Cvoice24.com

চট্টগ্রাম ওয়াসার পানিতে কেরোসিনের গন্ধ!

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:৪৪, ৫ নভেম্বর ২০২২
চট্টগ্রাম ওয়াসার পানিতে কেরোসিনের গন্ধ!

চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে কেরোসিন তেলের গন্ধ’ পাওয়া যাচ্ছে

চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে ময়লা-দুর্গন্ধের অভিযোগ সেই পুরনো। এবার ওয়াসার পানিতে খোদ ‘কেরোসিন তেলের গন্ধ’ পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন নগরের চান্দগাঁও ফরিদা পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা। গত তিনদিন ধরে ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত কেরোসিনের দুর্গন্ধ রয়েছে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। ওয়াসার সরবরাহকৃত কেরোসিনের দুর্গন্ধ যুক্ত এসব পানি দিয়ে গোসল-গৃহস্থালির কাজ করলেও খাবারের অযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগীরা। যে কারণে খাবার পানিতে স্বস্তি পাচ্ছেন না সেখানকার বাসিন্দারা। এতে করে চান্দগাঁও এলাকায় খাবার পানির সংকট দেখা যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা। বাসিন্দাদের অভিযোগ— ওয়াসাকে জানানোর পরও কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি কর্তৃপক্ষ। 

তার সত্যতা মেলে এক দশকের বেশি ধরে ওয়াসার শীর্ষ পদের চেয়ারে থাকা ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহর কথাতেও। তিনি বলেন, ‘কেরোসিন অনেক দামি। অহেতুক পানির মধ্যে কেরোসিন দিতে যাবো কেন আমরা? এটা হয়তো কারও বাসা বাড়িতে সমস্যা হতে পারে আমাদের লাইনে কোনো সমস্যা নেই। বলেন যে আপনার বাসার পানিতে সমস্যা।’ 

ক্ষোভ প্রকাশ করে চান্দগাঁও পূর্ব ফরিদাপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. খোরশেদ আলম চৌধুরী সিভয়েসকে বলেন, ‘গত পরশু দিন থেকে পানিতে কেরোসিনের গন্ধ পাচ্ছি। প্রথমে গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখি কেরোসিনের গন্ধ তীব্র আকারে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের আশপাশে সব বিল্ডিংয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি আমার মতো তারাও পানিতে কেরোসিনের গন্ধ পাচ্ছেন। আমরা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেননি।’

আরেক স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াহিদুল আলম ওয়াহিদ বলেন, ‘আমি কালকে দুপুরে খাবারের পরে হাত ধুতে গিয়ে দেখি পানিতে কেমন যেন গন্ধ লাগছে। পরে ভালো করে দেখলাম পানিতেই কেরোসিনের গন্ধ। প্রথমে ভেবেছিলাম আমাদের লাইনে বুঝি সমস্যা। এরপর দেখি সবারই একই অবস্থা। আমি বোতলে করে এই পানির স্যাম্পলও রেখে দিয়েছি।’

খাবার পানির সংকট উল্লেখ করে একই এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘কল খুললে কেরোসিনের দুর্গন্ধময় পানি আসছে। মাঝে মধ্যে একটু কম মাঝে মধ্যে অনেক তীব্র গন্ধ। খাওয়া বন্ধ করে দিছি এই পানি। এখন পানি ছাড়া তো চলা যাবে না। খাওয়ার পানি না হয় কিনে খেলাম বাকিসব কাজকর্ম তো কেনা পানিতে সম্ভব না। তাই গোসল বা অন্যান্য কাজ করছি। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে। কখন আবার কী অঘটন ঘটে যায়। কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করুক এটাই আমরা চাই। এভাবে কয়বেলা পানি কিনে খাওয়া যাবে বলেন?’ 

এদিকে, চলতি বছরের এপ্রিলে হঠাৎই চট্টগ্রামে বাড়তে শুরু করে ডায়রিয়া রোগী। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় আক্রান্ত অনেকের শরীরে মিলেছে কলেরার জীবাণু। চিকিৎসকদের ধারণা ছিল, চট্টগ্রাম ওয়াসার পানিতে থাকতে পারে কলেরার জীবাণু। তবে রোগের উৎপত্তির বিষয়ে নিশ্চিত হতে গবেষণা শুরু করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রফিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি থেকে ডায়রিয়া রোগ ছড়াচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামে আসে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি দল। সাত সদস্যের এ দল ২০ আগস্ট দিনভর ওয়াসাসহ বিভিন্ন খাবার পানির নমুনা সংগ্রহ করে। কিন্তু পরবর্তীতে ওয়াসার পানিতে ঠিক ‘কী’ মিলছে সে তথ্য এখনো জানা যায়নি।

যদিও চট্টগ্রাম ওয়াসা ৮শ’ কিলোমিটার সঞ্চালন পাইপ লাইনের মাধ্যমে নগরের ৮০ হাজার গ্রাহকের কাছে ‘বিশুদ্ধ পানি’ সরবরাহ করছে। এসব পানির মান যাচাইয়ে প্রতিমাসে নিজস্ব উদ্যোগে পরীক্ষাও করে থাকে সংস্থাটি। তবে কখনো তাদের করা পরীক্ষায় পানি দূষিত হয়েছে বা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে এরকম খবর প্রকাশ করেনি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। 

কিন্তু চলতি বছরের ৬ মার্চ এক রিটের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি পরীক্ষা করতে চার সদস্যের কমিটি গঠনের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। সেই আদেশের প্রেক্ষিতে ১৩ জুন থেকে ওয়াসার ২৪ পয়েন্টের নমুনা নেওয়া শুরু করে কমিটি। পরে নমুনা পানিগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের মাইক্রোবায়েলজি বিভাগ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ও পরিবেশ অধিদপ্তরে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে লাভলেইনে অবস্থিত চট্টগ্রাম ওয়াসার গভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হলে কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া যায়। কলিফর্ম মিশ্রিত পানি পানে ডায়রিয়া, আমাশয়, রক্ত আমাশয়, কলেরা, টাইফয়েড ছাড়াও ভাইরাল হেপাটাইটিস (জন্ডিস) রোগের সূচনা হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ওয়াসার সরবরাহকৃত সুপেয় পানিতে ‘কেরোসিনের গন্ধ পাওয়ার’ বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। একে একে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, মড সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীকে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরমধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহর মুঠোফোনটি সচল ছিল। কিন্তু তিনিও ফোন রিসিভ করেননি। 

পরবর্তীতে ঘণ্টাখানেক পর পুনরায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহকে পাওয়া যায়। অভিযোগের বিষয়ে জানালে শুরুতে তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘কেরোসিন অনেক দামি। অহেতুক পানির মধ্যে কেরোসিন দিতে যাবো কেন আমরা? এটা হয়তো কারও বাসা বাড়িতে সমস্যা হতে পারে আমাদের লাইনে কোনো সমস্যা নেই। বলেন— যে আপনার বাসার পানিতে সমস্যা।’

এ প্রতিবেদক নিউজের বিষয়ে জানতে চাওয়া কি কোন অপরাধ কিনা জানতে চাইলে তখন কথার সুর পাল্টান এক দশকের বেশি ধরে ওয়াসার শীর্ষ পদের চেয়ারে থাকা ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করে নাই। তাও যেহেতু গ্রাহকরা আপনাদের কাছে অভিযোগ করছেন আমরা বিষয়টি দেখবো। তবে আমাদের লাইনের পানিতে কোনো সমস্যা নেই। যারা এমন গন্ধ পাচ্ছে তাদের বলেন আমাকে এলাকার নাম ঠিকানা জানাতে। না হলে আমি আন্দাজে কোথায় গিয়ে খুঁজবো?’

আজ শনিবার (৫ নভেম্বর) সরকারি ছুটির দিন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়— তবে কি ছুটির দিন সেবা সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মুঠোফোনও ছুটিতে চলে যায়? নতুবা একসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাদের সরকারি নম্বরটি বন্ধ থাকবে কেন?

এ বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমরা ২৪ ঘণ্টা গ্রাহকদের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করি। যে কেউ আমাদের জানালে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এখানে কেন এমন সমস্যা হচ্ছে সেটা যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। আর আপনি যে দুইজনের নাম বললেন তারা দেশের বাইরে আছেন। অন্যরা কেন ফোন ধরেন নাই সে বিষয়টা নিয়ে জানতে চাওয়া হবে।’

সেবাসংস্থার এমন উদাসীন আচরণ কাম্য নয় উল্লেখ করে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন সিভয়েসকে বলেন, ‘ওয়াসার মত এমন একটি সেবা সংস্থার কাছে এ ধরনের উদাসীন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয় বা আশা করি না। বেশকিছু দিন ধরে আমরা ওই (চান্দগাঁও) এলাকায় ময়লা পানি দুর্গন্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাচ্ছিলাম। এখন যেহেতু বাসিন্দারা অভিযোগ করছে সেখানে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে তার মানে ব্যাপারটা খুবই গুরুতর। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এখনই দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দেখা যাবে আশপাশেসহ পুরো চট্টগ্রামে ছড়িয়ে যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যদি যথাসময়ে গ্রাহকদের সেবা না দেয় তাহলে তো হলো না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যদি মোবাইল বন্ধ রাখেন এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। সেবা সংস্থা মানে ২৪ ঘণ্টাই হাজির থাকতে হবে। কেননা যেকোনো সময় জরুরি অবস্থা তৈরি হতে পারে। তিনদিন ধরে একটা এলাকার পানিতে কেরোসিনের গন্ধ অথচ কর্তৃপক্ষ পাত্তা দিচ্ছে না ব্যাপারটা দুঃখজনক।'

সিভয়েস/ এসআর

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়