Cvoice24.com

মশার ওষুধ জলে ঢালছে চসিক 

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ১২ মার্চ ২০২১
মশার ওষুধ জলে ঢালছে চসিক 

নিয়ম মেনে ওষুধ না মারার কারণে মশা মরছে না।

মশা মারতে কামান দাগানোর অবস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। দফায় দফায় বৈঠক, ঢাকা থেকে মশা মারার কৌশল শিখে আসা এবং কোটি কোটি টাকার ওষুধ কিনেও মশার বিস্তার থামাতে পারছে না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বরং মশার উৎপাতে দিনে রাতে থাকা দায়। একই ওষুধ ঢাকায় ছিটানোর পর কার্যকারিতা পেলেও চট্টগ্রামে কেন পাওয়া যাচ্ছে না- এর পেছনের কারণ পাওয়া গেছে দুটি। এক—নিয়ম মেনে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। সময়ের ওষুধ অসময়ে যেনতেন ভাবে ছিটানো হচ্ছে। দুই—মশা মারার জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যে পরিমাণ মেশিনের প্রয়োজন তার সিঁকিভাগও নেই। ফলে বিশাল ওয়ার্ডের এক অংশে মশার ওষুধ ছিটানো হলেও আরেক অংশে ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মশার বিস্তার কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না।

চসিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গেল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সমন্বয় করে ওষুধ ছিটাচ্ছে চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগ। সেই হিসেবে মশার ওষুধ ছিটাতে বড় ভূমিকা রাখছে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। অথচ কাউন্সিলররা জানান, মশা মারতে ‘গুরুদায়িত্ব’ পালন করছেন চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ড সুপারভাইজারা। সঠিক নিয়ম ও সময়ে মশার ওষুধ ছিটানো না হলে ওষুধে উপকারী পোকা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে মত কীটতত্ত্ববিদদের। সেই সাথে প্রতি চালানে কোটি টাকার মশার ওষুধ কেনা হলেও তা ছিটাতে পর্যাপ্ত ফগার ও হ্যান্ড স্প্রে-মেশিন নেই চসিকের। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চসিকের কাউন্সিলররা।

কিন্তু বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে মশার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমে দেখা গেছে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ করছেন কাউন্সিলররা। অথচ ঢাকা থেকে ফিরে আসা ওই টিমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল—“উড়ন্ত মশা মারতে ‘ম্যালাশন’ (এডাল্ট্রিসাইড) ওষুধটি ফগার মেশিনের মাধ্যামে বিকাল বেলা ছিটানো হয়। অন্যদিকে ‘টেমসস’ (লার্ভিসাইড) ওষুধটি ছিটানো হয় সকাল।”

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশার ওষুধ ছিটানোর আদর্শ সময় হলো বিকাল বেলা। অর্থ্যাৎ সন্ধ্যার এক ঘণ্টা আগে ও পরে মশার ওষুধ ছিটালে এতে ধ্বংস হয় উড়ন্ত মশা। সকালে মশার ওষুধ ছিটানো হলে মশার পরিবর্তে উপকারী পোকা মরার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

বাংলাদেশ বন ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষক (কীটতত্ত্ব বিভাগ) মোহাম্মদ জুনায়েদ  সিভয়েসকে বলেন, ‘মশার  ওষুধ ছিটানোর উপযুক্ত সময় সন্ধ্যার আগে পড়ে। ওই সময়ে মশার প্রকট বেশি থাকে।’

দিনের বেলা ওষুধ ছিটালে তার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দিনের বেলা কিছু উপকারী ইনসেক্ট (পোকা) থাকে। আর সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

চট্টগ্রাম জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মুহিদুল হক সিভয়েসকে বলেন, ‘মশক নিধনে অবশ্যই টাইম শিডিউল মানতে হবে।’

আসন্ন জুন, জুলাই, আগস্ট মশা বিস্তারের ‘পিক আওয়ার’উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মশক নিধনে এখনই সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেওয়া না হলে পিক আওয়ারে তা বহুগুণে বেড়ে যাবে।’

অন্যদিকে মশার আচরণগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় ওষুধ ছিটাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা জানান, উত্তর ঢাকার ৫৪টি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইড ছিটানো হয় সকাল ৮টা থেকে সকাল ১১ টার মধ্যে। এবং এডাল্ট্রিসাইড ছিটানো হয় সূর্যাস্তের ১ ঘণ্টা আগে থেকে ১ ঘণ্টা পর। 

সম্প্রতি মশক নিধন ও পরিচ্ছ্ন্নতা অভিযান শুরু হয়েছে চসিকের ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর অধ্যাপক মো. ইসমাইল সিভয়েসকে বলেন, ‘দুপুর ৪ টা থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত আমরা বড় মশার ওষুধ ছিটাই। অন্যগুলো (লার্ভিসাইড) সকাল ৯টা থেকে ছিটাই।’ 

সিটি করপোরেশন থেকে দেওয়া ওষুধ ছিটিয়ে মশা কমছে না বলে মন্তব্য করেছেন ১৩ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা তো ওষুধ ছিটাচ্ছি। কিন্তু মশা কমছে না। সিটি করপোরেশনের ওষুধগুলো কাজ করছে না। এখন আমাকেই ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।’ 

তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোর্শেদুল আলম চৌধুরী। সিভয়েসকে তিনি বলেন, ‘দুইবার ওষুধ পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রতিটি ড্রাম থেকে আলাদা আলাদা নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ যে ওষুধ দিচ্ছে সেটাই আমরা ছিটাচ্ছি। ঢাকায়ও একই ওষুধ দিচ্ছে।’

কেনা হয় কোটি টাকার ওষুধ, ছিটানোর মেশিন নেই চসিকে

ঢাকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০টি ফগার মেশিন এবং ১০টি স্প্রে-মেশিন মজুদ থাকতে হবে।’ অথচ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডগুলোতে মেশিন মজুদ তো দূরেই থাক, খোদ সিটি করপোরেশনের স্টোরেও মেশিন মজুদ নেই বলে জানা গেছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে যে কয়টি মেশিন দেওয়া আছে তা-ও ‘নষ্ট’ বলে ক্ষোভ ঝেড়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা।

১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অধ্যাপক মো. ইসমাইল সিভয়েসকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে ৭-৮টি ফগার মেশিনের চাহিদা রয়েছে। হ্যান্ড স্প্রে-মেশিন প্রয়োজন ৫-৭টি। আমাকে ২/৩ টি করে দেওয়া হয়েছে।’

একই আক্ষেপ ১৩নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিনের। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই মেশিন কিনেছি।’

১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল আলম মিয়া সিভয়েসকে বলেন, ‘ওয়ার্ডে একটি ফগার মেশিন ছিল এখন সেটি নষ্ট। আমরা ঠিক করার চেষ্টা করছি।’

সিটি করপোরেশনের স্টোর থেকে পাওয়া তথ্য জানা গেছে, ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে ২০টি ফগার মেশিন কিনেছিল চসিক। যার মধ্যে বর্তমান মজুদে রয়েছে মাত্র ১২টি। অন্যদিকে ২০২০ সালের এপ্রিলে কেনা হয়েছিল ১৫০টি স্প্রে-মেশিন যার মধ্যে চসিকের স্টোরে বর্তমান মজুদ আছে মাত্র ১টি। অথচ চসিকের স্প্রে মেশিনের চাহিদা থাকলেও তা কেনা হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। অন্যদিকে বেশ কয়েক ধাপে কেনা হয়েছে কোটি টাকার ওষুধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাউন্সিলর সিভয়েসকে বলেন, ‘মেশিন না থাকলে ওষুধ ছিটাবো কি দিয়ে? চাহিদা জানানোর পরও ফগার মেশিন দেওয়া হচ্ছে না।’

অন্যদিকে মজুদ শেষ হয়ে আসার কারণে ফের মশার ওষুধ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সিটি করপোরেশন- এমনটাই জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র। ওই সূত্রটি বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিলে ১০ হাজার লিটার এডাল্ট্রিসাইড ও ২০২১ সালের শুরুতে লাইট ডিজেল ওয়েল (এলডিও/কালোতেল) ১২ হাজার লিটার কেনা হয়েছে। এর মধ্যে এডাল্ট্রিসাইড মজুদ আছে প্রায় ২ হাজার লিটার এবং ফুরিয়ে গেছে কালো তেলের মজুদ। 

এমন বাস্তবতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় মশক নিধনে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে অভিমত স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের। কাউন্সিলররা বলছেন, ‘মশক নিধনের মেশিন না দেওয়া হলে দারুণ বিঘ্নিত হবে মেয়রের ঘোষিত ১০০ দিনে বিশেষ কার্যক্রম।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাউন্সিলর সিভয়েসকে বলেন, ‘আসলে সিটি করপোরেশনের তো আর্থিক সমস্যা আছে এটা আপানারা জানেন। আমরাও জানি। তবে নতুন মেয়রের কাছে ভালো কিছু প্রত্যাশা করি আমরা।’

কিন্তু নতুন ফগার ও হ্যান্ড স্প্রে-মেশিন কেনার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা এবং মশার ওষুধ ছিটাতে কাউন্সিলদের কৌশলগত কি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করেননি মেয়র এম. রেজাউল করিম চৌধুরী এবং চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুজ্জামেল হক। এতে করে চসিকের বক্তব্য জানা যায়নি।

-সিভেয়স/এপি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়