Cvoice24.com

জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়েই কক্সবাজার যাবে ট্রেন— দুর্ঘটনা এড়াতে বুয়েটের দ্বারস্থ রেল

আসিফ পিনন

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৬ জুন ২০২১
জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়েই কক্সবাজার যাবে ট্রেন— দুর্ঘটনা এড়াতে বুয়েটের দ্বারস্থ রেল

কালুরঘাট সেতু। ফাইল ছবি।

প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেল লাইন নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২২ সালেই ট্রেনে চড়ে কক্সবাজারে যাওয়ার আশা দেখাচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সাবাজার যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে কালুরঘাট সেতু। আর তাতেই বিপত্তি ও যত প্রশ্ন। শতবর্ষী জরাজীর্ণ জোড়াতালির এই কালুরঘাট সেতু দিয়েই কি পার হবে কক্সাবাজারগামী ট্রেন? নাকি কালুরঘাট নতুন সেতু দিয়েই কক্সবাজারে যাবে ট্রেন? 

২০২২ সালে যদি ওই রুটে ট্রেন চলাচল শুরু করা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই কালুরঘাট পুরানো সেতু দিয়েই কক্সবাজার যেতে হবে। কেননা নতুন সেতু যে কখন হবে সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। শুধু কখন সেটার দিনক্ষণ নয়, এটি কি ডেডিকেটেড সিঙ্গেল ট্র্যাক রেলসেতু কিংবা একটি ডাবল ট্র্যাক অথবা একটি সড়ক-কাম-রেলসেতু হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত কোনও চূড়ান্ত পৌঁছাতে পারেনি রেলওয়ে। গত বছরের অক্টোবরে সিঙ্গেল ট্র্যাক রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেও তা নানা কারণে পিছিয়ে গেছে। এখন নতুন করে করা সমীক্ষা রির্পোটের ওপর নির্ভর করছে কীভাবে হবে সেতুটি। আর এই সমীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এ বছর পর্যন্ত। এরপর নকশা প্রণয়ন, বাজেট, জমি অধিগ্রহণসহ নানা কর্মযজ্ঞ পেরিয়ে কালুরঘাট নতুন সেতুর কাজ শুরু এবং শেষ হতে আরও পাঁচ থেকে সাত বছরের বেশি সময় লাগবে। 

এমনটিই ধরে নিয়ে চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেল যোগাযোগ স্থাপনে এখন রেলওয়ের চিন্তায় কালুরঘাট পুরান সেতুটি। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগেই কালুরঘাট সেতু দিয়ে কীভাবে ট্রেন চলাচল করা যাবে তার উপায় খুঁজছে রেলওয়ে। পুরানো এ জরাজীর্ণ সেতু দিয়ে কীভাবে ট্রেন চলাচল করবে তা জানতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)  দ্বারস্থ হচ্ছে রেলওয়ে। সেতুর বর্তমান অবস্থায় কীভাবে ট্রেন ঘুমধুম যাবে তা জানতে চলতি মে মাসে পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাবনা পাঠাচ্ছে রেলওয়ে।

রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ বলছে, জরাজীর্ণ পুরানো সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচলের সময় দুর্ঘটনা এড়াতে বুয়েটের পরামর্শক নিয়োগ দেব রেলওয়ে। পুরানো কালুরঘাট সেতু  ১২ টন পর্যন্ত লোড নেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু নতুন রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হলে তার সর্বোচ্চ লোড ১২ থেকে ১৫ টন পর্যন্ত হতে পারে। যেখানে মিটারগেজ ট্রেনে চলবে ধীরগতিতে। পুরানো এ সেতুতে ব্রডগেজ ট্রেন চলানো সম্ভব নয়। এর উপর আবার পুরানো সেতুতে বারবার জোড়াতালি পড়েছে। ফলে ১২ টন লোড নেওয়ার যে সক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে তা নিয়েও সংশয় আছে। তাছাড়া এ সেতুর উপর দিয়ে দিনভর ভারী যান চলাচল করছে। যার ফলে পুরানো সেতুটির দুর্বলতা বাড়ছে। অন্যদিকে ২০২২ সালের মধ্যেই কর্ণফুলী নদী পার হয়ে কক্সাবাজার যাবে ট্রেন। সব মিলিয়ে এই পুরান সেতুকেই ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত করাই রেলওয়ের প্রধান কাজ। সেকারণে তারা এখন বুয়েটের বিশেষ টিমের দ্বারস্ত হচ্ছে। 

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আহসান জাবির সিভয়েসকে বলেন, ‘চলতি মাসে বুয়েটের পরামর্শক নিয়োগের ব্যাপারে বুয়েটে প্রস্তাবনা পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। তবে এ সেতু দিয়ে মিটরগেজ ট্রেন চলাচল করা যাবে।’

সরজেমিনে দেখা যায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ায় কর্ণফুলী নদীর উপরে ব্রিটিশ-যুগের সেতুটি ব্যবহার এখন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এবং অনেক সময় ধরে এ অবস্থা চলছে। উভয় পাশের ডেক এবং লোহার বেড়া প্রায়শই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং সেতুর সারফেসে গর্ত তৈরির ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় সেতুটি দিয়ে চলাচল করা কয়েকশো যানবাহনকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চলাচলের উপযোগী রাখার জন্য কর্তৃপক্ষকে মাঝে মধ্যেই সেতুটিকে মেরামত করতে হয়। ষোলশহর থেকে দোহাজারী অংশে যেখানে সেতুটি অবস্থিত সেখানে রেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৩০ কিলোমিটার। বোয়ালখালী উপজেলা, পটিয়ার পূর্ব এবং রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মানুষের নদী পার হওয়ার জন্য সেতুটির বিকল্প নেই।

জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম নিয়ে যাওয়া কতুটুকু নিরাপদ? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তা যাচাইয়ে বুয়েটের পরামর্শক নিয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে। পরামর্শক টিমের পরামর্শ অনুসারে বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ 

এদিকে রেলওয়ে সূত্র জানায়, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে মাটির উন্নয়নের কাজ চলছে। কোথাও চলছে সেতু নির্মাণ। প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, এ পর্যন্ত কাজ এগিয়েছে ৬০ শতাংশ। ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পের দোহাজারী-কক্সবাজার অংশের শতভাগ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এতে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি। 

২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ রেলপথ নির্মাণ হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এছাড়া কক্সবাজার থেকে কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামালসহ বিভিন্ন বনজ ও কৃষিজাত পণ্য পরিবহন সহজ হবে। পর্যটন নগরীর সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ ২০২২ সালের মধ্যে স্থাপিত হবে। প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার রেলপথ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণ করা হবে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭২৫ কিলোমিটার রেলপথ। 

দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হবে। হাতি চলাচলের জন্য থাকবে আন্ডারপাস। নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজারে। এর মধ্যে দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ করছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) ও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। করোনার কারণে কিছুটা থমকে গেলেও এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এ প্রকল্পের কাজ ২০১৮ সালের ১ জুলাই এ অংশের ভৌত কাজ শুরু হয়। বর্তমানে ১৯টি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। ১১৯টি কালভার্টের মধ্যে ২৪টির কাজ শেষ হয়েছে। ৪৯ কিলোমিটারের মাটির কাজ চলছে। দোহাজারী, চকরিয়া ও হারবাংয়ে রেলস্টেশন ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়