Cvoice24.com

দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে

প্রকাশিত: ১২:১১, ৭ এপ্রিল ২০১৮
দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে

প্রকৃতিতে রঙিন ফুলের সমারোহ আর দক্ষিণা বাতাসের দোলা জানান দিচ্ছে বসন্তের দাপুটে উপস্থিতি। রঙিন পাতা মেলেছে গাছের ডালে, এ ফাঁকে পলাশ, শিমুল আর আম্রফুলের ছড়াছড়ি। বসন্তের নয়নজুড়ানো প্রকৃতি উৎসবে শামিল কে না চায়! তাই তো বসন্তের রং গায়ে মাখতে আমরা দুটি পাতা একটি কুঁড়ির শহর সিলেটে শিক্ষাসফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। মেঘ, পাহাড় আর ঝরনার সঙ্গে নিজের মনের অনুভূতিগুলো রাঙাতে টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আমরা সপ্তম ব্যাচের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা যাই সিলেটের সব দর্শনীয় স্থানে।

অনেক প্রতীক্ষার পর ব্যস্ততার আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা একঘেঁয়েমি জীবনে চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার কাক্সিক্ষত সে দিনটি এলো। ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় আনন্দযাত্রার শুরুতেই টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্টের দুই শিক্ষক জুনায়েদ হাসান ও সাব্বির আহম্মদ সফরসঙ্গী হওয়ায় আনন্দের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। সেলফিবাজ বন্ধু শাহিনুর, শুভ আর প্রমিজের সেলফিসেশনের পরপরই সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিই। বহু পথ পেরিয়ে সিলেট পৌঁছতে বাজে সকাল ৮টা। এর আগে রাতভর চলন্ত বাসে চলে নন্দ, শিহাব, আক্কাস, সাজু আর আখতারের পরিবেশনায় আনন্দের উন্মাদনা। সকালের নাশতা শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা জাফলংয়ের পানে ছোটে।

জাফলং প্রকৃতিকন্যা হিসেবে সারা দেশে সুপরিচিত। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে প্রাকৃতিক পাথর স্তূপ, স্বচ্ছ শীতল পানি, সীমান্তের ওপারে ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ ও প্রবহমান জলপ্রপাত শিক্ষার্থীদের দারুণ মোহাবিষ্ট করে। এমন পরিবেশে আত্মহারা না হয়ে উপায় আছে! বিকেলে শাহ্জালাল ও শাহ্পরানের মাজার পরিদর্শন শেষে হোটেলে ফেরার পথে জুনায়েদ স্যারের কড়া হুঁশিয়ারিÑ রাতে ঘুম হোক বা না হোক, ভোর ৬টায়ই মৌলভীবাজার অভিমুখে বাস ছাড়বে। তাই পরদিন ভোরে চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে হামহাম জলপ্রপাত দেখার উদ্দেশে যাত্রা শুরু। সকাল ১০টায় আমরা কলাবনপাড়ায় পৌঁছি।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শেষ গ্রাম কলাবনপাড়া। এখান থেকেই শুরু হয় হামহাম ভ্রমণের আসল অ্যাডভেঞ্চার। সাত কিলোমিটার দুর্গম পথে গাইড হিসেবে যুক্ত হলেন স্থানীয় দুজন চা শ্রমিক। পথে পিপাসা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও পাহাড়ে ভর করে হাঁটার সুবিধার্থে বাঁশের তৈরি বিশেষ লাঠি কিনে নিই। যে-কেউ দেখলে ভাববে সজ্জিত এক লাঠিয়াল বাহিনী। বন্ধু শাহাদাত, রাশেদ, লোকমান ও কামরুল লাঠিয়াল বাহিনীর সে দৃশ্য নিমেষেই ফ্রেমবন্দি করে ফেলে। রাজকান্দি বনাঞ্চলের গভীরে কুমারা বন বিটের আকাঁবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি সবাই। দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা সজীব চাকমা ছাড়া আর কারও ছিল না। তীব্র রোদ উপেক্ষা করে গিরিখাতের ওপর একটি মাত্র গাছের তৈরি সাঁকো কিংবা পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে বানানো সিঁড়িতে চলাটা ছিল কষ্টসাধ্য। একটু অসাবধানি হলে তিন থেকে চারশ’ ফুট নিচে পড়ে যাওয়ার ভয় এবং ঘেমে যাওয়ায় সৃষ্ট পানিশূন্যতা কিছুক্ষণ বাদেই সবাইকে দুর্বল করে দেয়। শুধু মানসিক শক্তির জোরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে। পাহাড়ের মতো দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার সময় শারীরিক শক্তির চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানসিক দক্ষতা ও এগিয়ে চলার উদ্যম সহনশীলতা। কমপক্ষে সাতটি আকাশচুম্বী পাহাড়ের বাধা অতিক্রমের পর ঝিরিপথের সন্ধান পেলাম। স্রোতের ফলে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট পাথরবিছানো প্রবাহপথই ঝিরিপথ নামে পরিচিত। ঝিরিপথের একটু বাঁক ঘুরতেই সুনসান নীরবতা ভেঙে শুনতে পেলাম হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। অসংখ্য গাছগাছালি ও হাজারো প্রজাতির লতাপাতায় আচ্ছাদিত দেড়শ’ ফুট উঁচু পাহাড়ের বুক চিরে অবিরাম ধারায় আছড়ে পড়ছে জলরাশি। সে জলরাশির লোভ সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। হিমশীতল জলরাশির স্পর্শে নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর হলো। প্রকৃতিকে ছুঁয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। ইতোমধ্যে ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। শ্রীমঙ্গলে সাত রঙের চা পান করে ক্যাম্পাসে ফেরার পথ ধরি।

শিক্ষাসফরের পুরোটা সময় অনাবিল আনন্দ ঘিরে রেখেছে আমাদের সবাইকে। ফাইনাল বর্ষ বিধায় কিছুদিনের মধ্যেই আলাদা হয়ে যেতে হবে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। হয়তো চাইলেই এভাবে একত্রিত হতে পারবে না; কিন্তু এই দিনগুলো স্মৃতির পাতায় অমøান হয়ে থাকবে।

90

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়