Cvoice24.com

রেলের মাল চুরিতে ‘একচোখা ফজলু’ সিন্ডিকেটের রাম রাজত্ব,মাথার ওপর ছায়া খোদ আরএনবি

ইয়াসির রাফা

প্রকাশিত: ২১:০৮, ৩০ আগস্ট ২০২১
রেলের মাল চুরিতে ‘একচোখা ফজলু’ সিন্ডিকেটের রাম রাজত্ব,মাথার ওপর ছায়া খোদ আরএনবি

ছবি: সিভয়েস

রেল যেন পরিণত হয়েছে চোর চক্রের বাপ দাদার সম্পত্তিতে! আর এসব চুরিতে সহযোগিতার অভিযোগের তীর খোদ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর (আরএনবি) ওপরেই। চট্টগ্রামের রেলওয়েতে কিছুদিন পর পর চুরির ঘটনা ঘটেই চলছে। এসব ঘটনায় মূল অপরাধীকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে রেলের মাল পাচারের ঘটনায় মুখে কুলুপ এটে থাকে কর্তৃপক্ষ। যার ফলে রেলে দুর্নীতির ‘কালো বিড়াল’ শুধু বহাল তবিয়তেই নয়, তা আরও মোটাতাজা হয়েই চলেছে।

রেলের কর্মচারী ও নিরাপত্তা কর্মীদের যোগসাজসে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটলেও দায়সারা তদন্তে অধরাই থেকে যায় চোরচক্র। অধীনস্থ কর্মচারীরা একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় প্রশ্ন উঠেছে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন নিয়েও।

সর্বশেষ গত শনিবার (২৮ আগস্ট) পাহাড়তলীতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ওয়ার্কশপের মালামাল চুরির ঘটনা ঘটেছে। সে বিষয়ে ‘অরক্ষিত রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ভোরে দুর্ধর্ষ চুরি’ শিরোনামে সিভয়সে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী অনুসন্ধানে সিভয়সের কাছে উঠে আসে চোর সিন্ডিকেটের চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রেলওয়ের মালামাল চুরি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিকল্পতিভাবে ঘটে এসব চুরি। জনৈক ফজলু ওরফে একচোখা ফজলু সিন্ডিকেটের দিক-নির্দেশনায় ঘটে এসব চুরি। তার অন্যতম আরেক সহকারীর নাম বশির। রেলওয়ে নিরপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করেই এসব চুরি কার্যক্রম চালায় তার এই সিন্ডিকেট। আর ফজলুর এসব কাজে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে এলাকার কথিত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। সুযোগ পেলেই সেসব নেতার নাম ভাঙিয়ে কাজ হাসিল করতে দেরি করে না ফজলু।

ওইদিনের (২৮ আগস্ট) চুরির ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা হয় সিভয়স প্রতিবেদকের। সে সময় প্রত্যক্ষ্যদর্শী ও ফজলুর একটি কথোপকথনের একটি রেকর্ড সিভয়সের হাতে আসে। সে অডিও রেকর্ডে ফজলুকে বলতে শোনা যায়— ‘এখানে আমার কন্ট্রাক্ট আছে। আমাদের সাথে মিস্ত্রির লাইন আছে। দিনের স্টাফ যারা মিস্ত্রি এরা কাজ করে। তারা আমাদের জন্য মাল রাখে সেকশনে। নিরাপত্তা বাহিনী যারা আছে তাদের সাথে আমার চুক্তি আছে। আমি যাই নিয়ে আসি, এগুলা আমি একপাশে রাখি। মালের ভাগ হয় তিনটা। আমার এক ভাগ, মিস্ত্রির এক ভাগ, নিরাপত্তা বাহিনীর এক ভাগ। আমরা এই হিসাবেই কাজ করি। কারণ ভাই, হাজার হাজার মাল পড়ে আছে। মাল ধরা যায় না, যেটা মিস্ত্রি দিবে সেটাই। একটা নাট বল্টুরও হিসাব আছে— রেজিস্টারি করা আছে, বালাম বই আছে।’

‘... ও ভাই, আমি দেখি তো অবাক। আমার কইলজা, আমার হার্টবিট তো মনে করেন— আমি ওইখানেই স্ট্রোক করার মতো অবস্থা। ভাই আপনি সারাদিন পরিশ্রম কইরছেন। পরিশ্রম করে আপনার মালগুলা রাখছেন, নেয়ার টাইমে যদি মালগুলা দেখেন যে নাই, হাওয়া হই গেছে। আরে ভাই, আমনের বেতনের গোষ্ঠী কিলাই। আরও দুই জনের পয়সা কেমনে দিবেন? মিস্ত্রির পয়সা কেমনে দিবেন? বাহিনীর পয়সা কেমনে দিবেন?— বাহিনীর পয়সা যদি আমি না দেই আরেকদিন ঢুকতে পারমু? আমারে এদ্ধুরুত ধইরা চালান কইরা দিবে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা যখন বললো, ‘ঠিক আছে তো।’, তখনই ফজলু আবার বলে উঠলো— ‘আর আমি এইযে এলাকার পোলাপানের খরচগুলা কেমনে দিমু। আমার তো রাস্তায় চলতে হয় নাকি। তাইলে আমার ডাইনে বামে কম বেশি দিতে হয় না? যে যেটা করে ভাই ওইটাই বুঝে।’ 

ফজলুর এমন কথায় প্রত্যক্ষদর্শী বললো, ‘এগুলা প্রতিনিধি তাইলে আপনার?’ উত্তরে ফজলু ফের বলে উঠলো, ‘আমি আপনেরে বলি— আপনে আমারে বইলবেন যে, ফজলু কে? এইটা সেগুনবাগান ৯ নম্বরে বাসা আমার। ডিপের পরের কলোনি। লিটনরে চিনেন? ওই ডিপের এখানে চা খান নাই? আলী, লিটনের নাম শুনছেন? লিটন আমার ছোটো ভাই। আরে আমি ফোন দিলে এখন চলি আইসবো।’

ফজলুর এমন কথায় প্রত্যক্ষদর্শীর একজন প্রশ্ন করলো— ‘এগুলা সম্বন্ধে সবকিছু আলী ভাই জানে?’, এমন প্রশ্নের উত্তরে ফজলু বলে, ‘সব জানে, সব জানে। আপনি দিনের বেলা যায় ওর সাথে বইসা আলাপ পাইরেন। আমার ব্যাপারে বইলেন যে— ভাই কালকে রাতে অমুক গেছিলেন। তখন আপনাকে কি বলে দেইখেন। আপনে বইলেন যে ফজলু আপনের কথা বইল্লো যে, আপনে ছোটো ভাই। মানে জুনিয়র। রক্তের ছোটো ভাই না আবার।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই এসব চোর সিন্ডিকেটের নিতৃত্ব দিয়ে আসছে ‘একচোখা ফজলু’। গত শনিবারের (২৮ আগস্ট) চুরির ঘটনায়ও ফজলু, জসিম, বশির জড়িত ছিলেন। বিছিন্নভাবে নয় বরং পরিকল্পিতভাবে মালামাল চুরি করে তারা। চুরির জন্য বেছে নেয় বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার রাতের শেষ ভাগ বা ভোররাত। দেয়াল টপকিয়ে মালামাল পাচার করে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে অরক্ষিত থাকায় এসব দেয়াল হয়ে ওঠেছে চোর চক্রের নিরাপদ যাতায়াত পথ। 

রাব্বি (ছদ্মনাম) নামের এক যুবক কাজ করতো ফজলু সিন্ডেকেটের সাথে। সে জানায়, ফজলুর সাথে মালামাল চুরি করতো সে। চুরির সময় তারা ৩ জন থাকতেন। এ কাজের সাথে এরশাদ, আলী নামের অনেকেই জড়িত রয়েছে বলেও জানায় রাব্বি।

যদিও এ সিন্ডিকেটের ‘ভয়ে’ সরাসরি গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি নন অনেকেই। নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক চুরির ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী সিভয়েসকে বলেন, ‘যেদিন চুরি হয়েছে, তার ভিডিও আছে। চুরি হচ্ছে তা দেখা যাচ্ছে (ভিডিও সিভয়েসে কাছে সংরক্ষিত আছে)। কিন্তু যেহেতু আমার দায়িত্বগত এলাকায় তারা মালামাল এনে রাখছিলো আর আমি তা দেখে ফেলছি, তাই আমি মাল আটক করে আমার ইনচার্জকে ফোন দিয়ে জানিয়েছি। তারা (চোর চক্র) নানাভাবে আমাদেরকে নানা কথা বুঝিয়েছে। কিন্তু আমি ইনচার্জকে জানিয়ে দিয়েছি সব।’

‘এরপর সেদিন সকালে দুই আরএনবি সদস্য আসেন আমাদের কাছে। আরএনবি এক সদস্য আমাকে বললেন— ‘তোমাদের কেউ জিজ্ঞাস করলে বলবে মালমালগুলো এখানে পরেছিল, তাই উঠিয়ে রাখছো— এটা বলবে।’ তাদের মাঝে আরেকজন (আরএনবি সদস্য) আমাদেরকেই চোর বলা শুরু করছে। বললেন, এরা মাল যেহেতু আটকিয়েছে নিশ্চই এরাও মিক্সার (চোরের সাথে যোগসাজস) করা আছে। অথচ, চুরির মালামাল আরএনবি সদস্যদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার পর যেখানে ধন্যবাদ দেয়ার কথা সেখানে উল্টো আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে।’ এসময় উপস্থিত থাকা আরএনবির ওই দুই সদস্যের নাম ইউসুফ ও জহির বলে জানা গেছে। 

চোরের ওপর বাটপারি

অনুসন্ধানে উঠে আসে রেলের এসব মালামালের চুরির ‘একচোখা ফজলু’ সিন্ডিকেটে নিজেদের মাঝেই ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে প্রায়শই ঝামেলা হয়। তখন দল থেকে বের করে দেয়া হয় অনেককেই। কিন্তু চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। দল থেকে বের হলেও চুরির ব্যাপারে সবকিছুই জানা থাকে তাদের। এদিকে সময় সংকুলান না হলে ও মালামাল বেশি হলে ফজলুর সিন্ডিকেট মালামাল অনেক সময় দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বা নির্দিষ্ট কিছু স্থানে অস্থায়ীভাবে রক্ষিত রাখে পরদিন পাচারের জন্য। কিন্তু খবর পেয়ে তার আগেই সেসব মালামাল চোরদের থেকেই চুরি করে নিয়ে যায় দল থেকে বের করে দেওয়া অন্য চোর চক্র। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার তাদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা যায়।  

কাদের প্রশ্রয়ে চলে এসব ? 

সিভয়েসের অনুসন্ধানে উঠে আসে, এলাকার কথিত কিছু নেতার প্রশ্রয়ে এসব সিন্ডেকেট দাপটের সাথে তাদের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে আলী ও লিটনের নাম অন্যতম। আলী নিজেকে যুবলীগ নেতা হিসাবে পরিচয় দেয়। অন্যদিকে লিটন আলীর ডানহাত হিসাবে পরিচিত। জুয়ার বোর্ড পরিচালনা, রেলের জায়গা দখল করে ঘর ও গ্যারেজ নির্মাণ, অবৈধ বিদ্যুতের লাইন নেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে আলীর বিরুদ্ধে। 

আলীর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এস কে খোদা তোতনের অনুসারী হিসাবে। পরে ২০১২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সেচ্ছাসেবক দলের সহ-সম্পাদক ওয়াকিল হোসেন ওরফে বগা ভাইয়ের সাথে তাকে দেখা যেত। এরপর ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত জামাল নামক কথিত এক যুবলীগ কর্মীর মাধ্যমে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হীরনের সাথে সম্পৃক্ততা দেখা যায় আলীর। বর্তমানে আলী নিজেকে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিনের অনুসারী ও নিজেকে যুবলীগ নেতা হিসাবে দাবি করে। আলীর বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চলায় তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে পরে বক্তব্য নেওয়া হবে বলে এখন তার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। 

অভিযুক্তদের বক্তব্য

ওইদিনের (শনিবার) চুরির ঘটনা স্বীকার করে ফজলুর সিন্ডিকেটের সদস্য বশির বলেন, ‘আমি আসলে কি বলবো। আমি তো বদল খাটি। আমাকে তো নিছে ফজলু ভাই। আমি ভ্যান গাড়ি চালাই। তবে আমি ফ্যাক্টিকালি ভ্যান চালাই না, ওয়াল্ডিং মিস্ত্রি।’ 

রেলওয়ে নিরপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্য ইউসুফ বলেন, ‘মামলার ব্যাপারে তো আমি কিছু জানি না। এটি আপনি আমার স্যারকে ফোন দেন। আমি এসব বিষয়ে কারও সাথে কথা বলি না।’

এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে রেলওয়ে নিরপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) এএসআই নাফিজ ইমতিয়াজ, ওই জোনের রেলওয়ে নিরপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) চীফ ইন্সপেক্টর মো. একরামুল শিকদার, চীফ কমান্ডেন্ট মো. জহিরুল ইসলাম, কমান্ডেন্ট মো. শফিক মৃধার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের একজনও ফোন রিসিভ করেননি।  

এরই মধ্যে ০১৮১৪***৬৮৩ নম্বর থেকে একজন প্রতিবেদকের মোবাইলে কল আসে। জিজ্ঞাসা করলে ওদিক থেকে তিনি এই নম্বর থেকে ফোন এসেছিল বলে পরিচয় জানতে চান। এদিক থেকে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার সাথে সাথে তিনি কল কেটে দেন।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়