বিরামহীন গাড়ি চালাচ্ছেন চসিকের ৫২৯ চালক, ঘটছে দুর্ঘটনা
সিভয়েস প্রতিবেদক
প্রতিকী ছবি।
এমনিতেই চট্টগ্রাম নগরের সড়কজুড়ে বেহাল দশা। তার উপর বিভিন্ন সড়কগুলোর অর্ধেক দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ দোকান- ইচ্ছেমত পার্কিং। এতসব অনিয়মের সাথে পাল্লা দিয়ে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৯ শতাধিক গাড়ি। কিন্তু এর বিপরীতে চসিকের চালক আছে প্রায় ৫২৯ জন। জনবল সংকটসহ বিভিন্ন কারণে সেই চালকরা গাড়ি চালাচ্ছেন স্বাভাবিক নিয়মের দ্বিগুণের বেশি সময় ধরে। স্টিয়ারিং হাতে চসিকের এ ওভার ডিউটি করতে গিয়ে যেন ঘটছে একে একে সব ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা! সবশেষ মঙ্গলবার (৪ অক্টোরব) চসিকের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় পা থেতলে যায় সুজন নামে এক সাইকেল আরোহীর।
এরআগে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি চসিকের ময়লাবাহী গাড়ি চাপায় প্রাণ হারায় রিকশা যাত্রী কুলসুম বেগম। সকাল ৮টার দিকে গার্মেন্টেসে যাওয়ার পথে আগ্রাবাদ চৌমুহনী মোড়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন এ পোশাক শ্রমিক। চসিকের গাড়ি চালকদের বেপোয়ারা দুর্ঘটনার শুরুটা এখনেই নয়। গত বছরের ২১ অক্টোবর চসিকের স্কেভেটরের চাপায় ঝরেছিল মো. সজীব নামের আরও এক শিশুর প্রাণ।
নগরের ওয়ারলেসের ৪ নাম্বার গলির মুখে খাল খননের সময় স্কেভেটরের চাকার নিচে পড়লে শিশুটির মৃত্যু হয়—ওই সময়ে জানিয়েছিলেন চসিকের কর্মকর্তারা। তাছাড়া প্রাণঘাতী বড় এসব দুর্ঘটনার বাইরেও ছোট দুর্ঘটনার খবর পওয়া যায় প্রায় সময়।
কিন্তু চসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটানো হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে এতে দুপক্ষের অসচেতনতায় দায়ী। তবে চসিকের চালকদের ওভার ডিউটি করতে হচ্ছে এ কথাটাও সত্য।’
সবশেষ ৪ অক্টোবরের ঘটনার ব্যাপারে চসিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই ময়লাবাহী গাড়ির চালক ছিলেন মো. বাবুল। প্রায় ৪৫ বছরের এ চালক দীর্ঘদিন ধরে চসিকের চালক হিসেবে কাজ করে আসছেন। দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে চসিকের কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন—ওভার ডিউটি নয়, অসর্তকতার সাথে চালাচ্ছিলেন সাইকেল আরোহী সুজন।
তবে প্রতক্ষ্যদর্শী সাফকাত মির্জা নামে এক তরুণ তার ফেসবুকে লিখেন - ‘প্রবর্তক মোড় থেকে ২নং গেইট যাওয়ার রাস্তাটা অনেক ছোট। কিছু গাড়ি অবৈধ কার পার্কিং করার কারণে রাস্তায় যাতায়াত করতে অনেক সমস্যা হয়। আর ঔ রাস্তা দিয়ে বড় কোন গাড়ি ডুকলে তো কথাই নাই। আজ ছেলেটিকে সিটি করপোরেশনের এই গাড়িটি ধাক্কা দেয় এবং সে গাড়ির চাক্কার নিচে পরে যায় এবং তার বাম পা থেতলে যায়।’
এদিকে চসিক সূত্রে জানা গেছে- সিএনজি অটোরিক্সা, কার, মাইক্রো, পিকআপ, স্কেভেটর, ময়লাবাহী ট্রাক-ডাম্পিং গাড়িসহ বিভিন্ন রকমের প্রায় ৯ শতাধিক যান্ত্রিক গাড়ি আছে চসিকের অধীনে। এদের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে ২ শতাধিক যান্ত্রিক গাড়ি প্রতিদিন সড়কে নামছে। এর বাইরে সিএনজি অটোরিক্সাসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক গাড়ি নামছে দেড়শরও বেশি। অন্যদিকে চসিকের অধীনে স্কেভেটর আছে ২২টি। এর বিপরীতে চালক ১৫ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক সিভয়েসকে বলেন, ‘৮ ঘন্টা ডিউটি করার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ সময় দিনে ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা সড়কে কাটিয়ে দিতে হয়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হয়।’
চসিকের কর্মকর্তারা বলছেন ‘চালক সংকটে সব কাজ এক সাথে করার পরিকল্পনা করা যায় না। আবার প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রায় দুই’শ চালক একসাথে নিয়োজিত রাখতে হয়। সব মিলিয়ে চালক সংকটে ধুঁকছে সিটি কর্পোরেশন।’
পরিবহন শ্রমিকেরা বলছেন, কর্মঘণ্টা মানলে চসিকের গাড়িগুলো চালাতে অন্তত দুইজন চালক দরকার। সংকটের কারণে একজনকেই ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয়। ফলে চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়েই গাড়ি চালাতে হচ্ছে। এ কারণেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়েছে।
শ্রম আইন অনুযায়ী, একজন চালক একটানা সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা, সারা দিনে আট ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারবেন। চালকদের কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবহন মালিক তথা চসিকের। তবে এখানে সেটি হচ্ছে না।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চসিকের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাক সিভয়েসকে বলেন, ‘কোন চালক দুর্ঘটনা ইচ্ছে করে ঘটায় না। বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। তবু চসিকের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ৩০ হাজার টাকা ওই (সুজনের) পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে সবসময় খোঁজ খবর নিচ্ছেন মেয়র মহোদয়। উনাদের চিকিৎসা খরচ (১ লাখ ৩০ হাজার টাকা) চসিক দেবে।’
সিটি কর্পোরেশনের চালক সংকটের ব্যাপারে জানতে চাইলে সুদীপ বসাক বলেন, ‘আমাদের চালক সংকট আছে। কিন্তু কাজের স্বার্থে ওভারডিউটি করতে হয়। এটা আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কর্তৃপক্ষ ভালো মনে করলে ব্যবস্থা নিবে।’
এ বিষয়ে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ করেন নি চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজ্জামেল হক। তবে চসিক মেয়রের একান্ত সচিব মো আবুল হাশেম সিভয়েসকে বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনে চালক নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। লকডাউন ও করোনার কারণে একটু সময় লাগছে।’
-সিভয়েস/এপি