প্রকৌশলী কামালের বিদ্যুৎফাঁদ!

রবিউল রবি

প্রকাশিত: ২১:৪১, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রকৌশলী কামালের বিদ্যুৎফাঁদ!

নাম তাঁর কামাল উদ্দিন আহমেদ। কর্মরত আছেন রাঙামাটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে। গ্রাহককে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়ের ঘটনা যেন তাঁর কাছে ‘দুধভাত’। ‘অপকর্মের’ পরিধি বাড়াতে বিএনপির অঙ্গসংগঠন শ্রমিক দলের সাবেক এক নেতাকে তদবির করে এনেছেন তার সার্কেলে। কখনো ভবনের পাশ ঘেঁষা বৈদ্যুতিক তার সরানোর কথা বলে, কখনোবা দুর্ঘটনার ‘ভয়’ দেখিয়ে কাভার লাগানোর কথা বলে হাতিয়ে নেন টাকা। শুধু তাই নয়, গোপনে তারের ওপরের কাভার খোলার নির্দেশ মানতে গিয়ে প্রাণ হারান এক সাহায্যকারীও। 

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রাঙামাটি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এমন নানা অভিযোগের পাহাড় জমেছে তার বিরুদ্ধে।  তিনি এখন ছুটিতে রয়েছেন। অবস্থান করছেন বিদেশে।

এলাকাবাসীর পক্ষে এসব অভিযোগ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। দুদকে দেওয়া তার অভিযোগের কপি রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে, তবে নিরাপত্তার খাতিরে ওই ব্যক্তির নাম পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে প্রতিবেদনে। অভিযোগটির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যন্ত। তবে তাদের কাছে এখনো অভিযোগের অনুলিপি পৌঁছেনি বলে জানা গেছে।

তদবির করে পছন্দের লোক এনেছেন সার্কেলে

দুদকে জমা পড়া ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন আহমেদ রাঙামাটি যোগদানের পর থেকে তার সীমাহীন দুর্নীতির কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তিনি রাঙামাটিতে যোগদান করেই তার ‘একান্ত’ সাবেক শ্রমিক দলের নেতা মো. এজাজ উদ্দিন চৌধুরীকে (উচ্চমান হিসাব সহকারী) রাঙামাটিতে তদবির করে নিয়ে এসেছেন। দুজন মিলে নানা ধরনের অবৈধ কাজের বিনিময়ে লোকজনকে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করে। 

ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়

প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন বৈদ্যুতিক লাইনের পাশে কোন বিল্ডিং দেখলেই ওই ভবন মালিককে টার্গেট করে। প্রথমে তিনি তার আস্থাভাজন এসবিএ এরশাদুল হকের মাধ্যমে বিল্ডিংয়ের পাশের লাইনে তার থাকলে বিপদ হবে—এমনটা বলে ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে প্লাস্টিকের পাইপের মধ্যে তার নেন। কিছুদিন পর কামাল উদ্দিন তার লোক দিয়ে সেই পাইপ খুলে ভয়ভীতি দেখিয়ে লাইন সরানোর ব্যবস্থা করে পুনরায় টাকা আদায় করেন। 

সম্প্রতি পিডিবি রেস্ট হাউজের পাশে আব্দুল বারিক নামে এক ব্যক্তি ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তাকে ভুল বুঝিয়ে টাকা নিয়ে রাতের আঁধারে বিল্ডিংয়ের পার্শ্ববর্তী তার প্লাস্টিকের পাইপে ভরেন প্রকৌশলী কামালের ‘আস্থাভাজন লোক’ এসবিএ এরশাদুল হক। পরবর্তীতে কামাল উদ্দিন অফিসের লোক দিয়ে পাইপগুলো খুলে ফেলে এবং গ্রাহককে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে ভয় দেখায়। এরপর পরামর্শ দেন—লাইন না সরালে আপনি বিপদে পড়বেন। তখন আব্দুল বারিক ভয় পেয়ে কামাল উদ্দিনকে টাকা দিলে লাইনটি দূরে সরিয়ে নেন।

স্বার্থের বলি শ্রমিকের প্রাণ

আব্দুল বারিকের পাশেই মিথুন শাহ’র বিল্ডিং। আর ওই বিল্ডিংয়ের পাশেই একটি ট্রান্সফরমার ছিল। সেই লাইনে তারে পাইপ পরানো ছিলো। তাই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন ওই পাইপ খোলার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী কাউকে না জানিয়ে গোপনে ‘পছন্দের লাইনম্যান’ ছামিদুল ইসলামকে দায়িত্ব দেন। গত ১৫ নভেম্বর ওই তার খোলার জন্য রাতের আঁধারে লাইন বন্ধ করে হামিদুল ইসলাম। পরে লাইন বন্ধ করে পাশে জাম্পার কাটেন তিনি। 

এরপর সাহায্যকারী মো. আইয়ুব হেলালকে ট্রান্সফরমারের ওপর তুলে দিয়ে পাইপ তারে প্যাঁচানো পাইপ খোলায় ছামিদুল ইসলাম। কাজ শেষ হলে আইয়ুব হেলালকে ট্রান্সফরমারের ওপরে রেখেই জাম্পার লাগিয়ে দিয়ে লাইন চালু করেন হামিদুল ইসলাম। লাইন চালু করার সাথে সাথে বিদ্যুতের শক খেয়ে পরে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। এরপর ঘটনাস্থলেই মারা যান সাহায্যকারী আইয়ুব হেলাল। 

বিষয়টি বুঝতে পেরে আইয়ুব হেলালের কাছে না গিয়ে দ্রুত পুনরায় জাম্পার কেটে দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান ছামিদুল ইসলাম। এ ঘটনায় নিহত আইয়ুব হেলালের পা পুড়ে ফুটো হয়ে গিয়েছিল। যার ভিডিও এলাকার অনেকের কাছেই রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন তার লাশের পোস্টমর্টেম না করে দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করেন। আর এই ঘটনার সাথে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামাল উদ্দীনের সরাসরি জড়িত থাকার কারণে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। 

হাসপাতালের ভবন মালিকের থেকেও নিয়েছেন ঘুষ

এর আগেও রাজবাড়ি এলাকায় অবস্থিত লেকসাইট হাসপাতাল ভবনের বৈদ্যুতিক তার সরানোর জন্য বিল্ডিংয়ের মালিক আলাউদ্দিনের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন। 

দুর্নীতিবাজ অফিসারদের নিয়ে আসেন নিজ সার্কেলে

অভিযোগে আছে— কামাল উদ্দিন দুর্নীতিবাজ অফিসারদের বার বার বদলি করে তার সার্কেলে নিয়ে আসেন। তেমনি একজন অফিসার বর্তমানে মহালছড়ির আবাসিক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আহসান উল্লাহ। যার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ থাকার পরেও কামাল উদ্দিন সুপারিশ করে দীঘিনালার আবাসিক প্রকৌশলী হিসেবে বদলির আদেশ করেন।

কিন্তু খাগড়াছড়ির এমপির সুপারিশে তার বদলি বাতিল হয়। তার কিছুদিন পর আহসান উল্লাহ কামাল উদ্দিনকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আবারও মহালছড়ির আবাসিক প্রকৌশলী হিসেবে বদলি করে নিয়ে আসেন। এই সিন্ডিকেটের জ্বালায় অতিষ্ঠ এলাকাবাসী।  

পিডিবি কলোনীতে চোরকে দিলেন বাসা 

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন সম্প্রতি মো. সিরাজ নামের এক ব্যক্তিকে পিডিবির কলোনীতে বাসা দিয়েছেন। সিরাজ বার বার বিদ্যুৎ অফিদের বিভিন্ন মালামাল চুরি করে ধরা পড়লেও তাকে রক্ষা করেন কামাল উদ্দিন। কারণ— চুরির মালামালের ভাগ পায় এসবিএ এরশাদুল হকও। এভাবেই কামাল উদ্দিন দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থের পাহাড় গড়েছে এবং এই সকল অর্থ দিয়ে সে কোটি কোটি টাকা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেছেন।

সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাঙামাটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প ও স সার্কেল) কামাল উদ্দিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘বর্তমানে তিনি (কামাল উদ্দিন) বিদেশে অবস্থান করছেন। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে আমার সুস্পষ্টভাবে জানা নেই। আর অভিযোগের অনুলিপিও আমি পাইনি। তবে কাউকে বদলি কিংবা পদায়ন করার ক্ষমতা তার নেই।’

সাহায্যকারী ছামিদুল ইসলামের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি শতভাগ একটি মিথ্যে অভিযোগ। কাজটি প্রকৌশলীর কোনো ব্যক্তিগত কাজ ছিলো না। এটি সঠিক নয়।’

পিডিবির কলোনীতে সিরাজ নামে ওই এক ব্যক্তিকে বাসা দেওয়া এবং ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আমার নলেজে নেই। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে তবে আমার যাচাই করে দেখতে হবে। ওনার (কামাল উদ্দিন) বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগ আছে সে সম্পর্কে ঢালাওভাবে যাচাই না করে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়