Cvoice24.com

রাঙামাটিতে সুপেয় পানির সংকটে ৩৪ শতাংশ মানুষ

মিশু দে, রাঙ্গামাটি

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ৯ এপ্রিল ২০২১
রাঙামাটিতে সুপেয় পানির সংকটে ৩৪ শতাংশ মানুষ

রাঙামাটির বরকল উপজলার সুবলং ইউনিয়নের মিতিঙ্গাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা আখি চাকমা। প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের জন্য সুপয় পানি সংগ্রহ করেন পাশ্ববর্তী গ্রাম চেয়ারম্যান পাড়া থেকে। মিতিঙ্গাছড়ি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা যােগে আধ কিলােমিটার দূরে গিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করেন তিনি। শুধু তিনিই নন, ওই গ্রামে বসবাস করা ৩৫-৪০টি পরিবারের সবাই একইভাবে পানীয় জল সংগ্রহ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

জুরাছড়ি উপজলার দুর্গম মদং ইউনিয়নর ভূয়াতলীছড়া গ্রাম ১৫টি পাহাড়ি পরিবারের বসবাস। ভূগর্ভ থেকে পানির স্তর পাথুরে হওয়ায় এই এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর করা সম্ভব হয়নি। তাই একমাত্র পানির উৎস হিসেবে কুয়ার পানি পান করে আসছেন এই পরিবারগুলো।

জুরাছড়ির দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নেও প্রতিবছর শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে তীব্র পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়। শুষ্ক মৌসুমে পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়া ও বর্ষা মৌসুমে পানীয় জলের উৎসগুলো অপরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কারণেই এই সময়টাতে পানীয় জলের সংকট দেখা দেয় বলে জানান এলাকাবাসী।

তবে কুয়া পাহাড় থেকে নিচু এলাকায় হওয়ায় ৪শ’ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে কুয়া হতে পানির সংগ্রহ করেন তারা। পানি সংগ্রহ করার সময় এক বয়োবৃদ্ধা জানান, তাদের পাড়ার মানুষ ছোট ছোট এসব কুয়া থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে থাকে।

জুরাছড়ির উপজেলার দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নে প্রতিবছরই শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে তীব্র পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়। তার কারণ হিসেবে এলাকাবাসী বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে ছড়া শুকিয়ে পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়া ও বর্ষায় কুয়ার পানি নানা ময়লা আবর্জনা পড়ে অপরিষ্কার হয়ে যাওয়া।

এটি শুধুমাত্র বরকলের সুবলং কিংবা জুরাছড়ির মদং, দুমদুম্যা ইউনিয়নের আধিবাসীদের হাহাকার নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামর প্রত্যেক পাহাড়ি গ্রামগুলােতে এই করুণ পরিস্থিতি। আদমশুমারির সর্বশেষ (২০১১) তথ্য অনুযায়ী, রাঙামাটি পার্বত্য জলায় মােট জনসংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন। এর মধ্যে বর্তমান জেলার ৬৬ শতাংশ মানুষকে সুপেয় পানীর সুব্যবস্থার আওতায় আনতে পেরেছে বলে দাবি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই)। 

তবে নির্বিচারে বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধনের দরুন ক্রমশ পানির উৎস হারাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। অন্যদিকে রাঙামাটি জেলাবেষ্টিত কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের পানিও পান অনুপযােগী। এতে করে কুয়া, ঝিরি-ঝর্ণা, ছড়ার দূষিত পানি পানের কারণে পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয় স্থানীয়রা।

বরকল উপজলার তাগালগছড়া মানর (গ্রাম) বাসিদা প্রণয় চাকমা জানান, তাদের পুরাে গ্রামের মানুষ একটি ছড়া থেকে কুয়ার ওপর নির্ভরশীল। এই কুয়ার পানিত গ্রামের ১৫০-২০০ মানুষ পানীয় জলের পাশাপাশি অন্যান্য কাজ সারেন।

প্রায় তিন দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করছে বেসরকারি উনয়ন সংস্থা (এনজিও) গ্রীনহিল। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন টুকু তালুকদারের মতে, শহুরে এলাকাসহ জেলার দশ উপজলায় মােট জনসংখ্যার মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষই সুপেয় পানির সংকট ভুগছেন। মূলত সমতলের পদ্ধতি ব্যবহার করে পাহাড়ে সুপয় পানির সংকট নিরসন করা যাচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাথুরে এলাকা হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সঠিক মতাে পাওয়া যায় না। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপনের মধ্য দিয়েও পানি সংকটের উত্তরণ ঘটছে না। যেহেতু এখানে সমতলের পদ্ধতি ব্যবহার করে পানি সংকট নিরসন করা যাচ্ছে না; তাই কিভাবে নিরসন করা যাবে এ নিয়ে গবেষণারও প্রয়ােজন রয়েছে।

আয়তন দেশের সবচেয়ে বড় ও রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজলার দুর্গম ইউনিয়ন সাজেক ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগেন সারা বছর।

পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ঝিরি-ঝর্ণাগুলো আগে থেকেই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি এলাকায় পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণা ও কুয়া। কিন্তু পাহাড়ে এখন নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে, পানির উৎস কমছে। কারণ গাছপালা না থাকলে পাহাড়ে পানি পাওয়া যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত বছরও (২০২০) জলার জুরাছড়ি দুমদুম্যা ও বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়ন সুপেয় পানির মাত্রাতিরিক্ত সংকট দেখা দিয়েছিল। তাই পাহাড়ের ভৌগলিক বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টদের গবেষণার মধ্য দিয়ে এই ব্যাপারে কাজ করত হবে। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামর সুপেয় পানির সংকট কাটবে না বরং আরাও বাড়বে।’

রাঙ্গামাটি জলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. মােস্তফা কামাল জানান, সুপেয় পানির অভাবে পানিবাহিত রােগ হিসেবে মূলত ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা, টাইফয়েড হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সুপেয় পানির সংকটের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ঝিরি-ঝর্ণার পানি পান করে থাকেন। তবে ইদানিংকালে ঝিরি-ঝর্ণার পানিও দূষিত হচ্ছে। তবে পাহাড়র চিকিৎসা সেবার অবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলেও আগে থেকে অনেকাংশে অগ্রসর হয়েছে। এখন প্রত্যেক অঞ্চলে ইউপি পর্যায় ক্লিনিক ছাড়াও কমিউনিটি ক্লিনিকের ফলে স্থানীয়রা সেখান থেকে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।

রাঙ্গামাটি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে এটি সত্য। ভৌগলিক কারণে সমতলের মতাে এখানে প্রকল্প গ্রহণ করে সুপয় পানির সংকট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে যাচ্ছি।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়