Cvoice24.com

১০ বছরেও হালনাগাদ হয়নি চট্টগ্রাম নগরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা, দায় চাপাচ্ছে চসিক-সিডিএ

শারমিন রিমা

প্রকাশিত: ১১:১০, ২৭ নভেম্বর ২০২১
১০ বছরেও হালনাগাদ হয়নি চট্টগ্রাম নগরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা, দায় চাপাচ্ছে চসিক-সিডিএ

চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে হেলেপড়া পাঁচতলা ভবন। ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম নগরে কতটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে—তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে। শুধু তাই নয় নগরে কতটি অনুমোদিত আর আর কতটি অননুমোদিত ভবন কিংবা স্থাপনা তৈরি হয়েছে তারও তালিকা নেই তাদের কাছে। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে তা অপসরাণের ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে সংস্থাটির। ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ৫ বছরব্যাপী চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় করা একটি তালিকা দিয়েই দিন কাটছে তাদের।

অন্যদিকে ২০১১ সালে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা থেকে মাত্র ৩টি ভবন অপসারণ করে দায় সেরেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল নগরের ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের গোয়াল পাড়ায় হেলে পড়া পাঁচ তলা ভবন পরিদর্শনে গিয়ে চসিক থেকে সেই ভবন অপসারণের কথা বলা হয়। কিন্তু সাত মাস পার হলেও এখনও সেই কাজে হাত লাগাতে পারেনি চসিক।

চট্টগ্রাম নগরে কতটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে এমন প্রশ্নে সংস্থা দুটি দোষ চাপাচ্ছে একে অন্যের ঘাঁড়ে। সিডিএ বলছে, বারবার তালিকা দেওয়ার পরও ভবন অপসারণে কোন উদ্যোগ নেই চসিকের। চসিকের দাবি, তিন থেকে চার বছর আগে শুধুমাত্র একটি তালিকা পাঠিয়েছিল। নতুন করে কোন তালিকা সিডিএ পাঠায় নি। হালনাগাদ তালিকা না থাকা, পর্যাপ্ত জনবল ও অর্থের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণে কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

চসিক-সিডিএর কাছে কোন তালিকা না থাকলেও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের  এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। 

২০০৭ সালে সিডিএর তালিকা অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে আবাসিক ভবন ৩৫টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ভবন ১২টি এবং শুধু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে ৯টি। এর মধ্যে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নগরের লালদীঘি এলাকার তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা হয়। তিনটি ভবনই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হতো। তবে কিছুদিন তোড়জোড়ের পর স্তিমিত হয়ে পড়ে সেই উদ্যোগ। এ নতুন করে তালিকা করার কাজও আর এগোয়নি দুই সেবা সংস্থার একটিরও।

সিডিএর তালিকার চেয়ে নগরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বেশি হবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সিভয়েসকে বলেন, '২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমরা যে কাজটা করেছি এরপরে আর কেউ কোনো কাজ করে নাই। কিন্তু এই যে ভূমিকম্প আসতেছে তখনও আমরা বলছিলাম মায়ানমার বর্ডার, বাংলাদেশ বর্ডার আর ইন্ডিয়া মায়ানমার বর্ডার - এ তিন জায়গাতে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হবে। মানে এইসকল জায়গা থেকে ৭.৫-৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। তাই কক্সবাজার ট্যুরিজম সিটি আর চট্টগ্রামের পুরাতন ভবনগুলো ঝুঁকিতে আছে। এগুলোর এসেজম্যান্ট করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হালনাগাদ করা এবং দ্রুত বাকি ভবনগুলো ভেঙে ফেলা দরকার। তাছাড়া নগরের প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী কি না। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ৮ দশমিক ৫ মাত্রা ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রামের অধিকাংশ ভবন কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এজন্য সরকার তাদের ম্যানুয়াল করে দিয়েছে কীভাবে এসেজম্যান্ট হবে, কীভাবে শক্তি বৃদ্ধি করবে। কিন্তু নতুন যে বিল্ডিং হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে আরও নতুন নতুন স্থাপনা হচ্ছে সেসবের যদি ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে তৈরি না করে তাহলে তো কিছুই হলোনা।'

এর সাথে যোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘সিডিএর কাজ হচ্ছে কেউ যখন ভবন তৈরির জন্য তার কাছে পারমিশনের জন্য যাবে তখন সে সঠিকভাবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মোতাবেক যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দিবে। তা যদি সঠিকভাবে না করে তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বাড়বে। এরপরে আছে পুরাতন ভবন, সেসব বর্তমানে কতটা ভূমিকম্প প্রতিরোধী তাও পর্যবেক্ষণের উপরে রাখা কিন্তু তারা হয়তো তাও করে না। যার কারণে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যদি তারা ঠিকঠাক মতন না করে তবে সম্পূর্ণ তাদেরই গাফলতি রয়েছে।'

ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সিভয়েসকে বলেন, 'না, এটা এই মূহুর্তে এগজ্যাক্ট বলতে পারবো না। এটা আমাদের অথরিটি জানে, তারা বলতে পারবে। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করি আর এটা ভাঙা বা অপসারণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আমরা লিস্ট করে তাদের লিস্টগুলো পাঠাই। বাকিসব তারা করেন। কতগুলো বিল্ডিং আছে ধরেন ৫ থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পেও কিছু হয়না। তারচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে যেসব আছে সেসব লিস্ট করে সিটি করপোরেশনকে পাঠাই আমরা। আমরা শুধু ভবনগুলো চিহ্নিত করি। বাকি কাজ বা অপসারণের দায়িত্ব বা এখতিয়ার সব তাদের। আমরা কয়েকবার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা পাঠিয়েছি। এখন এ জিনিসটা তারা যদি না করে বড় ধরনের ঝুঁকি কিন্তু থেকে যাচ্ছে। আজকে যে মাত্রার ভূমিকম্প হল সেটা ৬.১ মাত্রার। যদি ৭ মাত্রার হয় তাহলে এ সমস্ত ভবন ভেঙে যাবে। আজকে থেকে অনেক বছর আগ থেকে ভবনগুলো চিহ্নিত করে তাদের দিচ্ছি। এখন যদি তারা ব্যবস্থা না নেয় তবে এর দায়ভারও তাদের। কারণ তারা জনগণ থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স নিচ্ছে এবং এইজন্য সরকারও দায়দায়িত্ব তাদের নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারা তাদের কাজ না করলে রিস্ক থেকেই যাচ্ছে।'
সর্বশেষ কবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এটা আমি এগজ্যাক্টলী বলতে পারবো না। এটা আপনি আমাদের ডেপুটি চিফ টাউন প্ল্যানার ঈশা আনসারিকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। 

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ধরেন, নতুন কোনো ভবন যদি আমাদের অনুমতি বা প্ল্যান ছাড়া তৈরি করে তবে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবো। কিন্তু এখন আগের যেসব ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে সে-সব অপসারণ কিংবা অন্য যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তাদের। তাছাড়া হাই রাইজ বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা গুরুত্ব বেশি দেই। আসলে এইসব বিল্ডিং কতটুকু ভূমিকম্প প্রতিরোধক। যদিও আমাদের নিজস্ব ডিজাইন সেল নাই যেটা রাজউকে আছে। এখানে আমাদের লোকবল কম। আগামীতে আমাদের নিজস্ব ডিজাইন সেল থাকবে।'

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ডেপুটি চিফ টাউন প্ল্যানার ঈশা আনসারির বলেন, 'না, এ ধরনের তালিকা আমরা করিনি তবে আমি যতটুকু জানি প্রায় ৮-১০ বছর আগে চুয়েট একটা করছে। হ্যাঁ, রিসেন্ট কোনো কাজ হয়নি। আমাদেরও এই ধরনের কাজ হয়নি। '
ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কতটি রয়েছে এমন তথ্য জানা আছে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ' না আমার জানা নেই। আসলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা আমরা করিনা। চট্টগ্রামে চুয়েটই একবার করেছিল। সিডিএর পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা বিশাল কাজ আর এটা প্রজেক্টের মাধ্যমে করতে হয়। তো আমাদের যেটা মাস্টারপ্ল্যান হবে সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাটা করা হবে। এটা আমাদের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এটা নিয়ে রিসেন্ট কেউ কাজ করে নাই। আমার জানামতে, সিডিএও করে নাই বা অন্য কোনো সংস্থাও করে নাই।'

এনায়েত বাজার গোয়াল পাড়ায় ভবন হেলে পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'না  এটা আমাদের কাজের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে অপসারণের জন্য। তারাও (চসিক) কিছু সময় চেয়েছিল। তাই কাজটি এখনও হয়নি।'

সিডিএ'র দেয়া ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা এবং ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের গোয়াল পাড়ায় হেলে পড়া পাঁচ তলা ভবন অপসারণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, ' বিগত তিন চার বছর আগে একটা তালিকা পাঠিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে কোনো তালিকা তারা পাঠায় নাই। ' এছাড়াও অফিস চলাকালীন সময়ে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে ডাটা দেখে বিস্তারিত জানানো সম্ভব বলে তিনি জানান। 

এদিকে প্রায়শই ছোট-বড় ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে চট্টগ্রাম নগর। এতে বড় কোন দুর্ঘটনার খবর পাওয়া না গেলেও ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে বেশ। সর্বশেষ ২৬ নভেম্বর রাতে রিখটার স্কেল ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে চট্টগ্রাম। এই ভূমিকম্পে চান্দগাঁও, চকবাজার, হালিশহরে তিনটি ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।

সিভয়েস/এএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়