Cvoice24.com


নারী নির্যাতন মামলায় সাজার চেয়ে খালাস বেশি 

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২১ নভেম্বর ২০২০
নারী নির্যাতন মামলায় সাজার চেয়ে খালাস বেশি 

নারী নির্যাতন মামলা হয়। কখনো কখনো আসামিরা জেলও খাটে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেষ পরিণতি হয় মীমাংসা। সামাজিক মর্যাদা, সম্মানহানি, কখনো কখনো আসামি পক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় মাঝপথে থেমে যায় মামলার গতি। 

চলতি বছরের (২০২০) অক্টোবর মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ১৭ টি মামলায় আসামিরা সাজা পেয়েছেন। ৮৫ টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। ৩২ টি মামলায় আসামিরা অব্যাহতি (ডিসচার্জ) পেয়েছেন। এছাড়া ১১৩ টি মামলা সাজাবিহীন অন্যান্যভাবে খারিজ হয়েছে। আপোষ করে ফেলা, মামলা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়া, মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া ও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করাসহ নানা কারণে এই ১১৩ টি মামলা খারিজ হয়।

চট্টগ্রামের ৭ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন ও সিভয়েসের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে আসে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বেশিরভাগ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যান। কম সংখ্যক মামলাতেই আসামিরা সাজা পাচ্ছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম অঞ্চলের সেক্রেটারি আকতার কবির সিভয়েসকে বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় এভাবে আসামিরা খালাস পাওয়াটা দুঃখজনক। ত্রুটি দূর করে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সুশাসনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে নারী নির্যাতনের ঘটনা।’

সিভয়েসের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত অক্টোবর মাসে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চারটি, ট্রাইব্যুনাল-৪ এর তিনটি, ট্রাইব্যুনাল-৬ এর দুইটি ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এর আটটি মামলায় আসামিরা সাজা পেয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল-২, ৩ ও ৫ এর কোনও মামলাতেই সাজা পাননি কেউ। 

এদিকে ট্রাইব্যুনাল-১ এর ২৫টি, ট্রাইব্যুনাল-২ এর আটটি, ট্রাইব্যুনাল-৩ এর পাঁচটি, ট্রাইব্যুনাল-৪ এর ৩৩টি, ট্রাইব্যুনাল-৫ এর দুইটি, ট্রাইব্যুনাল-৬ এর চারটি ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এর আটটি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। 

অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল-১ এর আটটি, ট্রাইব্যুনাল-২ এর দুইটি, ট্রাইব্যুনাল-৩ ও ট্রাইব্যুনাল-৪ এর একটি করে, ট্রাইব্যুনাল-৫ এর তিনটি, ট্রাইব্যুনাল-৬ এর দশটি ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এর সাতটি মামলায় আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। 

এর বাইরে আপোষ করে ফেলা, মামলা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়া, মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া ও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করাসহ নানা কারণে ট্রাইব্যুনাল-১ এ আটত্রিশটি, ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাতটি, ট্রাইব্যুনাল-৪ এ পাঁচটি, ট্রাইব্যুনাল-৫ এ দুইটি, ট্রাইব্যুনাল-৬ এ ৩৫টি ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এ ২৪টি মামলা অন্যান্যভাবে খারিজ হয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চট্টগ্রামের ৭ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মোট ১৪ হাজার ২৩৩ টি মামলা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-১ এ রয়েছে ৩ হাজার ৪০৬ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-২ এ ২ হাজার ৪৭০ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৩ এ ২ হাজার ১২১ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৪ এ ২ হাজার ৩৯৫ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৫ এ ১ হাজার ৬২৬ টি মামলা, ট্রাইব্যুনাল-৬ এ ১ হাজার ১৬১ টি মামলা ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এ ১ হাজার ৫৪ টি মামলা। 

এসব মামলার মধ্যে ১২ হাজার ৭৪৫ টি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলা, ১ হাজার ১৫৭ টি শিশু মামলা, ২৩ টি স্পেশাল মামলা, ৩৩ টি ফৌজদারি মোশান মামলা বা মোশান ট্রায়াল মামলা, ১৬৮ টি ফৌজদারি আপিল মামলা ও ১০৭ টি রয়েছে দায়রা পিটিশন মামলা।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, ট্রাইব্যুনাল-৪ ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এ ৫ বছরের অধিক সময় ধরে ঝুলে আছে এমন মামলার সংখ্যা ২৩৯ টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে আরও ৩০ টি মামলা। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল-১, ট্রাইব্যুনাল-২ ও ট্রাইব্যুনাল-৩ এ মুলতবি আছে ৩ হাজার ১৭ টি মামলা। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৮৭ টি মামলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও ৬৩০ টি মামলা আসামি পক্ষের আবেদনে মুলতবি রয়েছে। 

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, অক্টোবর মাসেই ট্রাইব্যুনাল-১ মামলা দায়ের হয়েছে ৭৬ টি, ট্রাইব্যুনাল-২ এ ৪৬ টি, ট্রাইব্যুনাল-৩ এ ৫০ টি, ট্রাইব্যুনাল-৪ এ ৫৮ টি, ট্রাইব্যুনাল-৫ এ ৬৫ টি, ট্রাইব্যুনাল-৬ এ ৩২ টি ও ট্রাইব্যুনাল-৭ এ ২৫ টি মামলা। এসব মামলার মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা, স্পেশাল ও স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা, ফৌজদারি মোশান বা মোশান ট্রায়াল মামলা, ফৌজদারি আপিল, দায়রা মামলা, পিটিশন মামলা ও শিশু মামলা অন্যতম।

আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা নথি নির্ভরের পাশাপাশি সাক্ষী ও আলামত নির্ভর। এসবের ঘাটতি থাকলে মামলা প্রমাণ করা যায়না। তদন্তে ঘটনার প্রমাণ না পাওয়া বা তদন্ত রিপোর্ট আসছে কিন্তু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি সে ক্ষেত্রে মামলার আসামিরা খালাস ও অব্যাহতি পেয়ে যান। সাক্ষী হাজির করতে না পারা বা বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সূত্রিতার কারণেও নারী নির্যাতনের মামলায় আসামিরা খালাস বা অব্যাহতি পেয়ে যান। 

তদন্ত কর্মকর্তার খেয়ালিপনা ও মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে আদালতে উপস্থাপন না করাও আসামি খালাস বা অব্যাহতি পাওয়ার পেছনে কাজ করে বলেও জানান আইনজীবীরা।

আইনজীবীরা বলছেন, প্রতিবেশীর সাথে চলছে জমিজমার বিরোধ, অথচ টুকে দিলেন নারী নির্যাতন মামলা। জামিন পাওয়া সহজ নয় বলেই শত্রুতাবশত প্রতিবেশীকে শায়েস্তা করতে এ ধরনের মামলা টুকে দেয়া হয়। এসব মামলা বিচারে গিয়ে আর টিকেনা। আসামিরা খালাস বা অব্যাহতি পেয়ে যান। 

এছাড়া দেখা যায়, একজন দোষী হলেও পরিবারের সকলকে আসামি করা হয়। এ কারণেও অসংখ্য মামলা খারিজ হয়ে যায়। এর বাইরে হুমকি-ধমকি বা আর্থিক লোভে পড়ে ভুক্তভোগীরা আসামিদের সাথে আপোষ করে পেলেন। জামিনে গিয়ে বের হয়েই আসামিরা ভুক্তভোগী ও ভুক্তভোগীর পরিবারকে এ হুমকি-ধমকি দেন এবং আপোষ করতে বাধ্য করেন।

ট্রাইব্যুনাল-৭ এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খন্দকার আরিফুল আলম সিভয়েসকে বলেন, ‘নানা রকম সংকট নিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোর কার্যক্রম চলছে। এ সংকট কোনো বিচারক বা অবকাঠামো সংকট নয়। ভুক্তভোগী থেকে শুরু করে আসামি ও মামলার তদন্তকারীসহ অন্যান্যদের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় বড় সংকট। থানা থেকেই একটি মামলা শুরু হয়। সেখানেই মামলাটা নড়বড়ে হয়ে যায়। তারা ঠিকমতো তদন্ত করে না। ভুক্তভোগীর মেডিকেল সার্টিফিকেটটাও সংগ্রহ করে আদালতে উপস্থাপন করেন না।’

এক সময় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (গ) ধারার অপরাধ জামিন অযোগ্য ছিল। বর্তমানে সেটি জামিনযোগ্য। ছোট-বড় এমন অনেকগুলো কারণ রয়েছে, যেসব কারণে মামলা প্রমাণ করা সম্ভব হয়না। আসামিরা খালাস পেয়ে যান।

ট্রাইব্যুনাল-২ এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এম এ নাসের সিভয়েসকে বলেন, ‘সাক্ষী হাজির না করা, মামলার দীর্ঘ সূত্রিতা, মামলার বাদীকে হুমকি দেয়া ও এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়াসহ অসংখ্য কারণে মামলা ডিসচার্জ বা খারিজ হয়। বাদী পক্ষ আসামি পক্ষের সাথে আপোষ করে ফেলাটাও মামলা খারিজ হওয়ার একটি কারণ।’ 

তিনি বলেন, ‘আমরা সকল পক্ষ যদি যার যার কাজটি ঠিকমতো করি তাহলে আসামিরা পার পাবে না। তারা অবশ্যই সাজা পাবে।’

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের ৭ টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চট্টগ্রাম জেলা ও নগরীর ৩২ টি থানার বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল-১ এ নগরীর কোতোয়ালি, জেলার বাঁশখালী, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও আনোয়ারার বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল-২ এ নগরীর পাহাড়তলী, জেলার মিরসরাই, হাটহাজারী, লোহাগাড়া ও ফটিকছড়ির বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন।

ট্রাইব্যুনাল-৩ এ জেলার রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া ও সন্দ্বীপের বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল-৪ এ নগরীর বায়েজিদ, আকবরশাহ, জেলার সাতকানিয়া ও সীতাকুণ্ডের বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল-৫ এ নগরীর বাকলিয়া, বন্দর, চান্দগাঁও ও চকবাজারের বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল-৬ এ নগরীর ডবলমুরিং, হালিশহর, ইপিজেড, খুলশী ও কর্ণফুলীর বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন এবং ট্রাইব্যুনাল-৭ এ নগরীর পতেঙ্গা, সদরঘাট, পাঁচলাইশ, ভূজপুর ও জোরারগঞ্জের বাসিন্দারা মামলা করতে পারেন। 

এ সাতটি ট্রাইব্যুনালের মধ্যে একটি ছাড়া বাকী ট্রাইব্যুনালে বিচারক আছেন। শুধুমাত্র ট্রাইব্যুনাল-৩ এ বিচারক নেই। সর্বশেষ এ ট্রাইব্যুনালে জান্নাতুল ফেরদৌস বিচারক হিসেবে ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি তিনি বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। বর্তমানে এ ট্রাইব্যুনালে ভারপ্রাপ্ত বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী।

-সিভয়েস/এসএইচ

সরকার হাবীব 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়