টার্গেট ছিল সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ। আমাদের ধারণা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘাতকরা যে লুকিয়ে ছিল তারা তা বুঝতে পারেনি।’
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় বহদ্দারহাট এলাকায় তারা যেভাবে হামলা করেছে এদেরকে দেখে মনে হয়নি এরা শিক্ষার্থী। তবে যে বা যারা এসবের সাথে জড়িত আমরা তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’
তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা প্রথমে ওই দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির শুরুতে নতুন ব্রিজ এলাকায় ছিল। কিন্তু তাদের ভেতরে যে জামাত-শিবির ছিল শিক্ষার্থীরা সেটা বুঝতে পারেনি। আর বুঝার কথাও না। কারণ, শিক্ষার্থীরা মনে করেছিল তাদের মতো ওরাও আন্দোলনে এসেছে। কিন্তু তারা শিক্ষার্থী ছিল না। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল অন্যকিছু।’
সহিংসতায় রুপ দিতেই আন্দোলনের স্থান পরিবর্তন!
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরীর মামলার প্রধান সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। যিনি সিরু বাঙালি নামেই পরিচিত। জানতে চাইলে তিনি সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘সহিংসতা তো ছাত্ররা করেনি। ধ্বংসযজ্ঞ যেসব হয়েছে সেগুলোতে কোনো সাধারণ ছাত্র ছিল না। ছাত্ররা এত হিংসুটে কখনো হবে না। সহিংসতার সময় ছাত্র ছিল হয়তো কিছু। তবে বেশিরভাগই পলিটিক্যাল লোকজন। যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে— তা পলিটিক্যালি পূর্ব পরিকল্পনা।’
নগরের দুই নম্বর গেট থেকে শুরু করে বহদ্দারহাট হয়ে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত এলাকাটা জামাত-শিবিরের ‘ঘাঁটি’ বলে জানান সিরু বাঙালি। তিনি বলেন, ‘শুরুতে ছাত্রদের আন্দোলন ছিল ষোলশহর-টাইগারপাস-দেওয়ানহাট ঘিরে। সহিংসতায় রুপ দিতেই কৌশলে জামায়াত-শিবির আন্দোলনটি নিয়ে যায় ষোলশহর-মুরাদপুর-বহদ্দারহাট এলাকায়। আর সেখানে নিয়ে যাওয়াটা এক ধরনের পরিকল্পনা। কারণ ওইখানেই তাদের আস্তানা। ওদের (জামাত-শিবির) বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে যা আছে সবকিছু ওদিকে।’
‘কারো কপালে তো লেখা ছিল না, তারা জামাত-শিবির, বিএনপি নাকি ছাত্র। কিন্তু কাজকর্মের মধ্যেই তা ফুটে ওঠে। বলা যায়— ছাত্র আন্দোলন থেকে হঠাৎ সহিংসতায় রুপ- এমন কাজ কখনো ছাত্ররা করবে না; করতে পারে না। তাই এমন সহিংসতা ও ধ্বংসজ্ঞের নেতৃত্ব জামাত-শিবির ও বিএনপির দিকেই টানছে। আর যে জায়গায় এমন সহিংসতা হয়েছে ওইসব এলাকা তো তাদেরই ঘাঁটি।’—যোগ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি।
সরকারই তো ওদের সুযোগ করে দিয়েছে
চট্টগ্রামে সহিংসতার জন্য জামায়াত-শিবির ‘অধ্যুষিত’ বহদ্দারহাট এলাকা বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘সুযোগ পেলে তো সেটি যে কেউ কাজে লাগাবে। বলতে গেলে সরকারই সেই সুযোগ করে দিয়েছে।’
ছাত্র আন্দোলনে জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনে জামাত-শিবির বা বহিরাগতদের অবস্থানের কথা আগে থেকেই প্রশাসন জানতে পারল না কেন? এছাড়া ওদের ঠেকাতে সেখানে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের যাওয়ার দরকার কি ছিল!’
তাঁর মতে, ‘ছাত্রদের আন্দোলনে জামাত-শিবির বা অন্য রাজনৈতিক দল থাকতেই পারে। কারণ যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে কেউ কিছু করতে না পারে বা তাদের অধিকার না থাকে; তখন তারা তো সুযোগ খুঁজবে অন্য কারো ব্যানারে মাঠে নামার। সরকারই তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে বাড়ছিল; তখনই প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটার আগেই সরকার চাইলে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো।’
আখতার কবির আরো বলেন, ‘মূলত সহিংসতার শুরুটা সরকারি দলের তৎপরতার কারণেই হয়েছে। রাস্তায় অস্ত্র হাতে ছবি- ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। অহিংস ও শান্তিপূর্ণ একটা আন্দোলনকে মুখোমুখি রক্তের হোলিখেলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর দায় প্রশাসন, পুলিশ কিংবা ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগসন্ধানী সবার। এ অহিংস আন্দোলনের ব্যানারে কেউ যদি ষড়যন্ত্রকারী থাকে; তারা যেমন দায়ী, তেমনি যারা তাদের প্রতিহত করার জন্য রাস্তায় নেমেছে তারাও দায়ী। বলতে গেলে দুপক্ষ দায়ী।’