Cvoice24.com

‘রহস্য’ পুরুষ কাউন্সিলর মিন্টুর না বলা কথা

আসিফ পিনন

প্রকাশিত: ১৬:১০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
‘রহস্য’ পুরুষ কাউন্সিলর মিন্টুর না বলা কথা

সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু

জয়রথের শুরুটা সেই ১৯৭৭ সালে। দীর্ঘ ৪৩ বছরের যাত্রাপথে ৭বার কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার ওয়ার্ডের। সাতবারে তার কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের ‘বাঘা বাঘা’ প্রার্থীরা। তবে যাত্রাপথটা মোটেও সহজ ছিল না সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুর জন্য। বিরোধী দল থেকে শুরু করে নিজ দলীয় (আওয়ামী লীগ) বিদ্রোহীদের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়েছে। আজকের এই ‘বিজয়স্তম্ভ’ গড়ে তুলতে সামাল দিতে হয়েছে বহু ঝড় ঝঞ্ঝা। সিভয়েসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কাউন্সিলর মিন্টুর বলা না বলা অনেক কথাই। 

আজকের ব্যস্ততম এলাকা চকবাজার মিন্টুর নখদর্পনে। ওয়ার্ডের প্রতিটি রাস্তা, সড়ক থেকে অলিগলি—তার অস্তিত্বের সাক্ষী। সত্তরোর্ধ্ব আওয়ামী লীগের এই নেতার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে বদলেছে চকবাজারের নাড়ি নক্ষত্র। বদলেছে এই শহর। তাকে নিয়ে নগরীর বাসিন্দাদের আছে নানা মধুর স্মৃতি। প্রায় সাড়ে চার দশকের দীর্ঘ যাত্রায় আছে অভিযোগও, না পাওয়ার বেদনা। 

সমর্থকরা অবশ্য বলছেন, বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত চকবাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েও বারবার জিতেছেন মিন্টু। মূলত ‘স্বাতন্ত্র্য’ মনোভাবের কারণে দলমত নির্বিশেষে তাকেই বেছে নিয়েছেন এলাকার ভোটাররা।

জননন্দিত এই কাউন্সিলর জানিয়েছেন, দীর্ঘ নির্বচনী মাঠে তার মূল লড়াইটা হয়েছে মূলত পাঁচজনের সঙ্গে। প্রথমবারে অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৎকালীন মুসলীম লীগে নেতা সৈয়দ আহমদ খান। ১৯৮৮ সালে এরশাদের শাসন আমলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করায় অংশ নেননি মিন্টুও। পরে ১৯৯৪ সালের নির্বাচন ও ২০০০ সালে পরপর দুই দফা জামায়াত অধ্যুষিত চকবাজারে তার লড়াই হয় দলটির নেতা ডা. সাত্তারের সঙ্গে। দুবারেই বিশাল ব্যবধানে হেরেছেন সাত্তার। ২০০৫ সালের ভোটেও মিন্টুর লড়াইটা হয়েছিল আরেক জামায়াত নেতা রিয়াজুল আনোয়ার সেন্টুর সঙ্গে। তবে প্রার্থী বদলেও ব্যবধান কমাতে পারেনি প্রতিপক্ষ। ২০১০ সালে দ্বিতীয়বারের মত মিন্টুর কাছে ধরাশায়ী হন সেই সেন্টু।

নিজেদের শক্ত ঘাঁটিতে একে একে সবকটি নির্বাচনে শোচনীয় হারের পর অনেকটা কৌশলী হয়ে প্রার্থী বদল করে বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০১৫ সালে ভোটের মাঠে সাড়া ফেলেন জামায়াতের আরেক নেতা জহির আহমদ। কিন্তু মিন্টুর ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারেননি। হার মানেন প্রায় ৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে।

এরপর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ নানা কারণে জামায়াতের অবস্থান অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে চকবাজার ওয়ার্ডে। সর্বশেষ ২০২০ সালে তাই মিন্টুর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ। অন্যান্য প্রার্থীদের মত তিনিও হেরে যান জনপ্রিয় কাউন্সিলর মিন্টুর কাছে। যদিও এবারের নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’সহ নানা অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে।

অন্য সব কাউন্সিলরদের চেয়ে মিন্টু অবশ্য বেশ রেকর্ড সমৃদ্ধ। তার জীবন-চরিত্র সাজানো নানা রঙ আর বৈচিত্র্যে। জীবনের প্রায় সবটুকু সময় কেটেছে খদ্দরের পাঞ্জাবী ও ঢিলেঢালা পায়জামায়। সাদাসিধে জীবনের এই ‘রহস্য’ জানতে চাইলে হেসে উড়িয়ে ‘রহস্য’ শব্দটিকে। সিভয়েসকে বলেন, ‘জীবনটাকে যতটুকু সিম্পল (সাদাসিধে) চালানো যায় ততটুকু-ই চেষ্টা করেছি। ততটুকু পেরেছিও।’

জীবনটা সাদাসিধে হলেও জ্ঞান পিপাসু মানুষটি চোখ বুজেও বুঝতে পারেন পৃথিবীর ‘নাড়ি নক্ষত্রের’ অবস্থান। আঁচ করতে পারেন মহাসমুদ্রের গভীরতা। সিভয়েসেকে মিন্টু বলেন ‘চোখ বুজলে মহাশূন্য দেখি আমি। সাগরে কতটুকু গভীরতা সবকিছু বুঝতে পাই। পৃথিবীর কোথায় উঁচু, কোথায় নিচু- তাও বলে দিতে পারি। আসলে গ্লোব স্টাডি করেছি। এটা আমার সাবজেক্ট ছিল না, তবুও করেছি।’

কাউন্সিলর মিন্টুর এমন আরেকটি শখ হলো ঐতিহাসিক মুদ্রা (কয়েন) সংগ্রহ। তার ঝুঁলিতে রয়েছে বহু প্রাচীন যুগের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা। এগুলো নিয়ে প্রদর্শনীতেও যাওয়ার ইচ্ছা আছে। বললেন, ‘আমার যে মুদ্রা আছে তা কেউ একা আলগাতে (বহন) পারবে না। এই মাটির ৭০০ থেকে ৮০০ বছরের পুরোনো মুদ্রা আমার সংগ্রহে। এটা আমার শখ। আগামী শীতে ঢাকা আর্ট গ্যালারিতে এগুলো প্রদর্শনের ইচ্ছা আছে।’

জীবনের দীর্ঘ পথচলায় তিনি কাজ করেছেন বধিরদের জন্য। তাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন সংগঠন। ভাষা শিখে ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন অনর্গল। শত ব্যস্ততার মাঝেও বধিরদের জন্য কাজ করছেন ১৯৭২ সাল থেকে। মানবিক এ কাউন্সিলর বলেন, ‘আমি বধিরদের ৭২ সালে সংগঠিত করেছি। ১৯৭৪ সালে তাদের নিয়ে ক্লাব করেছি। ১৯৭৬ সালে তাদের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে দিয়েছি। এখনো অবদি তাদের দায়িত্বে আছি।’

 

সাড়ে চার দশকে নানা অভিযোগ, যা বললেন মিন্টু

চট্টগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড চকবাজার। ‘শিক্ষাপাড়া’খ্যাত এই এলাকায় গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, কোচিং সেন্টার, মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। তবে কথিত আছে ‘আকাশে মেঘের আনাগোনায় পানি (জলবদ্ধতা) উঠে যায় চকবাজারে’। আছে যানজটের দুর্বিসহ যন্ত্রণা। কাঁচাবাজার থেকে ফুলতলা পর্যন্ত বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে সড়কের উপরেই। এরপরও দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সিলরের দায়িত্ব খোয়াতে হয়নি মিন্টুকে। নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে জননন্দিত এই কাউন্সিলর বলেন, ‘দেশের প্রতিটি কাজে ভ্রান্ত পদ্ধতি কাজ করছে। এসব ভ্রান্ত পদ্ধতিগুলো দ্রুত গতিতে নিরসন করতে না পারলে ভোগান্তি বাড়তে থাকবে।’

প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করা আওয়ামী লীগের এই নেতা আক্ষেপের সুরে বলেন. ‘১৯৭৭ সালে যখন আমি নির্বাচিত হই তখন এ ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৪০০ জনের মতো। কালের পরিক্রমায় এখন ভোটার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার। এখানে টোটাল পপুলেশন (মোট জনসংখ্যা) ছিল ৩০ হাজার, তা এখন ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো। খালি জায়গা কমেছে, নালা নর্দমা বেদখল হয়েছে। পানি চলাচলের পথ বিস্তৃতি হারিয়েছে। লোকেরা ঘরবাড়ি করার সময় নালা-খালের অংশ নিজেদের জায়গার মধ্যে নিয়ে এসেছে। কিছু কর্তৃপক্ষ আছে এগুলো তদারকি করার। কোনো না কোনোভাবে তারা এগুলো দেখতে চাইছে না। কাজেই দ্রুত পানি জমে যাচ্ছে। চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হয়ে পানি আর নামছে না। সিডিএর কি চোখ নেই, তারা কেন এসব দেখছে না?’

জলবদ্ধতার প্রসঙ্গ টেনে এনে মিন্টু বলেন, ‘বৃষ্টি হতে না হতেই পানি জমে যায়। মানুষ কষ্ট পায়। লোকে আমাকে মন্দ বলে। কিন্তু কথা হলো, আমরা তো কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যারা (সিডিএ) বিল্ডিংয়ের প্রাণ দেয়। এখানে তারা কি সবকটা স্থাপনার অনুমতি দিয়েছে? আর যেগুলোতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কি তারা আদো তদারকি করেছে? এসব সমস্যা এতোটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে, বিস্তৃত হয়েছে; এ মুহূর্তে এগুলো লাইনে (সমাধান) আনার কাজটা খুব কঠিন হবে।’

চকবাজার এলাকাটিকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে উল্লেখ করে এই কাউন্সিলর বলেন, ‘আমি ৭৮ সালে ওয়ার্ড অফিসে বসে তখনকার বহুল প্রচলিত একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন পড়ছিলাম। সেখানে বিজ্ঞানীদের বরাতে বলা হয়েছিল- আগামী ৩০ বছরে ২০ থেকে ৩০ ফুট নিচে তলিয়ে যাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। তখন থেকে এখন অবদি আমি কাউন্সিলর বা পদে আছি। আমার কর্মজীবনে আমার এলাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি ১৭ থেকে ২০ ফুট উঁচু করেছি। কিন্তু ২০ ফুট উঁচু করার পরেও জোয়ারের পানি আসে। তার মানে এটা নয় কী যে, আগের সেই অঞ্চল তলিয়ে গেছে?’

চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষা করতে হলে কার্যকর নানা উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি, ‘শহর তলিয়ে যাওয়ার এই দীর্ঘ পরিবর্তন সাবেক মেয়ররা দেখেননি। তাই উনারা এটা উপলব্ধি করতে পারবেন না। যেহেতু আমি শুরু থেকে দেখেছি তাই অনুভব করতে পারছি। এ দেশের দক্ষিণাঞ্চল তলিয়ে যাবে তো বটেই, দ্রুত তলিয়ে যাবে। এই তলিয়ে যাওয়া থেকে শহরটাকে রক্ষা করতে হলে একটা হিসাব কষতে হবে। এই তলিয়ে যাওয়াটা কতদিনে কতফুট নিচে যাবে তার হিসাব।’

যা চাইলেন মেয়র রেজাউলের কাছে

চট্টগ্রামে আধুনিকায়নের সঙ্গে ‘জঞ্জাল’ বাড়ছে। অবকাঠামোগত বিভিন্ন উন্নয়নের পরেও পিছু ছাড়ছে না নানান সমস্যা। একদিকে রাস্তাঘাটে নালা নর্দমার পানি, আর অন্যদিকে কিছু এলাকায় সুপেয় পানির সংকট। যানজট সমস্যা; বেদখল হচ্ছে ফুটপাত, নালা, খাল, নদী। দীর্ঘ দিন ধরে জমতে জমতে বিভিন্ন সমস্যাই এখন ভর করেছে এই শহরের বুকে। 

কালের বিবর্তনে নব্বই দশকের গোড়া থেকে পালাক্রমে চট্টগ্রাম সিটির অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, এম. এ. বারী (বিভাগীয় কমিশনার), মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন, ওমর ফারুক (প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার), এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী, মোহাম্মদ মনজুর আলম, আ জ ম নাছির উদ্দিন, খোরশেদ আলম সুজন (প্রশাসক)। তাদের প্রায় সবার সঙ্গেই ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন গোলাম হায়দার মিন্টু। বারবার মেয়রের পালা বদলের ফলে অনেক কাজই করা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন তিনি— ‘এখানে মেয়র আসছেন, যাচ্ছেন। তারা শুধু নিজেদের মেয়াদকাল নিয়ে ভাবছেন। অথচ দূরদর্শীতার নিরিখে শহরটাকে সাজানোর প্রয়োজন।’

সত্তরোর্ধ্ব এ কাউন্সিলর বলেন, ‘আমি চকবাজার নিয়ে চিন্তা করবো। আর মেয়র পুরো সিটি নিয়ে চিন্তা করবেন। কিন্তু আমি যে বয়সে এসে পৌঁছেছি তাতে যদি কেবল নিজের এলাকা নিয়ে চিন্তা করি, সেটা হবে বোকামি। আমি বলব— সিটিতে একটা যুগপোযোগী মাস্টার প্ল্যান লাগবে। একজন মেয়র শুধুমাত্র তার পরিষদ নিয়ে একটা সিটি ডেভলপ করতে পারবেন না। এটা সম্ভব না, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলবো। এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, পুলিশ, প্রশাসন) সবার মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। তাই নবনির্বাচিত মেয়রের কাছে আমার প্রস্তাব থাকবে— সবাইকে নিয়ে শত বছরের একটা পরিকল্পনা করুন। আর সেভাবেই কাজ করতে হবে। আমি প্রস্তাব রাখবো ব্যক্তিগতভাবে, সাধারণ সভাতেও প্রস্তাব রাখবো।’

এদিকে সম্প্রতি কাউন্সিলর মিন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে নির্বাচনী হলনামায় দুদকের মামলার তথ্য গোপন করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তাহলে খুঁজে বের করুন। আপনারা তো সাংবাদিক। আমার কাছে কেন জানতে চাইছেন? আমি তো বলবো— আমি ধোয়া তুলসী পাতা। আমার যে কালিমা (দোষ) আছে সেটা কি আপনাকে বলবো? খুঁজে বের করুন।’


সিভয়েস/এপি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়