নারী কেলেঙ্কারী, চুরি সবই চলে মার্শালিং ইয়ার্ডে
আসিফ পিনন
শুধু মাত্র ইয়ার্ড নয়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মার্শালিং ইয়ার্ড যেন আস্ত অনিয়মের আখড়া। নারী কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে কোটি টাকার রেলের মাল চুরি কিংবা দায়িত্ব বন্টন আর বদলি বাণিজ্য সবই হয় এক শাহ আলমের ছত্রছায়ায়। ইয়ার্ডে সম্প্রতি প্রায় ৬ লাখ টাকার ৩৯টি ব্যাটারি চুরি কাণ্ডের পর সামনে আসতে শুরু করেছে সক্রিয় চোর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ।
ইয়ার্ডের পুরানো কর্মচারীরা বলছেন—রেলের মাল পাচারে দুধর্ষ চোর চক্র গড়ে তুলেছেন ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী শাহ আলম। প্রায় ৭ বছর ধরে ইয়ার্ডে কেউ এ সিন্ডিকেটের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তার কপালে জুটেছে হয়রানি, বেধড়ক মারধর আর বদলি। তবে এ দীর্ঘ সময়ে বহু অভিযোগ থাকার পরও শাহ আলম ইয়ার্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন স্বদর্পে। প্রায় ৭ বছরে বদলি কিংবা শাস্তি কিছুই হয়নি তার।
যদিও এ সিন্ডিকেটের ‘ভয়ে’ সরাসরি গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি নন অনেকেই। অন্যদিকে ব্যাটারি চুরিতে ৪ চোরকে হাতে নাতে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে চেয়েও পায়নি রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। এখন এ চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরএনবির দেওয়া এজাহার ও রেলওয়ের তদন্ত নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।
সিভয়েসের হাতে আসা মামলার এজহারে দেখা গেছে, সেদিন ধরা পড়া ৪ ব্যাটারি চোরের মধ্যে খালাসি জাবেদ হোসেনকে দেখানো হয়েছে মামলার এক নম্বর আসামি। দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে মেকানিক্যাল ফিটার আনোয়ার হোসেনকে। অথচ অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ বছর ধরে শাহ আলম সিন্ডিকেটের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ডের’ দায়িত্ব পালন করে আসছেন আনোয়ার।
সূত্র বলছে, বেশ কয়েক বছর ধরেই বাজারের ব্যাগ, বাইকের সিটের নীচে কৌশলে ইয়ার্ডের মালামাল পাচার করতো আনোয়ার। শাহ আলমের নেতৃত্বে ইয়ার্ডে ভ্যান গাড়ি ঢুকিয়ে রেলের কোটি টাকার মালামাল পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রেল অঙ্গনে আলোচিত এ মামলার অন্য দু'জন আসামি হলেন, পিকআপ ভ্যান চালক মো. মামুন ও রিকশাভ্যান চালক মো. পারভেজ। গত ১০ জুলাই গভীর রাতে এ দুটি গাড়ি ব্যবহার করে রেলের ৩৯ পিস ব্যাটারি পাচার হচ্ছিল বলে ভাষ্য আরএনবির।
অথচ রেলওয়ে সূত্র জানায়, এর আগে চলতি বছরের ২৩ জুন চট্টগ্রামের মার্শালিং ইয়ার্ড থেকে পূর্বাঞ্চল রেলের লাকসামে বদলি করা হয় মেকানিক্যাল ফিটার আনোয়ারকে। ঘটনার দিন অর্থাৎ ১০ জুলাই চট্টগ্রামে ফিরে গভীর রাতে ট্রেনের পাওয়ারকারের মূল্যবান ব্যাটারি চুরির ফন্দি আটেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইয়ার্ডের একজন কর্মচারী সিভয়েসকে বলেন, ‘ইয়ার্ডের স্টোর থেকে শুরু করে অফিসের চাবি সবই থাকতো আনোয়ারের কাছে। শাহ আলম স্যারের খুব বিশ্বস্ত লোক তিনি। এখন শুনছি সেদিন তালা ভেঙ্গে চুরি হয়েছে। কিন্তু এখানে চুরির ঘটনা নতুন নয়। এখন পুরো সিন্ডিকেট বাঁচাতে টাকার ছড়াছড়ি চলছে।’
রেলের মাল চুরিতে দুর্ধর্ষ চক্র
ইয়ার্ডের কর্মরতরা বলছেন, ইয়ার্ড থেকে রেলের মালামাল চুরির জন্য অন্তত ২০ জনের একটি দুর্ধর্ষ চোর চক্র রয়েছে। এ চক্রে রয়েছে ইয়ার্ডের ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, খালাসিসহ অন্তত ১৭ জন। এর বাইরে চোরাই মালামাল পরিবহনে এ চক্রে রাখা জড়িত কয়েকজন ভ্যানগাড়ি বা পিকআপ চালক।
নিজেকে মেকানিক্যাল ফিটার আনোয়ারের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে আয়েশা বেগম নামে একজন সিভয়েসকে বলেন, ‘ওই ইয়ার্ডে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমাদের একটা দোকান ছিল। টিএল, খালাসি এদের দিয়ে চুরি করাতো। তাদের পরিচিত ভ্যানগাড়ি পিকআপও ছিল। যে তিন বছর আনোয়ারের সাথে সম্পর্ক ছিল। তখন দেখেছি। আমাকে বিয়ে ও ভরণ পোষণের আশ্বাসে বিভিন্ন এলাকার ভাড়া ঘরে রেখেছিল। তখন বাসা বদলানোর সময় পিকআপগুলো আসতো।’
সিভয়েসের হাতে আসা এ চক্রের ১৭ জন হোতার নাম হলো, মেকানিক্যাল ফিটার আনোয়ার হোসেন, এসএই আশিষ কুমার রক্ষিত, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মো মানিক, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ওবায়দুল হক, এলই নুর ইসলাম, এফএএসবিএ জালাল উদ্দিন, এলই মানছুর মিয়া, ইলেকট্রিক ফিটার মো. মিলন, এলই জাহিদুল হক , ইলেকট্রিক ফিটার আব্দুর রহিম, খালাসি সালাউদ্দিন সালু , নুর আলম , নুর হোসেন শিবলু , রবিউল হাসান, টিএলআর খালাসি তাজুল ইসলাম, পাপ্পু ও জয়দেব।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এ মামলার সাক্ষী বানানো হয়েছে সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত এলই জাহিদুল হক ও খালাসি সালাউদ্দিন সালুকে। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরএনবির এসআই জসিম উদ্দিনের সাথে শাহ আলমের বিশেষ সখ্যতার কারণেই রেলের আলোচিত মামলাটির এ হাল— এমনটাই দাবি ভুক্তভোগীদের।
রেলে চাকরি দেওয়ার নামে নারী নির্যাতন
শুধুমাত্র চুরিতেই পারদর্শী নয় প্রকৌশলী শাহ আলমের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ খ্যাত মেকানিক্যাল ফিটার আনোয়ার। ইয়ার্ডের ভেতরে থাকা এক দোকানদারের স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ের আশ্বাসে নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের মে মাসে এ নিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেছেন ভুক্তভোগী সেই নারী আয়েশা বেগম। সিভয়েসকে তিনি বলেন, ‘আনোয়ার আমার আগের ঘরের ছেলেকে রেলওয়েতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।’
সিভয়েসের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ইয়ার্ডের ভেতরে আমার আগের হাসবেন্ডের ক্যান্টিন ছিল সেই সূত্রে তার সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি পড়ালেখা জানি না। সাদা কাগজে সে আমার কাছ থেকে টিপসই নেয়। পরে বিভিন্নভাবে সে আমাদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে আনোয়ারের সাথে আমি চলে আসি। তারপর কিছুদিন চট্টগ্রামের হালিশহরসহ বিভিন্ন ভাড়া বাসায় আমাকে রেখেছে। পরে একপর্যায়ে আমাকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়। তখন থেকেই আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।’
বদলি, দায়িত্ব বন্টনে বাণিজ্য
অভিযোগ রয়েছে, আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনের পাওয়ার কারে যাত্রীবহন করতে বাধ্য করেন শাহ আলম সিন্ডিকেট। এ জন্য শাহ আলমকে ট্রেন প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার টাকা দিতে হয়।
রেলওয়ে পাহাড়তলী কারখানার ইলেকট্রিক খালাসি ফরহাদ রনি সিভয়েসকে বলেন, ‘প্রায় দেড় বছর আগে লাইনে (পাওয়ার কারে) পাঠানোর জন্য শাহ আলম আমার কাছে ১ হাজার টাকা দাবি করে। আমি ৫০০ টাকা দিতে চেয়েছিলাম। পরে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছে। পরে আমাকে লাইন থেকে নামিয়ে দিয়ে বদলির পর পাহাড়তলীর বিদুৎ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। শুধু আমি একা নয়, বিভিন্ন কারণে অনেকে হয়রানির শিকার হয়েছে।'
পূর্ব রেলে এলই পদে কর্মরত জাকির আহমেদ সিভয়েসকে বলেন, ‘২০১৫ সালের দিকে মার্শালিং ইয়ার্ডে পাওয়ার কারের ইঞ্জিনের নজেল ও ফিল্টার চুরি করেছিল আনোয়ার। বিষয়টি আমার নজরে আসলে সেটি আমি প্রকৌশলী শাহ আলমকে বলেছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এভাবে বিভিন্ন সময় অনিয়মের প্রতিবাদ করার কারণে আমাকে লাকসামে বদলি করা হয়েছে।’
লকডাউনে আটকা দুই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট
রেলের ৩৯টি পাওয়ার কারের ব্যাটারি চুরিতে কারা জড়িতদের খুঁজে বের করতে তদন্ত করছে আরএনবি। পাশাপাশি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এতে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রকৌশলী শাকের আহমেদকে। কিন্তু চলমান লকডাউনের কারণে তদন্ত খুব বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
সিভয়েসকে তিনি বলেন, ‘লকডাউনে অফিস বন্ধ। তবু আমরা তদন্ত করছি। অফিস বন্ধ থাকার কারণে সাক্ষ্য গ্রহণে দেরি হচ্ছে।’
ব্যাটারি চুরিতে প্রকৌশলী শাহ আলমের সম্পৃক্ততা আছে কিনা জানতে চাইলে সিভয়েসেকে তিনি বলেন, ‘এখানে উনার সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এত বড় চুরির ঘটনা মার্শালিং ইয়ার্ডে আগে ঘটেনি। স্টোরে মালামাল আছে এটা জেনেই তো সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল তারা। তাই ভেতরের কেউ জড়িত কিনা আমরা তদন্ত করে দেখছি।’
অন্যদিকে সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত জাহিদুল হক (এলই) ও খালাসি সালাউদ্দিন সালুকে কেন আরএনবির এজহারে সাক্ষী রাখা হয়েছে জানতে চাইলে আরএনবি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমাড্যান্ট শফিকুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, ‘এখানে ঘটনার সময় উপস্থিত যারা ছিলেন তাদের সাক্ষী করা হয়েছে। মামলার প্রয়োজনে সাক্ষী পরিবর্তন করা যেতে পারে।’
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই জসিম উদ্দিনের সাথে ওই সিন্ডিকেটের সখ্যতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মামলার তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে এসব তথ্য যাচাই করে দেখব। নিরপেক্ষ তদন্তের নিশ্চিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
অভিযুক্তদের বক্তব্য
মামলার ১ নম্বর সাক্ষী জাহেদুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন শুনে ব্যস্ততার অজুহাতে কল কেটে দেন তিনি। ২ নম্বর সাক্ষী সালাউদ্দিন বলেন, ‘ওখানে আমি ডিউটি করিনা। আমি ট্রেনে ডিউটি করি। এ ঘটনার পর অফিসার আমাকে ডাকা পাঠিয়েছে, আমি গিয়েছি। আপনার অফিসার যদি আপনাকে ডাকায়, আপনি রাতে না গিয়ে পারবেন?’
শাহ আলম সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি আমি ট্রেনে ডিউটি করি। সিন্ডিকেটে থাকলে তো আমি বসে বসে বেতন নিতাম।’
পরে একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু মালগুলো বের করতে দেখেছি। আমি চুরি করতে দেখেছি এটা তো কোথাও লেখা নাই। আমি কিসের সাক্ষী সেটা জানেন? আপনি এটা থানাতে জিজ্ঞেস করে দেখেন।’
সাক্ষীদের এমন অসংলগ্ন কথা বার্তার প্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, ‘সাক্ষীরা এ ঘটনা দেখেছে। তাই তাদের সাক্ষী করা হয়েছে।’
তবে এসব ঘটনার মূল অভিযুক্ত প্রকৌশলী শাহআলমকে একাধিকবার ফোন করা হলে কল রিসিভ করেন নি তিনি। তার বক্তব্য জানতে চেয়ে একটি ম্যাসেজ পাঠানো হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।