Cvoice24.com


চট্টগ্রামে দিনে আগুনে পুড়ছে দুই স্পট

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০
চট্টগ্রামে দিনে আগুনে পুড়ছে দুই স্পট

প্রতীকী ছবি

কনকনে শীতের রাত। ওয়্যারলেস এলাকার বাসিন্দা রায়হানের বাড়ির সদস্যরা ব্যস্ত যে যার মত। হঠাৎ অন্ধকার চিরে জেগে উঠে আগুনের লেলিহান শিখা। ছড়িয়ে পড়ে কালো ধোঁয়া। আগুন, আগুন... চিৎকারে শুরু হয় দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। চোখের পলকে পুড়ে ছাড়কার সাজানো সংসার। কোনো মতে প্রাণটুকু বাঁচিয়ে পালাতে পারলেও রান্নাঘরের চুলা থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে সর্বস্ব হারায় পরিবারটি। 

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্যানুসারে, চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে এরকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সাড়ে ছয়শর বেশি। শুধুমাত্র নভেম্বরেই ৯০-এর অধিক স্থানে আগুন লাগে। ডিসেম্বরের হিসাব এখনো পরিসংখ্যানের তালিকায় উঠানো না হলেও ঘটেছে অন্তত ৫০টির বেশি ঘটনা। 

ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা শঙ্ক প্রকাশ করে বলছেন, ডিসেম্বরের হালনাগাদ তথ্য যুক্ত হলে চলতি বছরের মোট অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আটশর ঘরে গিয়ে ঠেকবে। সেই হিসেবে চট্টগ্রামে দিনে অন্তত দুটি স্থানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে।

অভিজ্ঞতার আলোকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, শীত মৌসুম শুরু হতেই আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায় অগ্নিদুর্ঘটনা। অসাবধানতাই অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ। মূলত বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, চুলা, বিড়ি সিগারেট থেকে সৃষ্ট আগুন, ওয়েলডিং মেশিন হতে সৃষ্ট আগুন থেকে বেশি আগুন লাগে। আবার বিতর্কিত জমিতে থাকা ঘর বা বস্তির দখল নিয়েও শত্রুতাবশত কেউ লাগিয়ে দিচ্ছে আগুন।

ফায়ারের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে সংঘটিত ৫১২ অগ্নিকাণ্ডের ২৩২টির কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। ৭৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে চুলা থেকে, ৬২টির জন্য দায়ী জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা, মোমবাতি থেকে আগুন লাগার ঘটনা ১৭টি। এছাড়া যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা করা, রাসায়নিক প্রতিক্রিয়াসহ আরও কিছু কারণ অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী। 

একইভাবে ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে সংঘটিত হয় ৪৯৯টি অগ্নিকাণ্ড। এর মধ্যে শীতকালীন আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৬৮টি। পুরো বছরে আগুনে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ওই বছরের শুধুমাত্র জানুয়ারি থেকে এপ্রিলেই ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকার। সে বছর আটজন দগ্ধের পাশাপাশি প্রাণ হারায় দুজন।

পরের বছর ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে সংগঠিত হয় ৮৬৭টি অগ্নিকাণ্ড। এর মধ্যে শীতকালীন আগুনের ঘটনা ৩২৮টি। পুরো বছরে আগুনে ক্ষতির পরিমাণ ৪৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আর শীতকালীন ক্ষতি হয় ২১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার সম্পদ। ওই বছর একজনের প্রাণহানীর পাশাপাশি ছয়জন দগ্ধ ও আহত হয়।

এদিকে ২০১৮ সালে ঘটেছে ৫৯৯টি আগুন লাগার ঘটনা। এর মধ্যে শীতকালীন অগ্নিকাণ্ড ২৭৩টি। পুরো বছরে আগুনে ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা হলেও শীতেই পুড়েছে ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার সম্পদ। সে বছর আটজন দগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি নিহত হয় একজন।

আর গেল বছর ২০১৯ সালে ঘটেছে ৭৩৬টি অগ্নিকাণ্ড। এর মধ্যে শুধুমাত্র শীতের সময়ে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬৯টি। পুরো বছরে ক্ষতি হয় ১০ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার টাকার সম্পদ। শুধুমাত্র শীতকালীন আগুনেই ক্ষয়ক্ষতি হয় ৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকার মতো। এসব অগ্নিকাণ্ডে ১৩ জন দগ্ধ ও আহতের পাশাপাশি প্রাণ হারায় তিনজন। 

তাছাড়া ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে মারা গেলে তাদের তথ্য আর ফায়ার সার্ভিসের রেকর্ডে রাখা হয় না।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা কফিল উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, ‘শীতে আগুন লাগার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণেই ঘটছে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা। তারপরও এ বিষয়ে মানুষ উদাসীন। তাই অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই।’  

সার্বিক বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ আহমদ জানান, অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে ও সৃষ্ট ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভোলেন্টিয়ার তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি সচেতনতার কাজও চলছে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে। 

চট্টগ্রাম প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক স্থাপত্য বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ নাজমুল লতিফ বলেন, ‘চুলার আগুন থেকে কিংবা বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে বস্তিতে বেশি আগুন লাগে। সাধারণত দেখা যায়, বস্তিতে যেসব চুলা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো খোলা চুলা। যদি বন্ধু চুলার মতো পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ চুলার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অগ্নিদুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো সম্ভব। এছাড়া বিভিন্ন বস্তির মালিকেরা বৈধ-অবৈধ সংযোগ নেওয়ার সময় প্রায়ই নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেন। এসবের বিরুদ্ধে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা দরকার।’

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, দ্রুত সময়ে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছানো গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরু রাস্তার কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লাগে। অনেক সময় আগুন নেভানোর জন্য আশপাশে পানির উৎসও পাওয়া যায় না। বস্তি এলাকা তো বটেই, অনেক সময় বহুতল ভবন বা কলকারখানার আগুন নেভাতেও নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। বিল্ডিং কোড মেনে যদি বহুতল ভবনগুলো তৈরি হতো, তাহলে এ সমস্যা হতো না। মাটি থেকে ১৩৫ ফুট উঁচু পর্যন্ত ভবনে আগুন নেভানোর জন্য চট্টগ্রামে এখন দুটো গাড়ি আছে। কিন্তু সরু রাস্তার কারণে বিশাল আকারের গাড়িগুলো গলিতে ঢোকানোর মতো অবস্থা থাকে না।

-সিভয়েস/এপি

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়