Cvoice24.com

চট্টগ্রামের ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়নি চসিক

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
চট্টগ্রামের ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়নি চসিক

প্রতীকী ছবি।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গুলি চালিয়ে হত্যা করে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে মিছিলরত তরুণদের। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী তখন অসুস্থ; তাঁর শরীরে জলবসন্তের চিহ্ন। রাত জেগে তিনি লিখলেন আগুনঝরা কবিতা: ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতিবাদ সভায় সে কবিতা পড়লেন তাঁরই সতীর্থ চৌধুরী হারুণ-উর-রশীদ। পাকিস্তান সরকার সে কবিতা বাজেয়াপ্ত করে। হুলিয়া জারি করে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ওপর। তিনি এবং তাঁর কবিতা হয়ে গেল ইতিহাসের অংশ। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি— একুশের প্রথম কবিতা। 

ভাষা আন্দোলন নিয়ে এমন কালজয়ী কবিতার জনক চট্টগ্রামের হলেও তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারি কোনও উদ্যোগ নেই ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও। তেমনি মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে চট্টগ্রামে বিভিন্ন সড়ক ও স্থাপনার নামকরণ করা হলেও অন্য মহান ভাষা সৈনিকের নামে কোন সড়ক কিংবা স্মারক স্থাপনা করেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ কোনও সংস্থাই। অথচ ভাষা আন্দোলনের সময় মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে ঢাকার সাথে সাথে রাজপথে নেমেছিলেন চট্টগ্রামের বীর সন্তানরাও। এদিকে ৬৯ বছর ধরে ভাষা সৈনিকদের নামে সড়ক বা স্থাপনা করতে না পারাকে ব্যর্থতা বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পূর্ব থেকে ঢাকার মতো চট্টগ্রামও প্রতিবাদে সরব ছিল। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় যখন ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে চট্টগ্রাম নগরেও এর আঁচ এসে লাগে। ১৯৪৮ সালে তমদ্দুন মজলিসের চট্টগ্রাম শাখার নেতারা বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তমদ্দুন মজলিসের কার্যালয় ছিল নগরের মোমিন রোডে। তমদ্দুন মজলিসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সোলায়মান খান, এজাহারুল হক, সাদেক নবী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (মন্টু), চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, মাহফুজুল হক, মো. ইব্রাহীম, শাহ ওবায়দুর রহমান, মকসুদুর রহমান প্রমুখ এ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী বিরোধী দলীয় যে কোনও আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ছিলেন। তমদ্দুন মজলিসের সাথে আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সহযোগিতার হাত প্রসারের ক্ষেত্রে দ্বিধা করেননি।

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আন্দরকিল্লাস্থ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নেতা ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান। সংগ্রাম পরিষদের অন্যদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন- জহুর আহমদ চৌধুরী (আওয়ামী মুসলিম লীগ), মোজাফফর আহমদ (আওয়ামী মুসলিম লীগ), ডা. আনোয়ার হোসেন (শিল্পপতি), আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ), চৌধুরী হারুন-আর-রশিদ, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান (তমদ্দুন মজলিস নেতা), হাবিব উল্লা (তমদ্দুন মজলিস/পরে সাংবাদিক), নুরুজ্জামান, কৃষ্ণগোপাল সেনগুপ্ত (কালা চাঁদ), শামসুদ্দিন আহমদ, মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী, ইয়াহিয়াহ খালেদ (তমদ্দুন মজলিস), এমএ মান্নান (তমদ্দুন মজলিস নেতা ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা), এমদাদুল ইসলাম, আবু জাফর, ডা. সাইদুর রহমান, আমির হোসেন দোভাষ (ভাষা আন্দোলনে অর্থ সাহায্যকারী), এজাহারুল হক প্রমুখ। এছাড়া ২০০২ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত চট্টগ্রামে ভাষা সৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দিও আছেন এ তালিকায়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) সূত্র বলছে, সড়কের নামকরণ, পরির্বতন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে নামকরণ উপ-কমিটি বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাচাই করে সুপারিশকৃত সিদ্ধান্ত মেয়র বা প্রশাসকের অনুমোদনের পর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের সাধারণ সভায় উপস্থাপন করে সুপারিশক্রমে অনুমোদন করতে হয়। এরপর অনুমোদনকৃত সিদ্ধান্ত সরকারের অনুমতির জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রেরণ করতে হয়।এরপরই কোন সড়ক বা স্থাপনার নামকরণ চূড়ান্ত করে সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রাম নগরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো ঘুরে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি ও বিশিষ্টজনদের নামে নামকরণ করা হলেও চট্টগ্রামের কোন ভাষা সৈনিকের নামে কোন সড়কের নামকরণ, স্থাপনা করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সহকারী স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর সিভয়েসকে বলেছেন,‘সড়কের নামকরণ ও সংশোধনের জন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট প্রস্তাবনা কমিটি আছে। এ কমিটির প্রস্তাবনা সাধারণ সভায় পাস হলে তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। স্থানীয় সরকারের মন্ত্রণালয় এটি কার্যকর করে থাকে। তবে প্রথমে প্রস্তাবটা সিটি করপোরেশন থেকে উত্থাপন করা হয়।’

সড়কের নামকরণের প্রস্তাবনা নিয়ে সিটি করপোরেশনের আগের নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ভাষা সৈনিকের নামে কোন সড়কের নামকরণ ইতিপূর্বে প্রস্তাব হয়নি।

নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, ‘ভাষা সৈনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নামে লালদীঘির পাড়স্থ গণগ্রন্থাগারে স্মৃতি স্মারকের নামকরণ অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। সড়কের নামকরণের জন্য ভাষা শহিদের পরিবার বা সংশ্লিষ্ট পরিষদ কিংবা ফাউন্ডেশন থেকে আবেদন করতে হয়। অথবা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ চাইলেও এই আবেদন করতে পারে। এটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’ যদিও রেজাউল করিম চৌধুরীর পরিষদের এক বছর পার হলেও সেই উদ্যোগ এখনও আলোর মুখ দেখেনি। 

নগরের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, নামকরণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের। কোন সড়কের নামকরণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে উত্থাপনের কাজটিও করেন চসিক কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘নামকরণের বিষয়ে সিটি করপোরেশন কোন প্রস্তাব পেলে তা সংশ্লিষ্ট  স্ট্যাডিং কমিটি থেকে পাস হয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব যায়। এ পর্যন্ত ভাষা সৈনিকের পরিবার বা কোন সংস্থা থেকে আমরা সড়ক নামকরণের প্রস্তাব পাইনি। তবে প্রস্তাবটা যেকোন মহল থেকে আসতে পারে। এছাড়া গত ছয় মাস ধরে পরিষদ ছিল না, ফলে বিষয়টি ওইভাবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। নামকরণের জন্য পরিষদের মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হওয়ার একটা বিধান রয়েছে।’

তবে ভাষার মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে সম্প্রতি ‘ভাষারক্ষার অভিযান’করে বিবিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড থেকে ইংরেজি বানান মুছা কিংবা একুশে বই মেলার আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ভাষা সৈনিকদের স্মরণে নেই কোন উদ্যোগ। জানতে চাইলে শিক্ষা স্ট্যান্ডিং কমিটি ও বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক ও কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু সিভয়েসকে বলেন, ‘ভাষ শহীদদের নামে চট্টগ্রামে কোন সড়কের নামকরণ করা হয়েছে কি’না তা এ মুহুর্তে আমার নলেজে নেই।’

চসিক সচিব খালেদ মাহমুদ সিভয়েসকে বলেন, ‘ভাষা শহীদদের নামে নগরীর সড়কের নামকরণ পরিকল্পনা বা প্রস্তাবণা দেওয়া হয়েছে কি’না সেটা এ মুহুর্তে বলতে পারছি না। তবে খুব শিগগিরই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়কের নাম করণের প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামে একটি সড়কের নামকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’

ভাষা আন্দোলন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত হয়েছে। বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন হচ্ছে পুরো বিশ্বে। ভাষা সৈনিকদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন ও তাদেরকে পরিচিতি দেওয়া সচেতন নাগরিক সমাজের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রণব মিত্র চৌধুরী। 

তিনি সিভয়েসকে বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনের সাথে চট্টগ্রামের যারা জড়িত তাদেরকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সড়ক বা স্থাপনা নির্মাণ করা দরকার। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসতে হবে। যারা সত্যিকার ত্যাগী ও সংগ্রামী তারা কখনোই নিজ থেকে বা তাদের পরিবারের থেকে সম্মান চাইবে না। তাদের নামে নগরীর রাস্তা, চত্বর, স্থাপনাগুলো উৎসর্গ করা উচিত।’

প্রণব মিত্র চৌধুরী আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে ভাষা সৈনিকদের মধ্যে অনেকে বেঁচে নেই। এখন আমরা যদি তাদের নাম রক্ষা না করি, নতুন প্রজন্ম তাদের স্মরণ করবে না। তাই চট্টগ্রামের ভাষা সৈনিকদের নাম, ইতিহাস সংরক্ষণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।’ 

একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন সিভয়েসেকে বলেছেন, ‘এতো বছর ধরে ভাষা সৈনিকদের নামে সড়ক বা স্থাপনা করতে না পেরে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। দেখা গেছে সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের মধ্যে নানারকম অস্থিরতা ছিল। চসিকের দায়িত্বে একেক সময় একেকজন এসেছেন। তাদের এজেন্ডা ও সরকারি মনোভাবের কারণে হয়ে ওঠেনি কাজগুলো। তাই এ দায় যেমন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের, পাশাপাশি সুশীল সমাজেরও কোন অংশে কম নয়।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়