Cvoice24.com


অক্সিজেন সংকটে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ‌‘চট্টগ্রামের’

প্রকাশিত: ১৬:০০, ৪ জুন ২০২০
অক্সিজেন সংকটে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ‌‘চট্টগ্রামের’

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে চারদিকে আইসিইউ সংকট নিয়ে চলছে হাহাকার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ করোনা রোগীদের বাঁচাতে আইসিইউর চেয়ে বেশি প্রয়োজন কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ। এ অক্সিজেন সরবরাহের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হলো হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা। যা চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থায় করোনা সংক্রমণের দুই মাস পর যুক্ত করা হয়েছে মাত্র আটটি। 

ফলে করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকজনকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। এ হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা না রাখলে আরো প্রাণহানি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা চট্টগ্রামে গড়ে ২শ’ জন করোনা আক্রান্ত রোগী নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এরমধ্যে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ জনই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি হতে না হতেই শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছেন প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে পনের জন।    

উল্লেখ্য, গত ৩ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত ৩ হাজার ৫৩৭ জন। মারা গেছেন ৮৫ জন আর সুস্থ হয়েছেন ২৪৮ জন। 

জানা যায়, কোভিড রোগীর ফুসফুসে অক্সিজেনের পরিমাণ শতকরা ৯২ ভাগ এর নিচে নামলে তাকে কৃত্রিম অক্সিজেন দিতে হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সুবিধাজনক হলো কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ পদ্ধতি। এই কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ পদ্ধতি সংকটে দিশেহারা চট্টগ্রামের করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালগুলো। এছাড়া রোগীর শরীরে অধিক মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ কমে গেলে প্রয়োজন হচ্ছে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা (উচ্চ চাপের অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র)। কেননা এই যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের ফুসফুসে প্রতি মিনিটে ১৬ থেকে ২০ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।

চিকিৎসায় অক্সিজেন সরবরাহ সম্পর্কে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব সিভয়েসকে বলেন, ‘করোনা চিকিৎসায় রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজেন সাপোর্টের। এ করোনা ভাইরাস যেহেতু ফুসফুসের ক্ষতি করছে তাই অক্সিজেন সাপোর্টের বিকল্প কিছু নেই। স্বাভাবিকভাবে ৯০ শতাংশের নিচে অক্সিজেন লেভেল নেমে গেলে তখন সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। এছাড়া মুমুর্ষ অবস্থায় অক্সিজেনের চাপ বেশি প্রয়োজন হয়। সে সময় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপোর্ট খুব কার্যকর এবং একই সাথে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা থাকলে খুব সহজে রোগী অক্সিজেন সাপোর্ট পেয়ে থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আইসিইউ সাপোর্ট কিংবা ভেন্টিলেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। এতে রোগীরা মানসিক ভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। তাই নিঃশ্বাস নিতে বেশি সমস্যা হলে তখন অক্সিজেন ফ্লো বাড়াতে পারলেই ভালো হয়। এই ফ্লো বাড়াতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের মাধ্যমে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলে খুব দ্রুত অক্সিজেন পেয়ে থাকে রোগী। স্বাভাবিক হিসেবে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৫ শতাংশ মুমুর্ষ হয়ে থাকে, তাই তাদের জন্য এ ধরনের সাপোর্ট প্রয়োজন।’

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সূত্রমতে, চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত করোনা চিকিৎসায় প্রস্তুত করা হয়েছে ৩৯০ আইসোলেশন শয্যা। তারমধ্যে ১৪০টি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে, ১০০টি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, ৫০টি রেলওয়ে হাসপাতালে, ৪০টি চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালে, ৩০টি বিআইটিডি হাসপাতালে ও ৩০টি হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। এরমধ্যে ভ্যান্টিলেটরসহ আইসিইউ প্রস্তুত আছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০টি ও হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ১০টি। 

এছাড়া হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ভেন্টিলেটর ছাড়া ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন সংযোগপূর্ণ আইসিইউ আছে ৮টি। ইতোমধ্যে গত মঙ্গলবার (২ জুন) এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য ৪টি আইসিউযুক্ত ভেন্টিলেটর ও ৪ টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জন্য ২টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের জন্য ২টি আইসিউযুক্ত ভেন্টিলেটর ও ২টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা প্রদানের করা হয়েছে। এরপরেও অক্সিজেন সরবরাহের সংকট থেকে মুক্ত হতে পারেনি চট্টগ্রাম।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া সিভয়েসকে বলেন, ‘দুঃখজনক ব্যাপার হলো চট্টগ্রাম এখনো করোনা মোকাবেলায় সক্ষম হতে পারেনি। চট্টগ্রামের স্বয়ংসম্পূর্ণ হাসপাতাল বলতে শুধুমাত্র জেনারেল হাসপাতালই আছে। ওখানে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা আছে। তবে এটি অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে। এছাড়া অন্যান্য হাসপাতালগুলো শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের কাজ করছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপোর্ট থাকলেও করোনা পেশেন্টের জন্য তা আলাদা নয়। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেলে এইচএফএনসি (হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা) প্রয়োজন অনুসারে নেই। এছাড়া বিআইটিআইডি ও ফিল্ড হাসপাতালে এ ধরনের ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। তাই হাসপাতালগুলোতে শুধুমাত্র মাইনর (গৌণ) ক্যাসের পেশেন্টদেরকে রাখা হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখন আমাদের প্রয়োজন নিঃশ্বাস নেওয়ার বন্দোবস্ত করা। অক্সিজেন সাপোর্ট ব্যবস্থা করতে না পারলে বর্তমানে যে হারে কোভিড এবং নন-কোভিড পেশেন্ট মারা যাচ্ছে তার হার আরো বাড়তে থাকবে। কেননা সংক্রমণ রোধে আমরা কোন সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তাই এক হয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার দাবি করতে হবে।’

চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহি ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, ‘আইসিইউ বেড কোনো বিষয় নয়, মূল ফ্যাক্টর হলো অক্সিজেন সরবরাহ কত দ্রুত হচ্ছে এবং রোগীর প্রতি কেয়ারিং। সাধারণ আইসোলেসনে রেখেও ভাল কেয়ারিংয়ের মাধ্যমে রোগীদের সুস্থ করা যায়, আমরা এই কাজটিই করছি।’

করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, করোনা চিকিৎসায় রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজেন এবং হেপারিন নামের একটি ইনজেকশন। স্বাভাবিক সময়ে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন দেয়া হলেও মুমুর্ষ অবস্থায় অক্সিজেনের চাপ বেশি প্রয়োজন হয়। সেমময় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপোর্ট খুব কার্যকর এবং একইসাথে হাইফ্লো নসল ক্যানোলা থাকলে খুব সহজে রোগী অক্সিজেন সাপোর্ট পেয়ে থাকে। 

আইসিইউ সাপোর্ট কিংবা ভেন্টিলেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। এতে রোগীদের মধ্যে আরো বেশি ভয় কাজ করে। অক্সিজেন ফ্লো বাড়াতে পারলেই যথেস্ট। এই ফ্লো বাড়াতে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের মধ্যমে হাইফ্লো নজল ক্যানোলা দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলে খুব দ্রুত অক্সিজেন পেয়ে থাকে রোগী। স্বাভাবিক হিসেবে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৫ শতাংশ মুমুর্ষ হয়ে থাকে, তাই তাদের জন্য এধরনের সাপোর্ট প্রয়োজন।

চট্টগ্রামে অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধা না থাকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে কথা বলা হয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সরকারী ও বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা) শেখ শোয়েবুল আলমের সাথে। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘বর্তমানে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা অক্সিজেন সাপোর্টের প্রয়োজনীয়তা উঠে আসছে। আমরা বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা করেছি। তাই আমরা এ চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। আশাকরি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ সমস্যা সমাধান হবে।’

প্রসঙ্গত, উষ্ণতর এবং আর্দ্রতাযুক্ত অক্সিজেন মিশ্রণ করে ২০ থেকে ৬০ লিটার প্রতি মিনিটের মধ্যে মানুষের ফুসফুসে প্রবাহ করা হয় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অক্সিজেন থেরাপির (এইচএফএনসি) মাধ্যমে। ফলে দুর্বল ফুসফুসকে কৃত্রিমভাবে সচল রেখে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়। অন্যথায় ফুসফুস কাজ না করার কারণে ধমনীতে অক্সিজেন স্বল্পতায় হার্ট, কিডনি, লিভারসহ শরীরের নানা অঙ্গ অচল হয়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

-সিভয়েস/এসজেবি/এডি/এমএম

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়