Cvoice24.com

ভোটদানে ভোটারের অনীহা যে কারণে 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:৫০, ২৭ জানুয়ারি ২০২১
ভোটদানে ভোটারের অনীহা যে কারণে 

ইভিএম পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

‘২০১৮ সালের বাদলের (জাতীয় নির্বাচন) ভোটের সময় যখন কেন্দ্রে গেছি, তখন বলেছিল আপনার ভোট হয়ে গেছে। পরে জেনেছি রাতেই নাকি ব্যালেটে সিল মেরে দিছে তারা (সরকার দলীয় লোকজন)। এরপর তার মৃত্যুর পর গত বছর মোছলেম উদ্দীনের নির্বাচনে (উপ-নির্বাচন) সেখানে আমাদের বেশ কয়েকজনকে ভোট দিতে না দিয়ে স্কুলের সামনে থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেছিল— নৌকায় ভোট দেওয়ার গ্যারান্টি লাগবে। মনে করেছিলাম মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিব কিন্তু তারাতো স্কুলেই ঢুকতে দিল না। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর ভোটকেন্দ্রেই যাব না। এতো ঠেলাঠেলিও করব না, এমনেই তারা নিয়ে নিবে আর গিয়ে লাভ নেই!’ 

ভোটদানে নিজের অনীহার কথা এভাবেই সিভয়েসের কাছে তুলে ধরেন নগরের মোহরা ওয়ার্ডের ৫০ ঊর্ধ্ব এক ভোটার। নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ভোটার কথা বলার সময় একই সুরে ভোট দিবেন না বলে জানিয়ে দেন পাশে থাকা আরেক ভোটার। বুধবার (২৭ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের হার কত হবে, এতেই অনুমেয়। 

শুধু ওই দুই ভোটারই নন, লালখান বাজার হাই-লেভেল রোডের বাসিন্দা আব্দুল জলিল বলেন, ‘ভোটের যে পরিবেশ, তাতে চিন্তা করছি ঘরে বসে টিভি দেখেই সময় কাটাবো। কখন কোন দিকে কী হয়, তাই বাসাতে থাকাটাই নিরাপদ মনে করছি। আওয়ামী লীগের মানুষজনই ভোট নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে।’ 

একই কথা বলেন দেওয়ান বাজারের ভোটার ও চাকরিজীবী আশিক আহমেদ, ‘ভাই ভোট তো আমার মতো দিতে পারব না। তাই এতো ঠেলাঠেলি না করে কাল অফিস খোলা অফিসেই চলে যাব। যার ভোট, যা মন চায় করুক।’ 

কদমতলী এলাকার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমি গতবার এমপির ভোটে (জাতীয় নির্বাচন) ভোট দিতে পারিনি। আমার ভোট নাকি কে দিয়ে দিছে। তাই এবার আর যাব না। এছাড়া ভোটের দিন মারপিট হওয়ার কথাও শুনছি।’ 

ভোট দিতে মানুষের অনীহার আরও বেশকিছু কারণ বের করেছে সিভয়েসের পর্যবেক্ষকরা। কথা হয়েছে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও। তারা বলছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মাঝে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হচ্ছেন না। তারা নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরুদ্ধেও ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন। দুই দল আবার প্রশ্ন তুলেছে একে অপরের ভূমিকা নিয়ে।

এছাড়া নির্বাচনে আর আগের মতো সেই জৌলুস নেই। উৎসবের রং আজ ফ্যাকাশে। সরকার সমর্থিত মনোভাবাপন্ন ভোটার ছাড়া অন্য মতাবলম্বিদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে দেওয়া হয় বাধা। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদেরও নানাভাবে ভোট থেকে দূরে রাখা হচ্ছে এখন। বিরোধী এজেন্টদের অনেক জায়গায় বের করে দেওয়া ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের গা মোটা ভাবের কারণেই দিনদিন ভোটের হার কমছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থায় এতোটা নড়বড়ে না হলেও ২০২০ সালের ‌১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে যে ভোট হয়েছিল, সেখানে ভোট পড়েছিল কেবল ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

এর কারণ হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ওই সময় জানিয়েছিলেন, দলীয় নেতাকর্মীরাও এখন আর পরিবারের সদস্যদের কেন্দ্রে আনেন না। তাদের মধ্যে ভাব এমন যে, আমাদের প্রার্থীই তো জিতবে। কাজ একটাই বিরোধী লোকজনকে কেন্দ্রবিমুখ করতে পারলেই হলো! সে কারণে একসময়ে জাতীয় নির্বাচনে ৪০ ভাগের বেশি ভোট নৌকা প্রতীকে গেলেও বর্তমানে মোট ভোটের হারও তার চেয়ে নিচে।  

ওই উপনির্বাচনে ভোটের হার কম হওয়া প্রসঙ্গে তখন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছিলেন, ‘ভোটার কম হওয়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। তা হলো নির্বাচনের দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। এ আসনে ভোটারদের বড় অংশই চাকরিজীবী। তাছাড়া বিএনপি নির্বাচনের আগে নানা অপপ্রচার চালিয়েছে। এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। ফলে কর্মজীবী মানুষজন ভোট দিতে আগ্রহী হবেন না। অন্যদিকে মহানগর পুলিশ (সিএমপি) ঘোষণা দিয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে না। এতে করে যারা শুধুমাত্র ভোটার স্লিপ নিয়ে ভোট দিতে যান, তারাও কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। সুতরাং এ সিদ্ধান্তের কারণেও যে ভোটের হার কমবে, সেটা নিশ্চিত। 

এদিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর শারমিন মুরশিদ বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। তাই ভোটারদের কাছে এখন কোনো নির্বাচন নিয়েই আগ্রহ নেই। নির্বাচনী বা সুশাসনের যে ব্যবস্থা- এটা কিন্তু ধসে গেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে নির্বাচন হচ্ছে, তার প্রতি মানুষের আর এক বিন্দু আস্থা নেই। কারণ বিগত নির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে গিয়ে ভোট দিতে পারেননি। তো মানুষের ভেতরে এই বোধটা কাজ করছে যে, আমি ভোট দিতে যাব কিসের জন্য- আমাকে তো ভোট দিতে দেওয়া হবে না। এই আস্থাহীনতা ভোটার কমার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, ‘আসলে চাইলেও অনেক কথা এখন বলা যায় না। কিন্তু কিছু কথা না বললেই নয়। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এই ১২তম নির্বাচন কমিশন হলো চরম ব্যর্থ। আগের নির্বাচন কমিশন ভালো ছিল, ব্যাপারটা এমন নয়। এরপরেও তাদের আয়োজিত নির্বাচনে অধিকাংশ নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। কিন্তু নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা নষ্ট করেছে এ কমিশন। তাই আজ তাদের নানা কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে।’

ভোটার বিমুখ নির্বাচন হওয়া প্রসঙ্গে এই রাজনীতি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের জোরজবরদস্তিতে ইভিএমে ভোট শুরু হলো। কিন্তু এ মেশিন কতটুকু নিরপেক্ষ, তার জন্য কোনো পরীক্ষা করতে রাজি হয় না নির্বাচন কমিশন। ইভিএমে ভোট দেওয়া মানে সারাদিন যেখানে যা হোক, কন্ট্রোল রুম সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। আর এ বিষয়টি ভোটাররা বুঝে গেছে। তাই তারা নির্বাচনের নামে কোনো প্রহশনে যেতে আগ্রহী না। ইভিএম ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে বহুবার প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে প্রশ্নকে মূল্যায়ন করেনি।’ 

নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনাগ্রহ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সিরাজ উদ দৌল্লাহ বলেন, ‘ভোট হওয়ার আগে নির্বাচনের উপস্থিতি নিয়ে কথা বলা মুশকিল। তবে উপস্থিত না হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। উপস্থিতির জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্থানীয় প্রার্থীদের কাজ করতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। এরপরেও অনেকে ভোট দিতে চান না। কারণ ভোট দিয়েও ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়ায় তারা ভোট বিমুখ হন।’

চট্টগ্রাম জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ভোট কেন্দ্রকে শতভাগ নিরাপদ করতে না পারলে কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করা লোকজনও ভোট দিতে যাবেন না। এছাড়াও জনগণকে নিশ্চিত সঠিকভাবে কাউন্ট (গণনা) করার ব্যাপারে ভরসা অর্জন করতে হবে। এটা নিয়ে প্রায় ভোটারদের মনে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছে। নির্বাচন নিয়ে চলমান এ দ্বন্দ্ব থেকে সর্বসাধারণকে একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। নয়তো এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা প্রকাশ পাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ নির্বাচন নিয়ে অনীহা তলানিতে এসেছে। অবিশ্বাস, ভীতি, আতঙ্ক, সন্দেহ থেকেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ভোট হলেই ভয় পান ভোটার। আর যারা বিরোধী দলের নেতাকর্মী, তারা থাকেন গ্রেপ্তার আতঙ্কে। এখন মানুষের ধারণা, সরকারি দলের মনোনয়ন পেলে তারাই নির্বাচনে জয়ী হবে। নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জনপ্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। যেটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। কেন্দ্রের বাইরে সরকারদলীয় লোক জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন সাধারণ মানুষ মনে করে, ভোট দিয়ে কী লাভ, ওরা তো জিতবেই। এছাড়া ইভিএম নিয়ে নানা প্রশ্ন তো উঠছেই। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নাকি একাধিক ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে এই মেশিনে। তাছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে দলীয় সরকারের অধীনে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে, তা একটিও সুষ্ঠু হয়নি।’

যদিও গত ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের মুখে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেছিলেন, ‘ইভিএম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কারও ভোট কেউ দিতে পারে না। ভোটার উপস্থিতি বাড়ােনোর জন্য গণমাধ্যমেও বেশি বেশি প্রচার বাড়াতে হবে।’ 

তবে পর্যবেক্ষকদের নানা পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলো নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা বারবার এড়িয়ে গেছেন। যদিও আরেক কমিশনার মাহবুব তালুকদার এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, চসিক নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, এই অতীব গুরুত্ববহ নির্বাচনে ভোটার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কাজে নিয়োজিত সকল অংশীজন প্রত্যেকেই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখবেন। একই সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রদানে ব্যাপক অংশগ্রহণ একান্তভাবে কাম্য। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের আইনানুগভাবে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। আমরা জনগণের মনে নির্বাচনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি করে ও তাদের উদ্বুদ্ধ করে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় সামিল হতে চাই।’

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়