Cvoice24.com

সিআরবিতে হাসপাতাল হবেই— সিভয়েসকে রেলপথ মন্ত্রী সুজন

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:০০, ১৩ জুলাই ২০২১
সিআরবিতে হাসপাতাল হবেই— সিভয়েসকে রেলপথ মন্ত্রী সুজন

প্রস্তাবিত জায়গাতেই হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রী।

চট্টগ্রাম নগরের বুকে এক টুকরো সুবজে ঘেরা সিআরবিতে আধুনিক হাসপাতালের নামে শতবর্ষী গাছ কাটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনসহ সর্বস্তরের জনগণ। তবে জনগণের বিরোধিতা থাকলেও বর্তমান রেলওয়ে হাসপাতালটির সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) নতুন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের নির্মাণ কাজ থেকে পিছু হটছে না রেলওয়ে। যতই বিরোধিতা থাকুক প্রস্তাবিত জায়গাতেই হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন এমপি। 

মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে সিভয়েসকে রেলপথ মন্ত্রী বলেন, ‘‘বিরোধীতাকারীরা বিরোধিতা করবেই। আমরা প্রস্তাবিত জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণ করব। সেখানে পরিবেশের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। আমরা সব কিছু মেনটেইন করে আমাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।’  

অপরদিকে স্থানীয় সাংসদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একই সময়ে লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন পরিবেশের প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই। সুতরাং বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আস্থা রাখুন। চট্টগ্রামে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সদরদপ্তর সিআরবির একটি জায়গায় সরকারি বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মাণ এবং পরিবেশ ও বৃক্ষ সংরক্ষণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে শীঘ্রই আলোচনা করে এর একটি সমাধান করা হবে।’

এই জায়াগতেই গড়ে উঠবে নতুন রেলওয়ে হাসপাতাল।

তিনি আরও লিখেনে, ‘শহরের প্রানকেন্দ্রে এই দৃষ্টিনন্দন সবুজ জায়গায়, পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে এই উন্মুক্ত জায়গায় যেনো অবকাঠামো নির্মাণ না হয়, এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রকল্পের জায়গা আর উন্মুক্ত জায়গা সমূহের স্থান এক নয়, বা একই জায়গায় কি না, সেটি নিয়ে আলোচনা হবে। একই স্থানে হলে সেটিকে সরানোর প্রয়োজন হবে। কোনোভাবেই উন্মুক্ত জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে না।’

সাত রাস্তার মোড় হয়ে সড়কের বাম পাশে বর্তমান রেলওয়ে হাসপাতাল, পাশের খালি জমি, রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি রোড এবং এই রাস্তাটির দুপাশে থাকা প্রায় ৫০টি কর্মচারী কোয়ার্টার (একতলা সেমিপাকা) নিয়ে মোট ছয় একর জমিতে হাসপাতালটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় সিসিইএ সভায়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।

এরপর গত বছরের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সাথে সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তারপর চলতি বছরের শুরুতে নির্ধারিত জমির সামনে প্রকল্পের একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এই প্রকল্পের পরিকল্পনা ও সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি)। কার্যনির্বাহী সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করবে ইউনাইটেড চট্টগ্রাম হাসপাতাল লিমিটেড। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ১০০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং দুই ধাপে মোট ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ হবে। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা হবে রেলওয়ের। এরপরই রেলওয়ের ওই স্থানে বৈধভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয় রেলওয়ে। 

তবে শুরু থেকেই এ হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল রেলওয়ে শ্রমিকলীগ, সিবিএসহ বিভিন্ন সংগঠন। বেশ কয়েক দফা আলোচনার পর সেই ঝামেলা কেটে গেলে এবার সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্টজনরা। 

প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক এ স্থানে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলন বা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে তারা বাধ্য হবে। ঐতিহাসিক ও নান্দনিক  এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে গত  সোমবার গণমাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়েছেন তারা। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, ঐতিহ্যবাহী সিআরবি-সাত রাস্তার মোড় এলাকায় বেসরকারি সংস্থার বহুতল হাসপাতাল নির্মাণের খবর চট্টগ্রামের আপামর মানুষকে অত্যন্ত ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করেছে।'

তারা আরও বলেন, 'সিআরবি, সাত রাস্তার মোড় ও টাইগার পাস ঘিরে থাকা পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালামণ্ডিত এলাকাটি চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই গণ্য। হাসপাতালের কারণে জন সমাগম বৃদ্ধি ও ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সিআরবি এলাকার নির্জনতা ও পরিবেশ ঝুঁকিতে ফেলবে। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলন বা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে তারা বাধ্য হবে।' 

এ নিয়ে নানা প্রশ্ন, বিভ্রান্তি ও সমালোচনার মুখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বলছে— সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ বিষয়ে এখনো পরিবেশগত রিপোর্ট পায়নি সিডিএ। এ রিপোর্ট পেলে বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় নানা শর্ত আরোপ করে হাসপাতাল নির্মাণের অনুমতি দেবে সংস্থাটি। 

রেলওয়ের পরিত্যক্ত এ জায়গাতে হাসপাতাল করা হবে।

সিডিএ'র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সিভয়েসকে বলেন, 'এখানে শতবর্ষী গাছ আছে সেগুলো কাটা যাবে না। ফ্রি স্পেসে করতে হবে। ওখানে রেলওয়ের একটি হাসপাতাল আছে। শুনেছি তার পাশেই নতুন হাসপাতাল করা হবে। সেখানে করলে আপত্তি নেই। তবে শিরিষ তলায় করা যাবে না।'

তিনি আরও বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে পাহাড়ি এলাকায় ৬ থেকে ৭ তলার বেশি অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে মাস্টার প্ল্যানের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু হলে সেখানে এ স্থাপনার অনুমতি দেওয়া হবে না। এটা যদি আমাদের গাইডলাইনের ব্যতিক্রম হয় তাহলে অনুমোদন দেওয়া হবে না। উনারা এখনও আমাদের রিপোর্ট দেয় নি। রিপোর্ট দিলে সবার সাথে বসে সবকিছু বিবেচনা করা হবে।' 

অন্যদিকে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিবৃতির পাশাপাশি একটি প্রতিবাদলিপিতে নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ওই প্রতিবাদলিপিতে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ওই এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণে এনভায়রমেন্ট এসেসমেন্ট (প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশগত পরিণতি মূল্যায়ন) করার কাজ চলছে। তার জন্য পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে রেলওয়ে। 

রেলওয়ে প্রকৌশলীদের দাবি, সিআরবির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত যে অংশে শতবর্ষী গাছ, শিরিষ তলা, সেখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে না। হাসপাতালের জন্য নির্ধারণ করা স্থানে কেবল একটি শতবর্ষী গাছ আছে, যা রক্ষা করা হবে। 

এ বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) এবং প্রকল্প পরিচালক মো. আহসান জাবির সিভয়েসকে বলেন, 'হাসপাতাল নিয়ে যে বিভ্রান্তি এটা কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সৃষ্টি করেছে। এ হাসপাতাল শিরিষতলায় করা হবে না। বর্তমান রেলওয়ে হাসপাতালের পাশে পরিত্যক্ত জায়গায় এটা করা হচ্ছে। ওখানে একটি শতবর্ষী গাছ আছে। সেটা কাটা হবে না, সেভাবেই প্ল্যানে আছে।’ 

হাসপাতাল নির্মাণ হলে সেখানে মোট কতটি গাছ কাটা যাবে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'দেখুন আমি আগেই বলেছি এ বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ লিপি দিয়েছি। সেখানেও আমরা সেটা বলেছি।' পরে দুই - চারটি গাছ কাটতে হতে পারে বলে দাবি করেছেন তিনি।

সম্প্রতি রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির ১৫-২০টি বাসা ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় থাকা বাকি বাসাগুলোও সরানোর প্রক্রিয়া চলছে। এরপর ক্ষুব্ধ রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন পূর্ব রেলের সদর দপ্তর এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ চেয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দেয়।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়