Cvoice24.com

চবিতে আন্দোলনের মোক্ষম অস্ত্র শাটল ট্রেন, নির্বিকার প্রশাসন

রকিব কামাল

প্রকাশিত: ১৮:৩২, ১ আগস্ট ২০২২
চবিতে আন্দোলনের মোক্ষম অস্ত্র শাটল ট্রেন, নির্বিকার প্রশাসন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক আন্দোলনে বারবার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় শাটল ট্রেনের চালক (লোকোমাস্টার), গার্ড ও তার সহকারীকে। কথায় কথায় মাঝপথে শাটল আটকে তাদের অপহরণ করে তুলে নিয়ে যায় আন্দোলনকারীরা। মারধর, ছুরিকাঘাতের ঘটনাও ঘটে। দায়িত্বরত অবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটালেও বেশিরভাগ সময়েই নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ট্রেনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে পুলিশ এমনকি ট্রেন চালকরাও। চলন্ত ট্রেন থামিয়ে অপহরণ, মারধরের মতো ঘটনা সর্বোচ্চ থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত গড়িয়েই থেমে গেছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম বাহন শাটল ট্রেন। দৈনিক দুটি শাটল ট্রেন শিডিউল অনুসরণ করে শিক্ষার্থীরা দূরের ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করেন। ফলে শাটল ট্রেন বন্ধ করে দিলে স্থবির হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম। তাই ‘ঢাল’বানিয়ে হঠাৎ অচল করে দেওয়া হয় শাটল ট্রেন। আর শাটল আটকাতে প্রথমেই টার্গেট করা হয় ট্রেন চালক, গার্ড ও তার সহকারীকে। কখনো চলন্ত ট্রেন থামিয়ে তাদের মারধর ভয়ভীতি দেখিয়ে থামিয়ে দেওয়া হয়। বা তাতে কাজ না হলে করা হয় অপহরণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের আটকিয়ে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে শাখা ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান ও প্রত্যাশিত পদ না পেয়ে নেতাকর্মীদের ছাত্র ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের(চবি) শিক্ষা কার্যক্রম। ২০১৬ সালের ২৯ জুলাই প্রতিদিনের মতো চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন ছেড়ে যায়। সকাল পৌনে আটটায় নগরের ঝাউতলা স্টেশনে আসার পর শাটল ট্রেন আটকে দেয় অবরোধকারীরা। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা চালককে তুলে নিয়ে ঘণ্টা খানেক রাখার পর ছেড়ে দেন। 

এরপর ট্রেনটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাত্রা করে। ছেড়ে আসা ট্রেনটি নগরের ফরেস্ট গেট এলাকায় আসার পর আবারও অবরোধকারীদের বাধার মুখে পড়ে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরাও পুলিশকে পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে পুলিশের এক সদস্য ও মো. ওয়াজিদুজ্জামান নামে এক ট্রেন চালক আহত হন। ছাত্রলীগের ছোড়া ইটের আঘাতে ট্রেনের কাছ ভেঙে যায়। পরে ট্রেন আর চলাচল করেনি। 

একইভাবে সদ্য ঘোষিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান না পেয়ে আন্দোলনে নামা পদবঞ্চিতরা রাত নামতেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন শাটল ট্রেনকে। সোমবার (১ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৭টায় চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় রুটের প্রথম ট্রেনটি ছেড়ে যায়। ঝাউতলা স্টেশনে আসার পর পৌনে ৭টায় বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা শাটল ট্রেন আটকে দেন। এক পর্যায়ে ট্রেনের চালক ও গার্ডকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহরণের সাড়ে ৩ ঘণ্টার পর প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে নগরের ফয়েজ লেক এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের। এসব ঘটনায় লোক দেখানো জিডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল রেলওয়ে পুলিশ। যদিও সোমবারের ঘটনায় কোন জিডি হয়নি সন্ধ্যা পর্যন্ত। 

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলাচলের জন্য ১৯৮০ সালে শাটলে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তবে ১৯৯১ সালের ৭ জুলাই প্রথম শাটল বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনের রীতি নিয়ে আসে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। ওই দিন হাটহাজারীর চৌধুরীহাট এলাকা থেকে ট্রেন চালককে তুলে দিয়ে যাওয়া হয়। শাটল ট্রেনে সবচেয়ে বেশি হামলা ও অপহরণের ঘটনা ঘটে ২০০৮ সালে। এ সময় ছয়জন ট্রেনচালক ও সহকারী অপহরণের শিকার হন। ২০০৯ সালে শাটল ট্রেনে অন্তত ২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থে শাটল ট্রেনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

আরও জানা যায়, ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টেশনে চালক ইদ্রিস মিয়া ও কামরুজ্জামান পাটোয়ারীকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর ১৭ এপ্রিল রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যৌথ সভায় বসেন। সভায় ট্রেনে মারধর ও অপহরণের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, ট্রেনে উপদেশমূলক পোস্টার সাঁটানো, ছাত্র ও রেল কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিধান এবং হরতাল-অবরোধের সময় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করাসহ নয়টি সিদ্ধান্ত হয়। তবে বাস্তবে এর প্রতিফলন এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

এদিকে বড়বড় এসব ঘটনায় কার্যত কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলছে মনে করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা। তবে এসব ঘটনায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করে একার পক্ষে এটি বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর ছাত্রলীগ নেতারাও বলছেন এমন ঘটনা তাদের কাম্য নয়।

দাবি আদায়ের মাধ্যম হিসেবে শাটল ট্রেনকে ব্যবহার হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘বৃহৎ ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের অনেক দায়বদ্ধতা ও ঝামেলা রয়েছে। কিছু কারণে অনেকের নাম আগে থাকলেও পরে চলে গেছে, আবারও কারো নাম আগে থাকেলে পরে চলে গেছে। এসব কারণে ওদের মধ্যে রাগ অভিমান কাজ করছে। তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে দাবি আদায় করতে গিয়ে শাটল ট্রেন বেছে নিয়েছে। প্রতিটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আমাদের সমর্থন রয়েছে। তবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জ্বালাও পোড়াও কোনোভাবেই কাম্য না।’

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক আব্দুল বারি সিভয়েসকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রতিবারই নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রেলওয়ে রানিং স্টাফদের অপহরণ, মারধর করা হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশ দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ঘটনার পর শুধু জিডি হয়েছে। আজ তাদের সামনেই আমাদের স্টাফদের নিয়ে যাওয়া হলো। উনারা ট্রেনে থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে তাদের ছেড়ে দিয়েছে। আন্দোলনের সময় ট্রেন চালালে বিভিন্নভাবে ক্ষতি করা হবে বলেও হুমকি দেয়।’ 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বৈঠকে সুপারিশের বিষয়ে মনোযোগ আর্কষণ করা হলে রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের এই নেতা বলেন, ‘আমাদের কেবল মিটিংয়ে বলা হয়েছে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা রেলওয়ে পুলিশ সভার পর ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা কিছুই জানানো হয়নি। ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন তারা বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অধ্যাপক এ এস এম মনিরুল হাসান সিভয়েসকে বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ করার গুরুত্ব মাধ্যম শাটল ট্রেন। দীর্ঘদিন ধরে কিছু হলেই ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রেন বন্ধ করলে সব বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার জন্য আরও কিছু রাস্তা বের করা সম্ভব হলে এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গেট বন্ধ হলে আরেকটি গেট দিয়ে আসা-যাওয়া করা যায়। এক্ষেত্রে প্রশাসনের একার পক্ষে এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

এক প্রশ্নে রেজিস্ট্রার আরও বলেন, ‘আমরা চাই না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হোক। বেশির ভাগ সময় এমনটা হয় না, মাঝে মাঝে এমনটা হয়ে আসছে। আমাদের ছাত্ররা কম বয়সী, তাদের সঙ্গে রাগ করে বা জোর করে কিছু করা যায় না। এদের কাউন্সিলিং করে বুঝিয়ে সচেতন করতে হবে। এটি কেবল আমাদের দায়িত্ব নয়, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষকরা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করে বিষয়টি তুলে ধরতে পারেন। তাহলে এটি বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। আমরা ওই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি নিজাম উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, ‘আমার দায়িত্বকালীন সময়ে এ বছরের মধ্যে দুবার শাটলের চালক গার্ডকে অপহরণ করে আন্দোলন করার ঘটনা ঘটেছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদি কোন ব্যবস্থা না নেয় বা অভিযোগ না করে আমাদের করার কিছু নেই।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়