Cvoice24.com

শিক্ষার্থীর আত্মহননের এক নম্বর কারণ ‘অভিমান’

শাহরুখ সায়েল, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২ মার্চ ২০২৪
শিক্ষার্থীর আত্মহননের এক নম্বর কারণ ‘অভিমান’

চট্টগ্রাম বিভাগে ২০২৩ সালে আত্মহননের পথ বেছে নেয় ৮৯ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৫৬ জনই মেয়ে। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী সবচেয়ে বেশি; ৫৩ জন। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীও রয়েছে ৪ জন। বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে শীর্ষে চট্টগ্রাম; ৩০ জন। আর কারণ হিসেবে এক নম্বরে আছে ‘অভিমান’। প্রেম, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক কলহ, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারা, যৌন হয়রানি ও অপমানিত হওয়ার মত বিষয়গুলো আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

সম্প্রতি পরিচালিত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আচঁল ফাউন্ডেশন' এর এক জরিপে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আত্মহননের বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সমাজবিজ্ঞানীরা আগের মতো সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার ওপর গুরুত্বরোপ করেছেন। 

তাঁদের মতে, ভার্চুয়াল বন্ধুত্বকেই এখন বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য বাবা-মাকে আরো সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। আর ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা বলছেন, সঠিক ইসলামী শিক্ষার অভাবে আত্মহত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটছে। 

অন্যদিকে আত্মহত্যা ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা আচঁল। তাদের মতে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি টোল ফ্রি একটি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করা যেতে পারে।

পরিসংখ্যান 

২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৯ জন। এর মধ্যে মাদরাসার শিক্ষার্থী আছে ১৭ জন। সবার শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা গেছে, আত্মহননকারী শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৭ জন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। শতকরা হিসেবে যা ৩০.৩ শতাংশ। এরপরই মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৬ জন (২৯.২ শতাংশ)। এছাড়া প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ৪ জন (৪.৫ শতাংশ) এবং নিম্ন মাধ্যমিকের ৯ জন (১০.১ শতাংশ)। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ুয়া ১৬ জন (১৮.০ শতাংশ) এবং মাস্টার্সের ৩ জন (৩.৪ শতাংশ)। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে (বেকার) ২ জন (২.২ শতাংশ) ও মাদরাসার হেফজ বিভাগের ১ জন (১.১ শতাংশ)।

চট্টগ্রাম জেলা এগিয়ে

চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম জেলায়; যা ৩৩.৭ শতাংশ। বিভাগে ৮৯ জনের মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলাতে একবছরে ৩০ জন (৩৩.৭ শতাংশ) শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এরপরই কুমিল্লা জেলা ১৪ জন (১৫.৭ শতাংশ) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১২ জন (১৩.৫ শতাংশ)। এছাড়া কক্সবাজার জেলায় ১১ জন (১২.৪ শতাংশ), চাঁদপুর জেলায় ৯ জন (১০.১ শতাংশ), খাগড়াছড়ি জেলায় ৫ জন (৫.৬ শতাংশ), নোয়াখালী জেলায় ৪ জন (৪.৫ শতাংশ), ফেনী জেলায় ২ জন (২.২ শতাংশ) এবং লক্ষ্মীপুর জেলায় ২ জন (২.২ শতাংশ)।

মেয়ের সংখ্যা বেশি

বিভাগের ৮৯ আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ে রয়েছে ৫৬ জন; যা মোট আত্মহননকারীর ৬২.৯ শতাংশ। অন্যদিকে পুরুষ ৩৭.১ শতাংশ (৩৩ জন)। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মেয়েদের আত্মহত্যার হার বেশি। 

ঝুঁকি বেশি বয়োঃসন্ধিকালে

জরিপের তথ্য বলছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। যা মোট আত্মহত্যার শতকরা ৫৯.৫৫ শতাংশ আর সংখ্যায় ৫৩ জন। এরপর ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সের ৩০ জন; যা শতকরা ৩৩.৭ শতাংশ। আবার ১ থেকে ১২ বছর বয়সের ৫ জন এবং ২৬ থেকে ৩০ বছরের উপরে ১ জন। বয়োঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় বলেই ওই বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

পেছনের কারণগুলো

আত্মহননের পথ বেছে নেয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা জরিপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভিমান, প্রেম, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক কলহ, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারা, যৌন হয়রানি ও অপমান বোধের মত বিষয়গুলো আত্মহত্যার দিকে শিক্ষার্থীদের ধাবিত করছে। দেখা গেছে, অভিমান থেকেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। শতকরা ৩১.৫ শতাংশ (২৮ জন) শিক্ষার্থী অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। অন্য কারণের মধ্যে আবেগপ্রবণ সম্পর্কে ১৪ জন; শতকরা ১৫.৭ শতাংশ, মানসিক অস্থিরতায় ৯ জন (১০.১ শতাংশ), পরিবারিক সমস্যায় ৭ জন (৭.৯  শতাংশ), একাডেমিক চাপে ৩ জন (৩.৪ শতাংশ), পরীক্ষায় ফেল করে ৩ জন (৩.৪ শতাংশ), যৌন হয়রানির কারণে ২ জন (২.২ শতাংশ), অপমানে ২ জন (২.২ শতাংশ), পারিবারিক সহিংসতায় ২ জন (২.২ শতাংশ) এবং পাবলিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় ১ জন (১.১ শতাংশ) আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। তবে ১৮ জনের আত্মহত্যার পেছনের কারণ জানা যায়নি।

আত্মহত্যার মাধ্যম

শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে দড়িতে ঝুলে বা গলায় ফাঁস দিয়ে। যা সংখ্যায় ৭৭ জন; শতকার ৮৬.৫১ শতাংশ। আর বিষপানে আত্মহত্যা ৮.৯৮ শতাংশ (৮ জন), ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ১ জন, ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ১ জন, গায়ে আগুন দিয়ে ১ জন।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫১৩  শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷ এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৪৯ জন৷ এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনা বিভাগে ৬৪ জন ৷ বরিশাল বিভাগে ৪৩ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৩ জন৷ ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ জন এবং সিলেট বিভাগের ১২ জন।

সামাজিক বন্ধন সৃদৃঢ় করার তাগিদ সমাজবিজ্ঞানীর

সামাজিক অস্থিরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ব্যর্থতা, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি এবং যন্ত্রনির্ভরতা মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মনিরুল হাসান। সিভয়েস২৪-কে তিনি বলেন, ‘সমাজে যখন সামাজিক বন্ধনগুলো খুব দুর্বল হয়ে যায়। একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্কটা যখন অনেক লো লেভেলে চলে যায়। তখন মানুষ নিজেকে অনেক একা বোধ করে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ নিজেকে সমাজ থেকে সরিয়ে ফেলতে চায়। অসফলতার ইমোশন থেকে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।’ 

অধ্যাপক মনিরুল বলেন. ‘আপাতদৃষ্টিতে অভিমান, প্রেমঘটিত কিংবা পড়াশোনায় ব্যর্থতাসহ নানা কারণে মনে হয় মানুষ আত্মহত্যা করে। কিন্তু আত্মহত্যা মূলত করে দুটা প্রধান কারণে; সেটা হচ্ছে, প্রথমত যখন সমাজে ইন্টিগ্রেশন বেড়ে যায় তখন এক ধরনের আত্মহত্যা হয়। সেলফ সেক্রিফাইজ যেটা। আর সমাজে যখন ইন্ট্রিগেশন কমে যায় তখন হয় আরেক ধরনের আত্মহত্যা।’

সমাজতত্ত্ব বিভাগের এই শিক্ষক আরো বলেন, ‘আমাদের বর্তমান যে সামাজিক বন্ধন, এই বন্ধনটার মধ্যে নানা রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। যেমন আমরা এখন অতিমাত্রায় প্রত্যাশী, অতিমাত্রায় চাহিদা, অতিমাত্রায় ভার্চুয়াল জগতে থাকতে থাকতে সোস্যাল মিডিয়াগুলো ব্যবহার করতে করতে আমরা এখন মানুষের থেকে মানুষ বিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি। বন্ধুত্বটা এখন ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডশিপ। আগের মতো ফিজিক্যাল ফ্রেন্ডশিপ নেই।’

ভার্চুয়াল বন্ধুত্বকেই এখন বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে মনিরুল বলেন, ‘তাই খুব সহজেই মানুষ ফাঁদে পরে। মানুষ এখন একাকিত্বে ভোগে। বন্ধনটা শিথিল হয়ে গেছে। মেন্টালি সাপোর্ট পায় না। মানুষের ব্যর্থতাগুলো ধারণ করার মতো আর কেউ থাকে না; তার একাই ধারণ করতে হয়। ফলে অতিরিক্ত ইমোশনাল হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়। প্রত্যাশা আর চাহিদা অনুযায়ী না পাওয়াতেই আত্মহত্যায় ঝুঁকছে তারা।’

বয়োঃসন্ধিকালে আত্মহত্যা বেশি কেন?-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এই বয়সটা অথবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বয়সটা হচ্ছে তীব্র আবেগ প্রবণ সময়। এই বয়সে পার্সোনালিটির (ব্যক্তিত্ব) চাইতে ইমোশনটা (আবেগ) বেশি থাকে। এই ইমোশনাল মানুষগুলো নানা কারণে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।’

নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনো অধঃস্তন। প্রথাগত নিয়মেই নারীকে ডমিনেট করা হয়। যখন একজন পুরুষ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে তখন সে চাইলেই বাইরে যেতে পারে। অন্যের সাথে মিশে নিজের ইমোশনগুলো শেয়ার করতে পারে। কিন্তু একজন নারী তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেও ঘরেই থাকে। সে তার ইমোশন শেয়ার করার মতো মানুষ পায় না। একদিকে তার সামাজিক সম্পৃক্ততা কম আবার তার ফ্রেন্ডশিপগুলো ভার্চুয়াল। অনেককিছুই সে শেয়ার করতে পারে না। অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে। সেখানে সে হাসছে-খেলছে কিন্তু তার ভেতরে যে মেন্টাল ডিজঅর্ডার সেটা আমরা জানতে পারছি না। যার ফলে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। নারীদের মধ্যে ইমোশনাল ব্যালেন্স বা ম্যানেজমেন্টা কম।’

আত্মহত্যা শূন্যের কোটায় নামানোর অবস্থায় নেই জানিয়ে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশেও আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। সামাজিক ইন্ট্রিগেশন যদি এনশিউর করা যায়। ভার্চুয়াল রিলেশনের চেয়ে ফিজিক্যাল রিলেশনশিপগুলো যদি সচেতনভাবে প্রমোট করা যায় তাহলে আত্নহত্যার পরিমাণ কমবে। তবে শূন্যের কোটায় আনা সম্ভব না। অতীতেও কোনো জাতি পারেনি, বর্তমানেও পারছে না ভবিষ্যতেও পারবে কিনা জানা নেই।’

মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ, বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান  ও সহযোগী অধ্যাপক বিপ্লব কুমার দে সিভয়েস২৪ কে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যখন হতাশাগ্রস্থ হয়, বিষন্নতায় ভোগে, যারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না, তারাই বেশি আত্মহননের দিকে এগিয়ে যায়।’  ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্রেকআপ, গার্লফ্রেন্ডের প্রেসার থাকে, ফ্যামিলির পেশার থাকে। সবকিছু মিলিয়ে অনেক সময় ব্যালেন্স করতে পারে না। অন্যদিকে মেয়েদের মধ্যে একাডেমিক রেজাল্ট নিয়ে হতাশা থাকে। সেশনজট হতেও অনেকের মধ্যে প্রেশার কাজ করে।’-যোগ করেন তিনি।

মনোবিজ্ঞানী বিপ্লব কুমার দে বলেন, ‘স্কুল পর্যায়ে যেটা দেখা যায় ওই সময়টা হচ্ছে টিনএজের। এই বয়সে কিছু শারীরিক পরিবর্তন হয়, মানসিক পরিবর্তন হয়। শারীরিক পরিবর্তনের প্রভাবগুলো ছেলে বা মেয়ের ওপর মনস্তাত্ত্বিক মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে আমাদের দেশে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যে একটা পরিবর্তন বয়োঃসন্ধিকালে, সাধারণত এগুলো নিয়ে বাবা-মায়েরা কথা বলতে লজ্জা পায়। গুরুত্ব দেয় না। এই সময়গুলোতে এরা সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন বিষয় দেখে ভুলপথে চলে যায়। এসবে অনেক সময় ডিল করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিতে পারে।’

মনোবিজ্ঞানের এই শিক্ষক বলেন, ‘বিশেষ করে আত্মহত্যা তারাই বেশি করে যাদের বাবা-মায়েদের সন্তানদের প্রতি টেককেয়ার বেশি থাকে না, পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ বাবা-মায়েরা সন্তানদের অনেক সময় খবর রাখে না। তারা কোথায় কি করছে খুব বেশি কেয়ার করে না। এদের সন্তানরা বেশি আত্মহত্যা করে।’

‘আবার আরেক শ্রেণির বাবা মা আছেন যারা অতিরিক্ত কড়া শাসনের মধ্যে সন্তানদের মানুষ করে। সারাক্ষণ এটা করো, ওটা করো, এটা করতে পারবা না, ওটা করতে পারবা না। তুমি কার সাথে মিশছো। সারাক্ষণ পিছুপিছু থাকে। এসব অনেকসময় সন্তানরা মানতে পারে না। তারা ভাবে যে আমি এখন বড় হয়ে গেছি, আমার বাবা মা এখনও এমন করে।’-বলেন বিপ্লব দে।

এই মনোবিজ্ঞানীর মতে, ‘বয়োঃসন্ধিকালের সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এ সময়ে সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন এবং সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এ সময়ে বাচ্চাদের অনেকবেশি অভিমান থাকে, তারা একটু বেশি আবেগি থাকে, একটু খামখেয়ালি, মেজাজটা একটু খিটখিটে হয়। বাবা-মাকে অবশ্যই সেটা হ্যান্ডেল করতে হয় হবে।’ স্কুলগামী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শুধু বাবা মা নয় পুরো পরিবারের সাপোর্টটা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

সমাধানের পথ কী? জানতে চাইলে মনোবিজ্ঞানী বিপ্লব কুমার বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধনটা গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়ের উচিত বয়োঃসন্ধিকাল শুরুর আগেই সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা। শারিরীক মানসিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে সচেতন করা। তাদেরকে জানানো। সামাজিক,মানসিক,পারিপার্শ্বিক যে পরিবর্তন আসবে সেগুলোর বিষয়ে সন্তানদের অবহিত করা এবং সন্তান কীভাবে বিষয়গুলো হ্যান্ডেল করবে তাকে পরামর্শ দেয়া। সন্তানকে কড়া শাসনে নয়, বন্ধুর মতো করে আচরণ করা। ভুল করলে তাকে গাইড করা।’

‘আবার কোন বন্ধুর সাথে মিশছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাবা মায়েদের সেটাও দেখতে হবে। অনেকসময় দেখা যায় সন্তান ঘরের মধ্যে একা চুপচাপ থাকে দরজা বন্ধ করে। সে কি করছে সেগুলো বাবা মায়েদের খেয়াল করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় মোবাইলে চ্যাট করছে, গেমস খেলছে, ড্রাগ নিচ্ছে। এসব বিষয়ে একটু সচেতন হলে আত্মহত্যা কিন্তু ঠেকানো সম্ভব।’-এমনটা মনে করেন তিনি।

সঠিক ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্বরোপ

সঠিক ইসলামী শিক্ষার অভাবে আত্মহত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষন একাডেমীর পরিচালক মো. আনিসুজ্জামান সিকদার। তিনি সিভয়েস২৪কে বলেন, ‘ইসলামে আত্মহত্যার কোনো স্থান নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা মহাপাপ। কোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষ এই কাজটা করতে পারেন না।’

পবিত্র হাদিসের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এক যুদ্ধে রাসুল (সা.) এর একজন সাহাবি প্রচণ্ড যুদ্ধ করছেন। তাকে নিয়ে অন্য সাহাবিরা অনেক উচ্ছসিত, তার প্রশংসা করছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি মোনাফেক, কারণ তিনি যুদ্ধাবস্থায় বিষাক্ত তীরের আঘাতে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ধারালো তলোয়ার দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাকে মোনাফেক বলা হয়েছে। মোনাফেকের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।’

পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে সচেতনতা জরুরি বলে মনে করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই কর্মকর্তা।  তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সচেতনতা ও দক্ষতার উন্নয়ন জরুরি।’ তাই শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে শিক্ষকদেরও বিশেষ প্রশিক্ষনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

‘আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা অন্যতম বড় কারণ’ 

শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ। তিনি সিভয়েস২৪কে বলেন, ‘অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চূড়ান্ত হতাশা থেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেকে।’

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বয়োঃসন্ধিকালে মানসিক-শারিরিক বিকাশের সাথে অনেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। তারা সমাজে নানা নেতিবাচক কথার শিকার হয়। তারা এটা নিতে পারে না। না নিতে পারার মূল কারণ তাদের মানসিক প্রতিকূলতা মোকাবেলার শক্তি কমে যাওয়া। কমে যাওয়ার কারণ হলো তারা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে না, আনহেলদি খাবার খায়, কথা বলার স্পেস পায় না, বাবা মায়েদের সাথে সময় কাটাতে পারে না। তাদের জীবনটা রোবোটিক হয়ে গেছে। তাদের মাঝে ভঙ্গুরতা অনেক বেশি। এর ফলে ছোটখাটো কোনো কারণ বা অভিমানে তারা নিজেকে সরিয়ে ফেলতে চায়। তাছাড়া তাদের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘাটতি হলেই তারা আত্মহত্যার মত বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।’

আত্মহত্যা ঠেকাতে ‘প্যারেন্টিং’ এর দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি উল্লেখ করে তানসেন রোজ বলেন, ‘জেনারেশন গ্যাপের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সন্তান এবং বাবা মা একে অপরকে বুঝতে ব্যর্থ হন। এতে ভুল বোঝাবুঝি হয়। সন্তানও তার মনের কথা শেয়ার করার জায়গা পায় না। পরিবারকেও তারা ভরসার জায়গা হিসেবে পায় না। ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এছাড়া আমাদের বাবা-মায়েদের স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে।’  আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের শিক্ষক এবং বাবা মায়েদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

আত্মহত্যা ঠেকাতে কিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা মোকাবেলায় আঁচল ফাউন্ডেশন বেশ কিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে তারা হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বাড়ানোর জোর দিয়েছে৷ সন্তানদের মানসিক বিকাশ এবং তাদেরকে সহানুভূতির সাথে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য ‘প্যারেন্টিং’ কার্যক্রম চালু করার পরামর্শ দিয়েছে সংগঠনটি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। স্কুল, কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শনের জন্য বলা হয়েছে। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। এতে আর্থিক সংকটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে বলে মনে করে আঁচল ফাউন্ডেশন।

প্রেম-প্রণয় ঘটিত সম্পর্কে বা অজ্ঞাতসারে ধারণ করা গোপন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ ও সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে শান্তি উল্লেখপূর্বক বিশেষ প্রচারাভিযান পরিচালনা করা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা। এর মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল স্বাস্থ্য বিষয়ক ট্রেনিং দেওয়া। হেলথ কর্নার খোলা। কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করা যেতে পারে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতিতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া। সেমিনার ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন। নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ পাঠ্যপুস্তক অন্তর্ভুক্ত করা। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক ফাস্ট এইড (পার্ট-১)’ নামে একটি অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি-২০২২ এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার৷ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

: