Cvoice24.com

মোহরায় ওয়াসার প্রকল্প/
হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না মোহরাবাসীর

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ৬ এপ্রিল ২০২২
হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না মোহরাবাসীর

‘...লালন মরল জল পিপাসায়, থাকতে নদী মেঘনা (হালদা)/ হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না।’— প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের এই গানের মতই হাতের কাছে নিজেদের জমিতে প্রথম প্রকল্প স্থাপন করলেও ওয়াসার পানি পায় না সিংহভাগ মোহরাবাসী। চট্টগ্রাম নগরে পানি সরবরাহের জন্য ওয়াসা প্রথম পানি শোধনাগার স্থাপন করেছিল যে মোহরায়; সেই মোহরাবাসীর পানির তৃষ্ণা কেন মিটছে না— এর উত্তর জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী বললেন, ‘মোহরা থেকে পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে নগরের পতেঙ্গা ও ডিটি রোডের রিজার্ভ স্টেশনে নেওয়া হয়। সেখান থেকেই নগরে সরবরাহ করা হয়। এজন্য বাধ্য হয়ে মোহরাবাসীকে গভীর নলকূপের পানি সরবরাহ করতে হচ্ছে।’ 

ওয়াসার বক্তব্য যে রকমই হোক। এলাকাবাসীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ নানা সময়ে মোহরায় ওয়াসার সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেও ওয়াসার মন গলাতে পারেন নি তারা। উল্টো ওয়াসা গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলনের কারণে সাধারণ টিউবওয়েলে পানি উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে অনেক টাকা খরচ করে গভীর নলকূপ বসাতে হচ্ছে পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। একেতো হালদা-কর্ণফুলী নদী পাড়ের বাসিন্দা অন্যদিকে নিজ এলাকায় ওয়াসার পানিশোধনাগার হয়েও এ যেন— হাতের কাছে ‘ভরা কলস’ থেকেও তৃষ্ণা মেটে না মোহরাবাসীর। 

১৩টি গভীর নলকূপ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সরবরাহের কার্যক্রম। সেটি সেই ১৯৭৭ সালের কথা। তবে কর্ণফুলীর নদী থেকে পানি উত্তোলন করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সরবরাহ শুরু হয় তারও ১০ বছর পর— ১৯৮৭ সালে। মোহরা পানি শোধনাগার নামের এই প্রকল্পে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ৯ কোটি লিটার পানি। ওয়াসার প্রথম এই দুটি প্রকল্পই হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের পূর্বের এলাকা মোহরাতে। কিন্তু যাদের জমির ওপর গড়ে ওঠেছে এই প্রকল্প দুটি— তারাই পান না নিয়মিত পানি। মোহরার অধিকাংশ এলাকাতে নেই ওয়াসার সংযোগ।  

বর্তমানে মোহরার বেশিরভাগ এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে গভীর নলকূপের পানি। কিন্তু সেই পানি অপরিশোধিত হওয়ায় মাটির নিচের সেই পানিতে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন। আবার ১৩টি গভীর নলকূপের মধ্যে এখন সচল আছে মাত্র ৭টি। ফলে নিয়মিত পানিও মিলছে না। একদিকে নিয়মিত পানি নেই, অন্যদিকে যা পানি পাচ্ছেন তাতেও আয়রন— মোহরাবাসীর কষ্টের যেন শেষ নেই। 

মোহরাবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন তাঁদের যেন কর্ণফুলীর পরিশোধিত পানি সরবরাহ করা হয় এবং যেসব এলাকায় সংযোগ নেই সেসব এলাকায় যেন সংযোগ দেওয়া হয়। তবে ওয়াসা জানিয়েছে, কারিগরি জটিলতা ও রিজার্ভার না থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

কেন মোহরাবাসীকে কর্ণফুলীর পরিশোধিত পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না সেটি ব্যাখ্যা করেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘মোহরার গ্রাহকেরা আমাদের অনেকদিন ধরে বলছেন তাঁদের কাছে কর্ণফুলীর পরিশোধিত পানি সরবরাহ করতাম। কিন্তু সেখানকার বাসা–বাড়িগুলোতে নেই রিজার্ভার। তাঁদের দাবি আমরা যেন পানি বাড়ির ছাদে থাকা ট্যাংক পর্যন্ত পৌঁছে দেই। কিন্তু মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পের অধীনে এত উপরে পানি তোলার সক্ষমতা নেই। বর্তমানে সেখান থেকে পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে নগরের পতেঙ্গা ও ডিটি রোডের রিজার্ভ স্টেশনে নেওয়া হয়। সেখান থেকেই নগরে সরবরাহ করা হয়। এজন্য বাধ্য হয়ে মোহরাবাসীকে গভীর নলকূপের পানি সরবরাহ করতে হচ্ছে।’

বর্তমানে মোহরাতে ওয়াসার সংযোগ আছে ৪৫০টি। এর মধ্যে একটা অংশ পরিশোধিত পানি পাচ্ছে। কাপ্তাই রাস্তার মাথা মৌলভি বাজারের  আগ পর্যন্ত মানুষেরা পাচ্ছেন পরিশোধিত পানি। কেননা এখানে যেসব ভবন আছে সেগুলোতে রিজার্ভার আছে। এরপর মৌলভীবাজার থেকে সাফা মোতালেব রোড, দেওয়ান মহসীন রোড, জানালি হাট ও এ. এল. খান সড়ক এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে গভীর নলকূপের পানি।

ওয়াসার পানি বঞ্চিত মোহরার অধিকাংশ এলাকার মানুষ। মোহরা ওয়াসার পানি শোধনাগার প্রকল্পের আধা কিলো মিটারের মধ্যে পূর্ব মোহরা এলাকার অবস্থান। সেখানে ৩৫ বছরেও ওয়াসার পানির সংযোগ স্থাপন হয়নি। একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে সেখানকার মানুষজন এখন ওয়াসার পানির আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। এনিয়ে ক্ষোভও রয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের মাঝে। 

মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্প ১ ও ২ এর চিত্র। গুগল আর্থ থেকে নেয়া।

পূর্ব মোহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি আলম দিদার বলেন, ‘আমাদের পাড়া থেকে আধা কিলো মিটার দূরত্বেই চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রথম ও দ্বিতীয় পানি শোধনাগার প্রকল্প স্থাপন করা হয়। কিন্তু ৩৫ বছরেও ওয়াসার পানির সংযোগ স্থাপন করা হয়নি। এই এলাকায় অন্তত ৫ শতাধিক পরিবারের বসবাস। আমি প্রয়াত এমপি মইন উদ্দীন খান বাদলকে দিয়েও ওয়াসার তৎকালীন চেয়ারম্যানকে ফোন করিয়েছিলাম। নিজেও চেষ্টা করেছি। আশ্বাস মিলে ঠিকই কিন্তু পানির সংযোগ মিলেনি।’

শুধুকি পূর্ব মোহরায়? পশ্চিম মোহরার অধিকাংশ এলাকাতেও ওয়াসার পানির সংযোগ স্থাপিত হয়নি। সেখানকার মানুষজন গভীর নলকূপ বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই এলাকার বাসিন্দা শাহেদুল আজম সম্রাট বলেন, ‘পশ্চিম মোহরার প্রধান সড়কে ওয়াসার লাইন থাকলেও পাড়ার ভেতর কোন সংযোগ স্থাপন করা হয়নি। ফলে আমরা গভীর নলকূপ বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছি।’

কালুরঘাট হিন্দু পাড়ায়ও ওয়াসার সংযোগ স্থাপিত হয়নি বলে জানান একটি এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা সুভাষ দাশ। তিনি বলেন, ‘মোহরা প্রজেক্ট আমাদের এলাকা থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত আর হালদা নদীর পাড়েই আমাদের পাড়া। পানি নিয়ে বসবাস হলেও আমরা ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির সেবা থেকে বঞ্চিত।’ 

ওয়াসা সূত্র জানায়, মোহরার আবাসিক সংযোগের সংখ্যা ৪৫০টি। সেখানে দৈনিক ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করা হয়। ওয়াসা মোহরায় দুই ধরনের পানি সরবরাহ করে থাকে। কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে মৌলভী বাজারের আগ পর্যন্ত সরবরাহ হয় ‘ফ্রেশ’ তথা পরিশোধিত পানি। এরপর মৌলভী বাজার থেকে মোহরার এলাকার কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয় র ওয়াটার তথা ডিপ টিউবওয়েলের পানি। কাপ্তাই রাস্তা মাথা থেকে মৌলভী বাজার আগ পর্যন্ত আছে একটি ৮ ইঞ্চি ইউপিবিসি পাইপ। অন্যদিকে জানালি হাট রোড, দেওয়ান মহসিন রোড, এ.ল. খান সড়কে ৪ ইঞ্চি সাব ডিস্টিবিউসন ইউপিবিসি পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও মৌলভি বাজার থেকে ওয়াসার পানি শোধনাগার প্রকল্প পর্যন্ত রয়েছে ৬ ইঞ্চি ইউপিবিসি পাইপ। 

ওয়াসা সূত্র আরও জানায়, প্রতি ইউনিট ১৩ টাকা ২ পয়সা হিসেব করে প্রতিমাসে মোহরা থেকে ওয়াসার রাজস্ব বিভাগে জমা হওবার কথা ৯১ হাজার টাকা। কিন্তু সিস্টেম লসের কারণে পুরো রাজস্ব পাচ্ছে না ওয়াসা। মানুষ নিয়মিত পানি না পেলেও অপচয় থেমে নেই। সরবরাহ করা পানির সবটাই গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। পথিমধ্যে অপচয় আর চুরি হয়ে যাচ্ছে অনেক পানি। ফলে সংকট আরও বেড়েছে বলে দাবি ওয়াসার কর্মকর্তাদের।  

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসার মড–৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রানা চৌধুরী সিভয়েসকে বলেন, ‘মোহরাতে ওয়াসার অবৈধ সংযোগ এর কারণে প্রতি মাসে সিস্টম লস দেখা যায়। মোহরাতে ইতিমধ্যে ডিপ টিউবওয়েলের সংযোগ অনেকটা কমে গেছে। আগামী বছরের মধ্যে মোহরাতে সব সংযোগে ‘ফ্রেশ ওয়াটার’ সরবরাহ করা হবে।‘ 

চসিকের মোহরা ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী নুরুল আমিন মামুন সিভয়েসকে বলেন, 'যেখানে ওয়াসার প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে সেখানকার মানুষই পানি পায় না। পূর্ব, মধ্যম ও দক্ষিণ মোহরা, চর রাঙ্গামাটিয়া এলাকায় পানির বেশি সংকট। আমি বহুদিন ধরে পানির দাবি জানিয়ে আসছি। কদিন আগে সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভাতে এই বিষয়টি তুলেছি। এর আগে আমার এলাকার এমপি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ ভাইকে নিয়ে ওয়াসার এমডির কাছে লিখিতভাবে দাবিও জানিয়ে এসেছি। কিন্তু কোনো কিছুই হলো না।'

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়