নৌকা বানানোর ওস্তাদ মাখন

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেন মাখন দাশ। তবে বয়স বাড়লেও এখনো দক্ষতা দিয়ে আপন মনে নিখুঁত নৌকা তৈরিতে বেশ পারদর্শী মাখন দাশ। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ইছাখালীতে আদি নিবাস এই দক্ষ কারিগরের। তবে এই বয়সেও কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীর তীরে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি। সম্প্রতি নদীর বালুরচর ঘাটে কথা হয় মাখন দাশের সঙ্গে। 

তিনি জানান, এই কাজে তাঁর ওস্তাদ আপন বড় ভাই। দীর্ঘ ৫৫ বছর যাবৎ নৌকা বানিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এই পেশার রোজগার দিয়েই পরিবারের ভরণপোষণ করে আসছেন তিনি। নিজের চার ছেলেকে বড় করেছেন। হয়েছেন প্রতিষ্ঠিতও। তারা কেউ বাবার এই পেশায় আসতে নারাজ। তবে সম্প্রতি বিদেশে দুর্ঘটনায় এক ছেলের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ৩ ছেলে অন্য পেশায় প্রতিষ্ঠিত।

এখন বয়স হয়েছে, চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। তারপরও এই কাজেই ব্যস্ত থাকেন তিনি। কেবল এক বা দুইরকম নয়, বেশ কয়েক ধরনের নৌকা তৈরি করতে পারেন মাখন দাশ। যার মধ্যে ট্যাম্পু বডির বোট, ডিঙি নৌকা, জেলেদের মাছ ধরার নৌকা, ছোট, মাঝারি সাম্পান ইত্যাদি।

মাখন দাশ বলেন, ‘একসময় রাঙামাটির অনেক দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে তিনি নৌকা তৈরি করেছেন। পার্বত্য অঞ্চল ছাড়াও চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, পেকুয়া, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নৌকা তৈরি করেছেন। তবে সেসময় নৌকা-বোটসহ জলযানের চাহিদা অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে সড়ক পথের উন্নয়নে অনেক স্থানে নৌ-পথ ব্যবহার কমে গেছে। যার ফলে নৌকা, অনেক কমে গেছে বোট তৈরির কাজও।’ 

তিনি বলেন, ‘এমন একটা সময় ছিলো যখন তার হাতে নৌকা তৈরি করার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতেন ক্রেতারা। দম ফেলারও সময় পেতেন না। তবে কালের বিবর্তনে এখন নৌকা বানানোর ব্যস্ততা তেমন নেই। তখনকার দিনে নৌকা বানিয়ে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি পেলেও এখন তা অনেক বেড়েছে। বর্তমানে দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন তারা। এছাড়া অনেক নৌকার কারিগর কাঠের ফুট হিসেবে মজুরি নির্ধারণ করেন।

একটি ভালো নৌকা তৈরি করতে কি কি প্রয়োজন এবং কতদিন সময় লাগে জানতে চাইলে মাখন দাশ জানান, একটি নৌকা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে ভালো মানের কাঠ। এছাড়া কাঠের সেইপ ঠিক করার জন্য খনিজ আলকাতরা, পেরেক, ধুপের গুড়ি, ডিজেল অথবা কেরোসিন তেলের প্রয়োজন হয়। এছাড়া করাত ও আসবাবপত্র তৈরির মেশিন দিয়ে এই নৌকা তৈরি করা হয়। 

তিনি জানান, আকারভেদে একটি নৌকা তৈরি করতে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন হয়। বড় বোটগুলোতে এক থেকে দেড় মাসও লেগে যায়। ছোট ডিঙি নৌকা বা মাঝারি মাছ ধরার নৌকা বানাতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাগে। আবার আকারভেদে বড় নৌকা বা ইঞ্জিনবোটগুলো বানাতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকাও পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে।

মাখন দাশের মাধ্যমে নৌকা তৈরি করেছেন কাপ্তাইয়ের সমির দাশ, মো. বাচ্চু আহামেদসহ একাধিক জেলে জানান, মাখন দাশ খুবই দক্ষ একজন নৌকার কারিগর। তার বানানো নৌকা দিয়ে কাপ্তাইয়ে অনেক জেলে মাছ শিকার করে। তবে বর্তমানে নৌকার চাহিদা একটু কমে যাওয়াতে মাখন দাশের কাজও কমে গেছে। কিন্তু নৌকা তৈরির কাজে এখনোও তিনি বেশ পারদর্শী। 

তারা বলেন, তবে বর্তমানে আধুনিকতা ছোঁয়ায় নৌকা ব্যবহার কমে যাচ্ছে। যার ফলে এই পেশার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তাই মাখন দাশদের মতো দক্ষ নৌকার কারিগর গড়ে তুলে এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।