সম্পদ অর্জনে এমপিদের চেয়েও এগিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানরা
সিভয়েস২৪ ডেস্ক
সংসদ সদস্যদের পেছনে ফেলে গত পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে এগিয়ে রয়েছে উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের সম্পদ বৃদ্ধির হার ৪ হাজার ২০০ শতাংশের বেশি।
এছাড়া চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীর মধ্যে ১১৭ জন কোটিপতি।
দেখা যায়, ৫৬০ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ৯৪ জন কোটিপতি। ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬১১ জনের মধ্যে ১৭ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৪৩৫ জনের মধ্যে ৬ প্রার্থী কোটিপতি।
সোমবার (৬ মে) ধানমন্ডির টিআইবির কার্যালয়ে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপে ১৪৪ উপজেলায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এসব তথ্য জানায়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. মো ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, এনবিআর ও দুদকের। দেখা যাচ্ছে এবারের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের ১৩ জন স্বজন নির্বাচন করছেন। এধাপে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
উপজেলা নির্বাচন দলীয় হলেও নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোন প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট।
বিএনপি এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটি স্থানীয় প্রার্থীদের আটকাতে পারেনি। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ৭৩ জনকে বিএনপি বহিষ্কারও করেছে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে আসা ২২ জামায়াত নেতা পরে দলের সিদ্ধান্তে ভোট থেকে সরে দাঁড়ান।
সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, প্রথম ধাপে ভোটের জন্য ইসির ঘোষিত ১৫২টি উপজেলার মধ্যে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ১৪৪টির প্রার্থীদের হলফনামা নিয়ে তারা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। এসব উপজেলায় তিনটি নির্বাচনের প্রায় ৪ হাজার ৮০০টি হলফনামায় দেওয়া আট ধরনের তথ্যের বহুমাত্রিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ তারা করেছেন।
টিআইবি জানায়, পেশা হিসেবে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৪ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের হস্তক্ষেপ সরসময়ই বড় আলোচনার বিষয়। এবারও তাদের স্বজনদের মনোনয়ন নিয়ে চলমান নানা বিতর্কের মাঝেও প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের মধ্যে প্রার্থী হয়েছেন ১৩ জন। প্রার্থী হওয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে ভাইয়েরা। এরপর চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই, জামাতা- এমনকি তাদের ভাইয়ের ছেলেও আছেন তালিকায়।
জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট বাড়ছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় আট শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশ।
চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে ৬৯ দশমিক ৮৬ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যানদের প্রায় ৬৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
আর নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৫২ শতাংশই গৃহিণী। আয় নেই ১২ শতাংশের, ৩৯ শতাংশ নিজেদের আয়ের কোনো স্বীকৃত উৎস দেখাননি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ কম। এবারের উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন মাত্র ২৫ জন নারী।
পাঁচ বছরে একজন চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৩১৯ শতাংশ, ১০ বছরে এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ এক হাজার ৮২৩ শতাংশ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ চার হাজার ২৫১ শতাংশ। স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ এক হাজার ২৪০ শতাংশ। মোট প্রার্থীর মধ্যে প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে, বাকি সাত শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার বেশি। দ্বিগুণ হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা। ৪০ ভাগ প্রার্থী আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে। অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী।
অন্যদিকে ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমি আছে কমপক্ষে ১০ প্রার্থীর। আর ২৩ দশমিক ৪১ ভাগ প্রার্থীর ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৫২৮ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে সিলেটের বিশ্বনাথের এক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর। প্রার্থীদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বর্তমানে মামলায় অভিযুক্ত। এছাড়া অতীতে মামলায় অভিযুক্ত প্রার্থী রয়েছে ১৯ দশমিক ৭৬ ভাগ।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানায়, প্রথম ধাপের মতোই পরবর্তীতে দ্বিতীয়. তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণের ফলাফল পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে।
একইসঙ্গে সবশেষে এবারের উপজেলা নির্বাচনে সব (চার ধাপে) ধাপের নির্বাচন মিলিয়ে সব প্রার্থীর হলফনামার সার্বিক বিশ্লেষণের ফলাফল প্রকাশে সংস্থাটির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।